১৫৫৬ খৃষ্ঠাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে বালক সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর বৈরাম খানের অভিভাবকত্যে দিল্লী-আগ্রা পুনঃরুদ্ধার করে মুঘল সালতানাতের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। এরপর সম্রাট আকবর গোয়লিয়া, আজমীর, জৌনপুর পুনরাধিকার করে মুঘল সালতানাতকে শক্ত ভীতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি চিতোর, রনথম্বোর, বিকানীর, কালিঞ্জর, চিতোর, মেবার ও গুজরাটের বিরুদ্ধে বিজয় অভিযান পরিচালনা করে সফল হন। গুজরাট জয়ের পর সম্রাট আকবরের নৌ শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে। এ সময় সম্রাট আকবর বাংলাদেশে তার প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন। সেই সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শাসক শাসনকার্য পরিচালনা করিতেছিল। এর মধ্যে আফগান শাসক সুলেমান কররাণী বাংলা ও উড়িষ্য শাসন করিতেছিলেন। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আফগান সমর্থনে বাংলার কিছু ভূইয়া বা জমিদার স্বাধীনভাবে তাদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছিলো। বাংলার ওই সকল ভূইয়া বা জমিদারদের ইতিহাসে বারো ভূইয়া নামে পরিচিত। বারো ভূইয়ার এক ভূইয়া যশোরের জমিদার প্রতাপাদিত্য।
গত ১৮ ফেব্রয়ারী ২০১৭ শনিবার পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে শিক্ষক-কর্মচারী মিলে দেখতে গেলাম প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধূমঘাট। আমাদের গাইড হিসেবে ধূমঘাট গ্রামের আবুল কাসেম গাজীর পুত্র ইসমাইল হোসেনকে পেলাম। ইসমাইল পেশায় শিক্ষক। চমৎকার ছেলেটি। তার কাছ থেকে ধূমঘাট সম্পর্কে জানলাম সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৮নং ইশ্বরীপুর ইঊনিয়নের একটি গ্রাম ধূমঘাট। এই গ্রামেই পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে যশোহরের জমিদার প্রতাপাদিত্য রাজধানী স্থাপন করেন। প্রবল প্রতাপ মুঘল বাদশাহ সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্র সেনাপতি টোডরমলের সুপারিশে বিক্রমাদিত্য ও তার ভ্রাতা বসন্ত রায় মুঘলদের অধীন সামান্তরাজ হিসেবে জমিদারি লাভ করেন। পরবর্তী কালে আগ্রায় গিয়ে পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নিজে নামে জমিদারি সনদ লাভ করেন। এই প্রতাপাদিত্য ১৫৯৯ সালে মুঘল কর্তৃত্ব অস্বীকার করলে মুঘলরা তাকে দমনের জন্য যুদ্ধাভিজান পরিচালনা করেন। মুঘলদের প্রতিরোধের জন্য সুন্দরবন সংলগ্ন দুর্গম এলাকা ধূমঘাটে রাজধানী স্থাপন করে প্রতিরোধের চেষ্ঠা করেন। তার সকল চেষ্ঠা ব্যর্থতায় পর্যাবসিত হয়। প্রতাপাদিত্য বন্দী অবস্তায় আগ্রায় নেওয়ার পথে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই হলো সারসংক্ষেপ। নিম্নে প্রতাপাদিত্যের উত্থান সম্পর্কে আলোচিত হলো।
গুজরাট বিজয়ের পর সম্রাট আকবর বাংলা বিজয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট আকবরের যুদ্ধ নীতি ছিল আক্রমণের পূর্বে বশ্যতা স্বীকারের জন্য দূত প্রেরণ করতেন। কোন শাসক আকররের বশ্যতা স্বীকার করলে তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতেন না। তখন বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন আফগান শাসক সুলেমান খান কররাণী। সুলেমান কররাণী দুরদর্শী শাসক ছিলেন। তিনি মুঘলদের শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নির্বিঘ্নে রাজ্য শাসন করতেন। সুলেমান কররাণীর মৃত্যুর পর তার পুত্র দাউদ কররাণী শাসনভার গ্রহন করে মুঘল কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। গুজরাটে যুদ্ধাবস্থায় আকবরের ব্যস্ততার সুযোগে দাউদ কররাণী মুঘলদের পূর্ব সীমান্তবর্তী জামনিয়া দূর্গটি দখল করেন। এ কারণে ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করলে দাউদ পরাজিত হয়ে মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই দাউদ পুনঃরায় বিদ্রোহ করলে মুঘল বাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে অবশেষে রাজমহলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।
