হে ঈমানাদারগণ, তোমাদের উপর (রমজানের) রোজ ফরজ করা হল, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর, যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার”। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই ঘোষণা দ্বারা একটা সত্য প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর অফুরস্ত নৈকট্য লাভের প্রধান এবং একমাত্র মাধ্যমই হল সিয়াম। সিয়াম আরবী ‘সওম’ শব্দের বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ কোন কিছু থেকে বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হল, ‘সুবহে সাদিকের (প্রকৃত ঊষা) আভা ফুটে উঠার সময় থেকে সিয়ামের নিয়তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সর্বপ্রকার ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা’। সিয়ামই ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম যা নীরবে ও সবার অজান্তে সম্পাদন করা হয়। বিভিন্ন তফছীর ও হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ সমূহে বলা হয় যে, কোরানের বাক্য ‘তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর’ বলে বুঝানো হচ্ছে, হযরত আদম (আঃ) হতে রাসুলে করীম (সাঃ) পর্যন্ত সকল যুগের মানুষ অর্থাৎ সকল নবীর শরীয়াতে রোজা পালনের বাধ্য-বাধকতা ছিল। হযরত আদম (আঃ) এর যুগে প্রতি মাসের তিনটি রোজার হুকুম ছিল, হযরত মুছা (আঃ) এর শরীয়ত মুহাররমের দশ তারিখে রোজা রাখার আদেশ ছিল, হযরত দাউদ (আঃ) একদিন পর একদিন রোজা রাখতেন। হযরত মরিয়াম (আঃ) সম্পর্কে কোরআন মজীদে আছে, তিনি বলেন, আমি ‘আল্লাহর জন্য রোজার নিয়ত করেছি’ (সূরা মরিয়ম-২৬) তফসীরে হক্কানীতে বলা হয় যে, ইহুদীগণের উপর সপ্তম মাসের ১০ (দশ) তারিখে কাফ্ফারার রোজা রাখা ওয়াজিব ছিল, প্রাচীন খ্রীষ্টানরা সেই রোজা রাখতেন বলে প্রকাশ। হযরত মুছা (আঃ) তুর পর্বতে চল্লিশ দিন রোজা রেখেছিলেন, হযরত দানিয়েল (আঃ) রোজা পালন করেছিলেন একাধারে তিন সপ্তাহ, হযরত ইলিয়াছ (আঃ) ও চল্লিশ দিন রোজা রেখেছিলে বলে জানা যায়। আগের শরীয়ত সমূহে রমজান মাসের ত্রিশটি রোজা ফরজ ছিল কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে। কেউ কেউ বলেন, খ্রীষ্টানদের উপর রমজান মাসের রোজা ফরজ ছিল। কিন্তু তারা তাতে দু’টি পরিবর্তন করে। (১) কষ্টের ভয়ে তারা গ্রীষ্মের পরিবর্তে শরৎকালে রোজা রাখত। দ্বিতীয়তঃ এই ক্রটি পূরণের জন্য ত্রিশের অধিক রোজা পালন করত। মুফাচ্ছিরগণের অন্যদল বলেন, শুধু উম্মতে মুহাম্মদিরই উপরই রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। ইসলামী শরীয়তের রোজা ফরজ হওয়া সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজর (রাহঃ) বলেন, ‘রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানগণের উপর দশই মহররমের রোজা ফরজ ছিল, অতঃপর রজমানের রোজার হুকুম আসলে উক্ত রোজার ফরজিয়াত রহিত হয়ে পড়ে (বোখারী শরীফ) তাফছীর ‘মাসনাদে আহমদ’ এ উল্লেখিত হযরত মাআজবিন জোবালের এক দীর্ঘ রেওয়াতে উল্লেখ করেন, এতে বলা হয় ইসলামের শুরুতে রোজা তিনটি স্তর অতিক্রম করেঃ
প্রথমতঃ রাসুলে করীম (সাঃ) হিজরত করে মদীনা শরীফ গমন করলে প্রতিমাসে তিনটি রোজা রাখতেন। তৎসঙ্গে আশুরার রোজাও পালন করতেন। অতঃপর রমজানের রোজা ফরজ হয়।
দ্বিতীয়তঃ রমজানের রোজার আদেশ আসলে প্রথম দিকে মুসলমানদের এখতিয়ার দেওয়া হয় যে, যার ইচ্ছা রাখবে এবং যার ইচ্ছা ফিদিয়া দিবে, অতঃপর এই আয়াত নাযিল হয়, ‘যারা রজমানের মাসকে পায় তারা অবশ্যই রোজা রাখিবে’ (সুরা বাকারা) এই আদেশ মুসাফির ও পীড়িত নয় এমন প্রত্যেক নর-নারীর উপর রোজা পালন আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। তবে যারা চরম বার্ধক্যে উপনীত তাদেরকে প্রতি রোজার বদলে ফিদিয়া দেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