মুঘল আক্রমণে পর্যদুস্ত দাউদ যখন বুঝতে পারেন তার সময় শেষ,তখন তাদেরই অন্নে প্রতিপালিত শ্রীহরি ওরপে বিক্রমাদিত্য ও জানকিবল্লব ওরপে বসন্তরায়ের হাতে কররাণী বংশের সকল ধনরত্ন আমানত সরুপ প্রদান করেন। প্রাপ্ত ধনরত্ন বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় নৌপথে সংগোপনে তাদেরই প্রদানকৃত বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ভূভাগ যশোহর রাজ্যে নিয়ে আসেন। দাউদ ছাড়াও তার সভাসদগণ অনেকেই মুঘল বিদ্রেহের পরিনতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারাও অনেকে তাদের সঞ্চিত সম্পদ বিক্রমাদিত্যকে প্রদান করে সেগুলো নির্বিঘ্নে যশোহর পৌছানোর জন্য সহায়তা করেছিলেন। দাউদের পতনের পর আফগানদের থেকে প্রাপ্ত বিপুল ধনরত্নের সহায়তায় উভয় ভ্রাতা রাজ্যে স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তারা অনুভব করে রাজ্যে স্থাপনের জন্য মুঘল আনুকল্য বিশেষ প্রয়োজন। তারা সুকৌশলে দাউদের পক্ষ ত্যাগ করে মুঘলদের সংগে আঁতাত করার পথ খুঁজতে থাকে। সুযোগও মিলে যায়। মুঘল রাজপুত সেনাপতি টোডরমলের সংগে সাক্ষাৎ করে তারা মুঘল আনুগত্য স্বীকার করেন এবং কররাণী শাসনামলের কিছু হিসাব-পত্রাদি প্রত্যর্পন করেন। সেনাপতি টোডরমলও তাদের প্রশ্রয়দাতা হয়ে মুঘলদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। টোডরমলের অনুরোধে বিক্রাদিত্য মুঘল স¤্রাট আকবরের সামান্তরাজ বলে স্বীকৃতি লাভ করেন এবং যশোহর রাজ্যের সনদপ্রাপ্ত হন।
১৫৭৭ খৃষ্ঠাব্দে বিক্রমাদিত্য যশোরে ফেরত এসে মুঘল সামান্তরাজ হিসেবে যশোহর রাজ্যের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার রাজ্যাভিষেক ধুমধামের সহিত পালিত হয়। গৌড় থেকে প্রাপ্ত অঢেল ধনরত্ন ও মুঘলদের সনদ প্রাপ্ত হয়ে যশোহর রাজ্য নিবিঘ্নে গড়ে উঠতে থাকে। শ্রীহরি গৌড়ে অবস্থানকালে গোপীনাথ নামে তার এক পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। বিক্রমাদিত্য ‘মহারাজ’ উপাধি লাভের পর গোপীনাথ যুবরাজ প্রতাপাদিত্য নামে পরিচিত হন। জন্মের মাত্র পঞ্চম দিনে সুতিকাগারে তার মা মারা যায়। প্রতাপের জন্মকোষ্ঠীতে পিতৃহন্তা দোষ ছিল। পত্নীর বিয়োগ ও কোষ্ঠীতে পিতৃহন্তা দোষ থাকার কারণে আতুড়ঘর থেকেই বিক্রমাদিত্য সন্তানের প্রতি নাখোশ ছিলেন। সুতিকাগার থেকে খুল্লতাত জানকিবল্লভ ও তার জেষ্ঠা পত্নীর অপথ্য স্নেহ ও ভালবাসায় গোপীনাথ প্রতিপালিত হতে থাকেন।
১৫৭৮ খৃষ্টাব্দের শেষ ভাগে যুবরাজ প্রতাপাদিত্য আগ্রায় গিয়ে তিন বছর সেখানে অবস্থান করেন। ১৫৮০ খৃস্টাব্দে বঙ্গ-বিহারে জায়গীরদারদের বিদ্রোহ দেখা দিলে স¤্রাট আকবর সেনাপতি টোডরমলকে বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করেন। টোডরমল সফলতার সাথে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। ওই সময় যশোহর রাজ্য সেই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি। তিন বছর আগ্রায় অবস্থান কালে যুবরাজ প্রতাপাদিত্য নিজে যশোহর রাজ্যের কর্তৃত্ব লাভের চেষ্ঠা করেন। তখন যশোহর রাজ্য থেকে বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় কর্তৃক প্রেরিত রাজকর মুঘল সম্রাটের খাজাঞ্চি খানায় জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন এবং সুবিধামত সময়ে সম্রাটকে পিতার বিরুদ্ধে রাজকর পরিশোধের অনিহার কথা জানান। পাশাপাশি সম্রাটকে আশ্বস্ত করেন তার নামে যশোহরের সামান্ত রাজার সনদ দিলে তিনি রাজকর পরিশোধ করবেন। এছাড়াও চিরদিন তিনি মুঘল সম্রাটের অনুগত থাকবেন। সম্রাট আকবর প্রতাপের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে প্রতাপের নামে যশোহর রাজ্যের সনদ দিলে আত্মসাৎকৃত অর্থ থেকে রাজকর পরিশোধ করেন। সম্রাট আকবর তাকে যানবাহন ও সৈন্যসামান্ত দিয়ে যশোহর রাজ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ১৫৮২ খৃষ্ঠাব্দে প্রতাপাদিত্য মুঘল সম্রাটের বলে বলিয়ান হয়ে যশোহর রাজ্যে পৌছান এবং পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন ও যশোহর দূর্গ অবরোধ করেন।
প্রতাপাদিত্যের আচরণে রাজপরিবারের সকলেই হতবাক হন। বসন্তরায়ের পরামর্শক্রমে সকলে খুশি হওয়ার অভিনয় করে। যুবরাজ প্রতাপাদিত্য তখন থেকে রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে হয়ে ওঠেন। বিক্রমাদিত্য নামে মাত্র রাজা। সকল ক্ষমতা প্রতাপের। পুত্রের শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা , ক্ষমতালিষ্পা বিক্রমাদিত্যকে দারুনভাবে আহত করে। এই ঘটনার মাত্র এক বছর পর ১৫৮৩ সালের শেষভাগে তিনি দেহত্যাগ করেন। সাড়ম্বরে যশোহরের রাজধানীতে তার শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পাদিত হয়। শ্রদ্ধাক্রিয়াদির পর ১৫৮৪ সালের প্রথম ভাগে এক পূর্ণিমায় তীথিতে ব্যাপক জাকজমক সহকারে প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে আগত আমন্ত্রিত নৃপতিদের সাথে আলোচনা করে প্রতাপাদিত্য মুঘল বিরোধী জোট গঠনের চেষ্ঠা করেন। তার চেষ্টা সফল হয়নি বলে মনে হয়।
বিক্রমাদিত্যের জীবদ্দশায় তার ও ভ্রাতা বসন্তরায়ের ভিতর যশোহর রাজ্যে ভাগাভাগি হয়। রাজ্যের পূর্ব-অংশ ১০ (দশ) আনা পেলেন প্রতাপাদিত্য এবং পশ্চিম-অংশ ৬ (ছয়) আনা পেলেন বসন্ত রায়। রাজ্যের একেবারে পূর্বে চকশ্রী পরগনায় বসন্ত রায়ের শ্বশুর কৃষ্ণরায় দত্ত ভূসম্পত্তিলাভ করে রাঙ্গদিয়ায় বসবাস করেন। সে কারণে চকশ্রী প্রতাপের অংশের ভিতর হলেও তার উপর প্রতাপের কর্তৃত্ব ছিল না। কিন্তু প্রতাপের রাজ্যের পূর্বসীমানার নিরাপত্তা রক্ষার জন্যও চকশ্রীতে নৌদূর্গ নির্মানের প্রয়োজন ছিল। সে কারণে প্রতাপাদিত্য অন্য স্থানের বিনিময়ে হলেও চকশ্রৗ দাবী করেন। কিন্তু সন্তান ও শ্যালকদের ঘোর আপতিতে বসন্ত রায় চকশ্রী প্রদানে অসম্মতি জানালেন। প্রতাপ খুল্লতাতকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগও এসে যায়। খুল্লতাতোর পিতৃ শ্রদ্ধার তিথি উপস্থিত হলে তিনি তা পালনের জন্য প্রস্তুত হইলেন। অনুষ্ঠানে প্রতাপকে রায়গড় দূর্গে নিমন্ত্রন করা হলো। কিন্তু অন্যান্য বারের ন্যায় এবার তিনি খালি হাতে এলেন না। বাছাইকরা কিছু সৈন্যসহ সসস্ত্র যোদ্ধাবেশে রায়গড় দূর্গে প্রবেশ করলেন। আতুড়ঘর থেকে শুরু করে রাজ্যভার গ্রহণ পর্যন্ত পিতৃ-মাতৃ স্নেহে লালন-পালনকারী খুল্লতাত বসন্ত রায় ও তার জেষ্ঠা পত্নীর বিশ্বাস ছিল তাদের অন্তরে বড় ধরনের আঘাত লাগে এমন কাজ প্রতাপাদিত্য কখনও করবেনা। তাদের সেই বিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় তখন, যখন পিতৃশ্রাদ্ধ পালনরত পৌঢ় বসন্ত রায়কে শিরোচ্ছেদ করে পিতৃ-মাতৃ স্নেহের প্রতিদান দেয় প্রতাপ। খুল্লতাতো ছাড়াও তার দুইপুত্র গোবিন্দ ও চন্দ্র এবং গোবিন্দের গর্ভবতী স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করেন প্রতাপাদিত্য । চকশ্রী প্রতাপাদিত্যের হস্তগত হয়।
ইতিমধ্যে প্রতাপাদিত্য মুঘলদের বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেন। আরাকান রাজের সংগেও তার সম্পর্ক ভাল ছিল না। মুঘলদের সংগে ছলনা করা সহজ হবে না বিবেচনা করে প্রতাপ আরাকান রাজের সাথে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন। আরাকান রাজের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য আরাকান রাজের শত্রু পর্টুগীজ সেনাপতি কার্ভালোকে ডেকে এনে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তাকে হত্যা করেন। কার্ভালোর ছিন্ন মস্তক আরাকান রাজের নিকট পাঠিয়ে আরাকান রাজের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। ১৫৯৯ খৃষ্ঠাব্দে প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এই সংবাদ সম্রাট আকবরের নিকট পৌছালে স¤্রাট তাকে দমন করার জন্য রাজা মান্সিংহকে দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৬০৬ খৃষ্ঠাব্দে সেনাপতি মানসিংহ সসৈন্যে বাংলায় আসেন এবং প্রতাপের রাজ্য আক্রমণ করেন। বসন্তপুর হতে ধূমঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ চলে। তিন দিন যুদ্ধের পর প্রতাপাদিত্য পরাজিত হয়ে সন্ধি প্রার্থনা করেন। সন্ধির শর্তানুসারে মুঘল স¤্রাটের বিরুদ্ধে কখনও বিরুদ্ধাচারণ না করার ও স্বাধীনতার সকল চিহ্ন মুছিয়া ফেলার শর্তে প্রতিঞ্জা করে নিজ রাজ্যে ফিরে পেলেন। কচুরায়ও তার পিতার প্রাপ্ত অংশ ফিরে পেলেন। এই যুদ্ধে যে সকল মুঘল সৈনিক মারা যান তাদের বংশীপুর(টেঙ্গা)মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। এই যুদ্ধে স্বজাতীয় সেনাপতি মান্সিংহের কৃপাবলে গুরুপাপে লঘুদণ্ড পেলেন। যুদ্ধে নিহত ওমরাহ মাহমুদের নামানুসারে মামুদপুর গ্রামের নাম রাখা হয়। প্রতাপাদিতকে দমন করে মানসিংহ রাজমহলে ফিরে যান। অভিযান শেষে মান্সিংহের সংগে আসা সৈন্যদের ভিতর কেও কেও সুন্দর স্থান ও স্বচ্ছন্দ জীবিকার ভরসায় বর্তমান যশোর-খুলনার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এদেশের বাসিন্দা হয়ে যান। যশোর শহরের খড়কিতে বসবাসরত পীরবংশীয়রা তাদেরই অংশ।