তৃতীয়তঃ ইতিপূর্বে রাতে শোয়ার পূর্ব পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। শুয়ে পড়লে সকল কাজ নিষিদ্ধ। অতঃপর কোরআনের অপর আয়াত মতে, সোবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত সকল আহার-বিহারের অনুমতি দেয়া হয় এবং সোবহে সাদিকের পর হতে সূর্যাস্ত রোজা পালনের হুকুম আসে।
রোজা কোন মাসে ফরজ হয় এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাছীর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিতাবে লিখেন যে, ‘হিজরী দ্বিতীয় সালে শাবান মাসে বদর যুদ্ধের আগে রজমানের রোজা ফরজ করা হয়’। মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রাঃ) বলেন, হিজরী দ্বিতীয় সালের দশই শাবান রোজা ফরজ করা হয় এবং উক্ত সালেই কিবলা পরিবর্তন, যাকাত ও ছদকায়ে ফিতরার হুকুম আসে।
রহমত, মাগফেরাত ও নাযাতের মাস মাহে রমজান। মাটির মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতির লক্ষ্যে যখনই কোন আসমানী তোহফা এসেছে, তখনই এই মাহে রমজানকেই বেছে নেয়া হয়েছে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ সহীফা মাহে রজমানের প্রথম তারিখে নাযিল হয়েছিল। হযরত মুসা (আঃ) এর প্রতি নাযিল হয়েছিল ‘তাওরাত’ তখন সময় ছিল ছয়ই রমজান। হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল ‘ইঞ্জিল’ ১৩ ই রমজান ছিল দিনটি। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ পবিত্র কুরআন নাজিলের সূচনা হয়েছিল মাহে রমজানে, যেমন এরশাদ হয়েছে ‘নিঃসন্দেহে আমি একে (কোরআন) নাযিল করেছি কদরের রজনীতে’। আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেছেন ‘মাহে রমজান সেই মাস যে মাসে পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহপাকের পবিত্র কালাম কোরআনে করীম নাযিল করার জন্যে আল্লাহ পাক পবিত্র রমজান মোবারককেই পছন্দ করেছেন। এ রমজানের এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রাতেই নাযিল হয়েছে সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী, ন্যায় অন্যায়ের বিভেদকারী আল কোরআন। আল্লাহ বলেন ‘ইন্না আনযালনাহু ফী লাইয়লাতিল কাদরি, ওয়ামা আদরাকা মা লায়লাতুল কাদরি, লায়লাতুল কাদরি খায়রুম মিন আলফিশাহর’; নিশ্চয় আমি এই কোরআন কদর বা সম্মানিত রাত্রিতে নাযিল করেছি।
মাহে রমজানের ফজিলত ও বরকত অপরিসীম। এ সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘রোজা এবং পবিত্র কোরআন উভয়ই কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা বলবে আমার জন্য এই বান্দা পানাহার বন্ধ রেখেছিল। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করা হোক। পবিত্র কোরআন বলবে আমার কারণে সে রাত্রে নিদ্রিত হয়নি তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করা হোক। তারপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। হযরত আবু হোরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর (সা:) বলেছেন ‘আমার উম্মতকে রমজান শরীফের ব্যাপারে এমন পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা অন্য কোন উম্মতকে দেয়া হয়নি।
১. রোজদারের মুখ থেকে যে গন্ধ বেরোয় তা আল্লাহ পাকের নিকট কস্তুরী থেকেও অধিকতর পছন্দনীয়।
২. রোজাদারের জন্য সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে এবং ইফতারের সময় পর্যন্ত দোয়া অব্যাহত রাখে।
৩. প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারের জন্য
সুসজ্জিত করা হয়। আল্লাহ পাক এরশাদ করেনঃ আমার নেক বান্দারা দুনিয়ার দুঃখ
কষ্ট পশ্চাতে রেখে অতি শীঘ্রই আমার নিকট আসবে।
৪. রমজানে দুর্বৃত্ত শয়তানকে বন্দী করা
হয়, ফলে সে রমজানে সকল অন্যায়ের দিকে ধাবিত করতে সক্ষম হয় না, যা রমজান
ব্যতীত অন্য সময়ে সক্ষম হয়।