সম্রাট আকবারের মৃত্যুর পর পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি সমগ্র বাংলাকে মুঘল শাসনাধীনে আনার সংকল্প করে ইসলাম খাঁ কে বাংলার সুবেদার করে পাঠান। ১৬০৮ খৃস্টাব্দে ইসলাম খান রাজমহলে পৌছিলে প্রতাপাদিত্য তার বালকপুত্র সংগ্রামাদিত্যের নিকট কয়েকটি হাতী ও কিছু মূল্যবান উপহারসহ সুবেদারের নিকট পাঠান। এ ছাড়াও প্রয়োজনে নিজে সাক্ষাত করার প্রতিশ্রুতি লিখে পাঠান। জবাবে নবাব ইসলাম খাঁ প্রতাপ পুত্রকে সমাদর করেন এবং বিদায়ের সময় প্রতাপাদিত্যকে সাক্ষাতের নির্দেশ দিয়ে পাঠান। অনুরুপ সংবাদ ভূষণার জমিদার মুকুন্দ রায়কেও পাঠান। নবাব দীর্ঘ অপেক্ষার পরও যখন প্রতাপাদিত্য ও মুকুন্দরাম সাক্ষাৎ করলেন না। তখন নবাবের নির্দেশে মুঘল বাহিনী কুচ করে ফতেপুর পৌছান এবং সেখানে আরও একমাস অপেক্ষা করেন। এ সময় ভূষনার জমিদার মুকুন্দ রায় নিজ পুত্রসহ ১৮ টি হাতী ও বহু উপহার সামগ্রিসহ নবাবের সংগে সাক্ষাৎ করেন। অনুরুপ যশোহরের প্রতাপাদিত্য পঞ্চাশ হাজার টাকা, ৬টি হাতী ও বহু মূল্যবান উপহারসহ বজ্রপুরে নবাবের সাথে সাক্ষাৎ করলে নবাব তাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। বিদায়ের পূর্বে মুছা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৫০০ রণপোত, ১ হাজার অশ্বারোহী , ২০ হাজার পদাতিক সৈন্য সহায়তা দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি আদায় করে বিভিন্ন উপহার ও খেলাৎ দিয়ে নবাব তাদের স্বদেশে ফিরে গিয়ে প্রস্তুতি গ্রহনের নির্দেশ দেন।
যথা সময় সুবেদার নবাব ইসলাম খাঁ বিদ্রেহী ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিাযান পরিচালনা করে সফলতা লাভ করেন। কিন্তু অভিযানের সময় নবাবকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতাপাদিত্য সহ্য়াতা পাঠাননি। তবে ভূষনার মুকুন্দরায় এবং তার পুত্র সুত্রাজিৎ মুঘল পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। সকল যুদ্ধে মুঘলদের বিজয় দেখে প্রতপাদিত্য মুঘল রোসানাল থেকে বাঁচার জন্য ছলনার আশ্রায় নিয়ে ৮০ খানা রণপোতসহ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে ঘোড়াঘাটে পাঠিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু নবাব ইসলাম খাঁ তার ছলনাপূর্ণ প্রার্থনা প্রত্যাখান করে প্রতাপাদিত্য প্রেরিত ৮০ খানা রণপোত নৌ বাহিনীতে সংযুক্ত না করে মীর-ই ইমারত কে নির্মান সামগ্রী বহনের কাজে ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
সুবেদার ইসলাম খাঁ অনুভব করেন দূরবর্তী রাজমহল থেকে বঙ্গদেশ নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয়। তাই তিনি রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করে ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতাপ যথাসময়ে সৈন্য সহায়তা প্রেরণ না করায় নবাব ক্রোধান্বিত হন এবং ঘোড়াঘাট হতে ঢাকায় ফিরার পূর্বেই ইনায়েত খাঁকে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ দেন। এই যুদ্ধে এনায়েত খাঁর প্রধান সহকারী ছিলেন মির্জা নথন। ইনি নওয়ারা ও তোপ বিভাগের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন। মুঘল বাহিনী উৎসবপূর্ণ পরিবেশে শিকার করতে করতে প্রতাপের রাজধানীর পথে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রতাপ পুত্রের নিকট নবাবের ক্রোধের কথা জেনে বিচলিত হয়ে পড়েন। পূর্বে স্ব-জাতীয় মুঘল সেনাপতিদের মাধ্যমে তিনি যে সকল সুবিধা আদায় করেছেন তা এবার সম্ভব নয় ভেবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করতে থাকেন। যুদ্ধের ফলাফলও কি হতে পারে তিনি এবং তার সেনাপতিগণ অনুমান করেছিলেন। প্রতাপের পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধে মুঘল বাহিনীকে কিছুদিন ঠেকিয়ে রেখে সন্ধির মাধ্যমে নিজেকে ও তার রাজ্যকে রক্ষা করা।
প্রতাপাদিত্য মুঘল বাহিনী প্রতিরোধের জন্য তার সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ রাজধানী রক্ষার জন্য নিজ নেতৃত্বে ধূমঘাটে অবস্থান করেন। অন্য ভাগ জেষ্ঠপুত্র উদায়াদিত্যের নেতৃত্বে সালখার মোহনায় বাঁধা দেওয়ার জন্য পাঠান। উদায়াদিত্যের সাথে তার প্রধান সহকারী খোঁজা কমল নৌ-সেনার অধিনায়ক এবং কতলু খাঁর পুত্র জামাল খাঁ অশ্বারোহি ও পদাতিক সৈন্যের দায়িত্ব গ্রহন করেন। মুঘল বাহিনী সালখাতে পৌছে অসংখ্য রণতরী ও উদয়ের দূর্গ নির্মানের সংবাদ পেয়ে নিজেদের যুদ্ধ কৌশল ঠিক করে নেন। সিদ্ধান্ত হয় ইছামতির দুই তীর দিয়ে স্থলবাহিনী অগ্রসর হবে। নৌ-বাহিনীও দুই ভাগে ভাগ হয়ে নদীর দুই তীর ঘেঁসে অগ্রসর হবে। ইছামতির পশ্চিম পাড়ের নেতৃত্ব দেবেন মির্জা নথন ও পূর্ব পাড়ের নেতৃত্বে থাকলেন সয়ং এনায়েত খাঁ। তোপ বাহিনীর সহায়তায় উভয় বাহিনী অগ্রসর হবে।
পূর্ব দিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন মুঘল বাহিনীর কুচ আরম্ভ হলো। প্রথমে নৌ-যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতাপাদিত্যের সমর শক্তির প্রধান শক্তিই নৌশক্তি। এই বাহিনীর প্রধান দায়িত্বে ছিলেন কমল খোজা, প্রধান সেনাপতি ছিলেন যুবরাজ উদায়াদিত্য। যুদ্ধে কমল খোজা নিহত হলেন এবং উদায়াদিত্য পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। সালখার যুদ্ধ নৌ-যুদ্ধ হলেও মুঘলরা স্থলের গোলোন্দাজ ও তীরন্দাজের সহায়তায় তা সহজেই জয়লাভ করলো। পূর্ব থেকে শঙ্কিত প্রতাপ বাহিনীর এই পরাজয় সেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে যায়। জামাল খাঁ হস্তি বাহিনী নিয়ে খাগড়াঘাটে মোগল পক্ষে যোগ দিলেন। খাগড়াঘাট (ধূমঘাট) যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর প্রবল আক্রমনে প্রতাপ বাহিনী টিকতে না পেরে ধূমঘাট দূর্গাভ্যন্তরে আশ্রয় লইলেন। যুদ্ধের পরিস্থিতি বিবেচনা করে পিতা-পুত্র আত্মসমার্পনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে প্রতাপাদিত্য তার দুইজন মন্ত্রীসহ নিজে এনায়েত খাঁর শিবিরে গিয়ে শিবিরের বাহিরে দাড়িয়ে সাক্ষাত প্রার্থনা করেন। এনায়েত খাঁ সন্ধির প্রস্তাবে প্রতাপাদিত্যকে সংগে নিয়ে ঢাকায় সুবেদার নবাব ইসলাম খাঁর সংগে সাক্ষাতের পর নবাবের মর্জি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে বলে প্রতাপকে জানান। প্রতাপও এনায়েতের কথায় রাজি হয়ে সন্ধির উদ্দেশ্যে এনায়েত খাঁর সংগে ঢাকায় রওনা হন।
যথা সময়ে এনায়েত খাঁ প্রতাপাদিত্যকে সংগে নিয়ে নবাব ইসলাম খাঁ’র সহিত সাক্ষাত করলেন। নবাব ইসলাম খাঁ প্রতাপের সন্ধির প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তিনি প্রতাপকে বন্দী করলেন। নবাব বন্দি ও শৃঙ্খলিত প্রতাপকে লোহার খাঁচায় পুরে আগ্রায় সম্রাটের দরবারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আগ্রায় নেওয়ার পথে ৫০ বছর বয়সি শৃঙ্খলিত প্রতাপ বারানাসি পৌছালে তার মৃত্যু হয়। প্রতাপের ঢাকা পৌছানোর পর যে পরিনতি হয়েছিল সে খবর রাজধানী ধূমঘাটে পৌছালে উদায়াদিত্য সেনাপতি মীর্জা নথনের সৈন্যদের উপর চড়াও হলে মুঘল সৈন্যদের হাতে তিনি নিহত হন। মুঘল সৈন্য কর্তৃক দূর্গ দখলের পূর্বে প্রতাপ মহিষী পরিবারের অন্যান্য নারী ও শিশু-সন্তানসহ যমুনা জলে আত্মবিসর্জন দেন। অতঃপর মুঘল বাহিনী ধূমঘাট দূর্গ দখল করে ধূলিসাৎ করে দেয়। নবাব যশোহর প্রদেশ বাদশাহী রাজ্যভূক্ত করলেন। এনায়েত খাঁকে যশোর রাজ্যের প্রথম শাসনকর্তা তথা ফৌজদার নিয়োগ করেন এবং বাদশাহী দেওয়ান পাঠালেন প্রজাকষ্ট না বাড়িয়ে কত খাজনা আদায় করা যায় তা নির্ধারনের জন্য। এনায়েত খাঁ টেঙ্গা মসজিদের সন্নিকটে নির্মিত প্রাসাদে বসবাস করতে থাকেন। বর্তমানে এই প্রাসাদটি হামামখানা বলে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। এনায়েত খাঁ বসন্ত রায়ের পুত্র চন্দ্র শেখর রায় ওরপে চাঁদ রায়কে ধূমঘাট দূর্গে এসে বাস করার অনুমোতি দেন। সুন্দরবন অঞ্চলের আবহাওয়ায় এনায়েত খাঁর স্বাস্থ্য হানি ঘটে। ধারনা করা হয় এই সময় সুন্দরবন অঞ্চলে প্রকৃতিক বিপর্যয় ও ভূমি অবনমন ঘটে। সে কারণে এনায়েত খাঁ ও চাঁদ রায় ধূমঘাট পরিত্যাগ করেন।