৫. রমজানের শেষ রাতে আল্লাহ পাক রোজাদারদেরকে মাগফেরাত দান করেন।
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, এ রাত কি শবে মাগফেরাত না শবে কদর? হুজুর (সাঃ) এরশাদ করলেন, না বরং নিয়ম এই যে শ্রমিক যখন তার কাজ শেষ করে তখনই তাকে পারিশমিক দিয়ে দেয়া হয়।
মাহে রমজানের সংগে ঈদুল ফিতর এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর প্রত্যেক রোজাদার তথা প্রত্যেকটি মুসলমান ঈদুল ফিতরের দিকে চেয়ে থাকে। ঈদুল ফিতরের দিন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে খুশির বান ডেকে যায়। ঈদের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হল হযরত নবী করিম (সাঃ) মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করার পর সেই বছরই প্রথম রমজান মাসে রোজা পালন করার আদেশ নাযিল হয়। তখন মদিনায় পারসীকদের প্রভাবে ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামে দু’টি উৎসবের রীতি নীতি ও ধারাগুলির সাথে ইসলামী আদব ও রীতি নীতির কোন সম্পর্ক ছিল না বলে হযরত নবী করীম (সা:) মুসলমানদের ওইসব হতে বিরত থাকার আদেশ দেন এবং তার স্থালে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এ দুটি উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন করেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেছেন ‘সকল জাতিরই খুশির দিন থাকে, আর আমাদের খুশির দিন হচ্ছে এই ঈদের দিন’ (বুখারী ও মুসলিম)।
হাদীস শরীফে আছে হযরত নবী করীম (সাঃ) বলেন যখন ঈদুল ফিতরের দিনটি উপস্থিত হয় তখন আল্লাহ তাআলা মুসলমান রোজাদার বান্দাদের লইয়া ফেরেশতাগণের সম্মুখে গৌরব করিয়া থাকেন। তিনি ফেরেশতাদের জিজ্ঞসা করেন ‘হে ফেরেশতারা কাহারও উপর কোন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হইলে সে যদি উহা পুরাপুরি ভাবে পালন করে তবে তার কি প্রতিদান দেওয়া উচিৎ? তাহারা বলেন তাহাকে সেই কাজের পুরাপুরি সওয়াব দেওয়া উচিত। তখন আল্লাহ বলেন আমার বান্দা ও বান্দীদের উপর আমি যে কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করিয়া ছিলাম তাহারা যথাযথ ভাবে তাহা পালন করিয়াছে। অতঃপর লোকেরা যখন দোয়া করিতে করিতে ঈদগাহের দিকে রওনা হয় তখন আল্লাহতায়ালা বলেন আমার ইজ্জতের কসম! আমার শান-শওকত ও উচ্চ মর্যাদার কসম! আমি অবশ্যই তাহাদের দেয়া বকুল করিব। এরপর তিনি বান্দাদের ডাকিয়া বলেন ওহে আমার বান্দারা! এবার তোমরা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া যাও। আমি তোমাদিগকে মাফ করিয়া দিয়াছি এবং তোমাদের পাপ কাজগুলিকে নেকীতে পরিণত করিয়া দিয়াছি। নবী করীম (সা:) বলেন, তখন তাহারা ক্ষমাপ্রাপ্ত নিষ্পাপ অবস্থায় আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করে (বায়হাকী)।
মাহে রমজানের সাথে আরও একটি এবাদাতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, সেটা হল ‘ছদকায়ে ফিতর’। হাদীস শরীফে আছে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত হযরত নবী করীম (সা:) বলেছেন ‘বেহুদা কাজ ও ফাহেশা কথা জনিত ক্রটি-বিচ্যুতি হইতে রোজাকে পাক করার এবং মিসকিন গরীবদের উপর ‘ছদকায়ে ফিতর’ ওয়াজিব করিয়াছেন। (আবু দাউদ) ছিয়াসত্তার এই হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয় যে ছদকায়ে ফিতরের মাধ্যমে ধনী ও গরীবদের মধ্যে ঈদের আনন্দ সমভাবে বিরাজ করে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে আছে, উক্ত ছদকায়ে ফিতরা ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। মাহে রমজান বিশ্বের সকল মুসলমানের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগ, সহমর্মিতা শিক্ষা দেয়। পরিশেষে সংক্ষেপে বলা যায় রমজান আসে বিশ্ব মুসলিমের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মঙ্গলময় ‘সওগাত’ নিয়ে।