এনায়েত খাঁ ও চাঁদ রায় ধূমঘাট এলাকা পরিত্যাগের পর ধূমঘাটের গুরুত্ত্ব ক্রমান্বয় কমতে থাকে। এই ভাবে বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় কর্তৃক আফগান ও মুঘলদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ধনসম্পদ ও ক্ষমতার যে সিঁড়ি রচিত হয়েছিল; প্রতাপাদিত্যের অযোগ্যতা, অনভিজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, ক্ষমতালিষ্পা, নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মাত্র ৩৪ বছরে সেই ক্ষুদ্র যশোহর রাজ্যের রায় রাজত্বের যবনিকা রচিত হলো। একটি অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থান-পতন অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। একটি রাজ্যের প্রায় চার দশকের রাজধানীর কোন চিহ্নই ধূমঘাটে আজ আর অবশিষ্ঠ নেই। মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী “ঐতিহাসিক ধূমঘাট এখন শুধুই স্মৃতি”।
তথ্যসূত্রঃ
১। ভারতের ইতিহাস কথা- ডা: কিরণ চন্দ্র চৌধুরী
(যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য
২। যশোর-খুলনার ইতিহাস- সতীশ চন্দ্র মিত্র।
৩। বাংলাদেশের ইতিহাস- ড: মুহম্মদ আব্দুর রহিম, ড: আব্দুল মান্নান চৌধুরী, ড: এ,বি,এম মাহমুদ ও ড: সিরাজুল ইসলাম।
৪। রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র- রাম রাম বসু।
চর্চ্চা ও গবেষণা না থাকায় মনোজ বসু সাহিত্য জগৎ থেকে নির্বাসিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলি আটটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলো হলো সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনাধর্মী, গ্রামীণ জীবনধর্মী, শিক্ষামূলক, চোর কাহিনী, অতি প্রাকৃতিক ও রোমাঞ্চ উপন্যাস। এছাড়াও তার গল্পগ্রন্থ, ভ্রমণ কাহিনী ও কবিতা তাঁকে অনন্য সাহিত্য স্রষ্টা মর্যাদার দাবী রাখে। সাহিত্যের অনেক গলি পথে তার পদচারণ থাকলেও আমরা মনোজ বসুকে যথার্থই পাই তাঁর গ্রাম, গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি রচনার মধ্যে।
মনোজ বসুর জন্ম যশোরের কেশবপুর উপজেলার ৭ নং পাঁজিয়া ইউনিয়নের অজ পাড়াগাঁ ডোঙাঘাটা গ্রামের বসু পরিবারে। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই, বাংলা ১৩০৮ সনের ৯ শ্রাবণ মাতা বিধুমুখি বসুর কোল আলো করে এই ধরাধামে তাঁর আগমন। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র তিনি পৈত্রিক সূত্রে পান। পিতা রামলাল বসু ও পিতামহ ঈশ্বরচন্দ্র বসুসহ পরিবারের অনেকেই সাহিত্য চর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা জীবন শুরু করেন, পরে পাঁজিয়া হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯১৯ সালে এখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এ সময় তিনি রাজনীতির সংগে জড়িয়ে যান। ১৯২২ সালে তিনি বাগেরহাট কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। কলকাতায় ফিরে সাউথ সাব-আরবান কলেজে বিএ পড়েন এবং ১৯২৪ সালে বি এ পাশের মাধ্যমে শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন।
কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষাকতার মাধ্যমে। এই পেশায় তিনি বিশ বছর নিয়োজিত ছিলেন। পরে বেঙ্গল পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী হিসেবে জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কর্ম জীবনে ব্যক্তিগত কাজের পাশাপাশি বীরভূমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্তের সংস্পর্শে এসে “পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতি”র যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে সারা বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তর চষে বেড়িয়েছেন। এ কাজের মাধ্যমে তিনি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ও ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ কাব্য গ্রন্থের স্রষ্টা গ্রাম বাংলার দরদী ও মরমী কবি জসিম উদ্দীন কে। সোজন-দুলি ও রোপাই-সাজুকে নিয়ে গ্রাম বাংলা, নদী-নালা, খাল-বিল-হাওর ও বন-বনানির পটভূমিতে রচিত কাব্য দু’খানা তাঁর মানস পটে ছিল উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায়। তারই আলোতে অবগাহন করেছেন মনোজ বসু। পরবর্তীকালে গ্রামীণ সাহিত্যের প্রতি মনোজ বসুর যে ভালবাসার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর ভিত্তিভূমি ছিল ওই কাব্যদ্বয়। কবি জসিম উদ্দিনের সংস্পর্শে এসে এবং পল্লী সম্পদ রক্ষা সমিতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁর শৈশব-কৈশরের স্মৃতিপটে থাকা দৃশ্যকে তিনি হৃদয়পটে আর একবার গেঁথে নিলেন। এমনিতেই গ্রামের অজপাঁড়া গাঁ, তারসাথে বিল ধারে বাড়ি; ছোট বেলা থেকে গ্রাম-খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়, বন-বনানী, মেঠপথ, ঘাসফুল ছিল তাঁর নিত্য দিনের সাথী। জীবন-জীবিকার তাগিদে শহরে জীবনযাপন করলেও তাঁর অন্তর জুড়ে ছিল গ্রাম বাংলার সবুজ প্রকৃতি। গ্রাম ও প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে মনোজ বসুকে খুঁজতে গেলে যে মনোজ বসুকে পাওয়া যাবে- তা হলো অস্থিমজ্জাহীন কঙ্কালসার মূর্তি। মনোজ বসু নিজেই বলেছেন ,‘কলকাতায় থাকি, শহর রাজ্যের ভিতর অহরহ গ্রাম আবিষ্ট করে রাখে।’
বাংলার নদ-নদী, মাটি ও মানুষের জীবনের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকার জন্য ‘সেই গ্রাম সেই সব মানুষ’, ‘বন কেটে বসত’ ও ‘জলজঙ্গল’ উপন্যাসের চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অরণ্য প্রকৃতির সংগে অফুরান্ত প্রাণ প্রাচুর্য্যে ভরা বাদার মানুষের জীবন। লক্ষ্মীর ভান্ডের সংগে স্বাপদ-সংকুল জীবনাশ্রয়ী মানুষের জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই জীবন-জীবিকার খোঁজে শহর পানে ছোটাকে মনোজ বসু সমর্থন করেননি। ‘বন কেটে বসত’ উপন্যাসে মনোহর ডাক্তারকে বলতে শুনি, “শহর আর শহর-ওইতো মরণ হয়েছে মানুষের। ঝাঁকে ঝাঁকে শহরে এসে মরবে আলোর পোকার মতন। বলি আছে কি শহরে ?” শহরকে বাদ দিয়ে গ্রাম-বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তরে অফুরান্ত সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণের অভাবের দারিদ্রের পদধ্বনি শোনা যায়। তাই শহরমুখী না হয়ে প্রকৃতির নিবিড় কোল সুন্দরবন তথা বাদা অঞ্চলে অফুরান্ত সম্পদের দিকে ধাবিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই উপন্যাসে প্রকৃতির সন্তান জগন্নাথ গগন বাবুকে বলেছেন ,“খুটোয় বাঁধা গরু তোমরা। ভিটে বেড় দিয়ে চক্কোর মার। আরে বেরিয়েছ তো আবার কেন সেই খোপে ফিরবে? ডাঙ্গা রাজ্যে মানুষ কিলবিল করে। জায়গা জমি টাকা পয়সা সকলে বাটোয়ারা করে নিয়েছে। বুদ্ধি শোন বড়দা, ডাঙ্গার দেশ নয়- ভাঁটি ধরে তরতর করে নেমে যাবে গাজীর নাম নিয়ে। কত বড় দুনিয়া। মানুষ জন এখনও সেদিকে জমাতে পারেনি-তুমি গেলে তুমিও দিব্যি জমিয়ে নেবে।” এ উপন্যাসে গ্রাম বাংলার তৎকালীন অভাবগ্রস্ত মানুষের ভাগ্যান্বেষণে সুন্দরবনকে সম্বল করে বেঁচে থাকার তীব্র প্রয়াস লক্ষণীয়। অসংখ্য দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে নদী ও বাদা অঞ্চলে সম্পদ আরোহন করতে গিয়ে যে সকল প্রতিবন্ধকতা ও কিংবদন্তী অতি প্রাকৃতিক কল্পকাহিনী তিনি লোকমুখে শুনেছেন, নিজে দেখেছেন তার আলোকে রচিত কাহিনীকে তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি গ্রাম ও গ্রাম্য জীবন তুলে ধরেছেন। স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন হয়েছে। এটা বুঝেও সজ্ঞানে তিনি তার ভিতরকার দিকটাই প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘ছবি আর ছবি’ উপন্যাসে লেখক নিজে অনন্ত হয়ে নিজ স্মৃতির গহনে পায়চারি করে নির্বাসনের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছেন। অনন্ত এক জায়গায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “হায়রে হায়, এই সুতিঘাটার গল্প আবার আমায় নতুন করে লিখতে হলো।” এইতো সেদিন ‘কান্নার গাড়ি’ সে গল্পের নাম নজরে পড়েছে। কান্নার গাড়ি মনোজ বসুর রচনা। এখানে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ উপন্যাসের ইঙ্গিত বহন করে। ‘ছবি আর ছবি’ উপন্যাসের নায়ক অনন্তের বাড়িও ডোঙ্গাঘাটা গ্রামে।
সুদূর অতীত থেকে অদ্যবধি গ্রামাঞ্চলে চৌর্যবৃত্তি নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে শোনা যায়। সেই সব গল্প কাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেছে মনোজ বসুর নিশিকুটুম্ব‘র সাহেব। চোরকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে লেখক সাহেবের ভিতর যে মানবিকতার খোঁজ পেয়েছেন, তারও জন্ম গ্রাম বাংলায়। লেখক বলেছেন, “অমৃত্বের বেটাবেটি সব, ভাল না হয়ে উপায় আছে?”। লেখক সাহেবের গুরু ভক্তির সাথে মানবিকতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় রচিত উপন্যাসে লেখক অদূরদর্শী রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ফলে যে সকল হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়েছে, তাদের একজন হয়ে তিনি হাঁড়ে হাঁড়ে তা উপলব্ধি করেছেন। জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টান তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেছেন। নিজদেশে পরবাসি হওয়ার কঠিন কষ্ট তাকে সারাক্ষণ কুরে কুরে খেত। শৈশব-কৈশরের নিজ বাড়ি, নিজ গ্রাম, নিজদেশ তাকে সারাক্ষণ ছায়ার মত অনুসরণ করত। চেনা গ্রাম ও চেনা মানুষগুলোর মুখ সারাক্ষণ মনোজ বসুকে ঘিরে রাখতো। তাই তিনি বলেছেন-“বাল্য ও কৈশরটা আবার একটু যদি নাগালের মধ্যে পাই, আঁকড়ে ধরি বুকের উপর-ছেড়ে যেতে দেইনা। কত ভালবাসার ধন, এবারে মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি। শুধু মাত্র মানুষগুলো নয়- গাছপালা, গরু-বাছুর, খাল-বিল, সুখ-দুঃখ আশা উল্লাসে ভরা আমার সেকালের গ্রাম, আর সমস্ত অঞ্চলটা। কোন গাছের ডালটা কোন দিকে, তাও সঠিকভাবে বলে দিতে পারতাম। চোখ বুজে ভাবলে আজও বোধ হয় পারি।” লেখকের এই উক্তির মধ্যেই তাঁর মানস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
শুধু উপন্যাস সাহিত্যেই নয়, মনোজ বসুর কবিতা ও স্মৃতিচারণেও তারঁ মনোভাব সুস্পষ্ট। নিজের স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে তিনি অপকটে বলেছেন- “বাল্যকাল থেকে দারিদ্রের সংগে সংগ্রাম করেছি। নিজেকে একজন সংগ্রামী মানুষ ভাবতে এই বার্ধক্যেও ভাল লাগে। বলতে লজ্জা নেই, খুব গরীব ছিলাম আমরা। অভাব এবং দুর্ভাগ্যের ভেতরে কেটেছে বহুকাল। বাবা মায়ের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আমি। বাবা মারা গেছেন আট বছর বয়সে। বাবার মুখখানাও ভাল মনে পড়েনা। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবার গায়ের রং ছিল ফর্সা, মাথায় টাক, লম্বা-চওড়া দশাসই মানুষ। বাবার রং আমি পাইনি, তবে টাক পেয়েছি। আর লম্বাও হয়েছি। গ্রামের পাঠশালায় পড়ার সময় বাবা মারা যান। বাবার স্মৃতি ঝাপসা; তবুও কিছু কিছু মনে পড়ে। আত্মস্মৃতিমূলক বহু রচনাতে সেকথা বহু ভাবে লিখেছি।” লেখকের নিজ স্মৃতিতে গ্রাম বাংলা ও মাটি মানুষ উঠে এসেছে।
কসবারপথ, নাগরঘোপ, মীর্জানগর, কেশবপুর, মনিরামপুর হাট, পাঁজিয়ার নূতন বাড়ি, পুরাতন বাড়ি, কানাপুকুর, কাজেম গুরুর পাঠশালা, আসাননগর বিল, কোনাখোলা, মনোহরপুর, আটঘরা, হাসাডাঙ্গা, গড়ভাঙ্গা, মাদারডাঙ্গা, বেলকাটি ফকির বাড়ি, কানাইডাঙ্গা প্রভৃতি জনপদ। মনোজ বসুর ‘সেই গ্রাম সেই সব মানুষ’ গ্রন্থে গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি একান্নবর্তী পরিবারের পারিবারিক বন্ধনের সাথে লোকাচার, সমাজ-সামাজিকতা, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্ম-কর্মাদি তুলে ধরে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে সকল ধর্ম-কর্মের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায়ও অভাবি খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। অভাবি কৃষকের বেঁচে থাকার সম্বল গাভীগুলি বিক্রি করার পর হৃদয়ের আহাজারী লেখককে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সেই কৃষকের জবানীতে বলেছেন,
‘গেল বছর চৈত মাসেতে তিনটে বেচলাম গাই
গোয়াল কাঁন্দে ডাক ছাইড়ারে
তিনটি দিন আর গোয়াল পানে নজর তুলি নাই।’
এছাড়া ‘পাটের ক্ষেতের মায়া’, ‘গোপন কথা’, ‘কনে ডিঙ্গায় উঠলো’, ‘এসো রূপবতী’ প্রভৃতি কবিতায় শাশ্বত গ্রাম বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে তিনি এভাবে বলেছেন-
‘কনে কাঁদিতেছে, গালে জলধারা, রক্তের মতো উহাও লাল
কুলেতে সানাই কাঁদিয়া কাঁদিয়া আকুলিয়া তোলে সারা সকাল’।
পরিশেষে তাঁর সমগ্র সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে মনে হয় তিনি কবি বা সাহিত্যিক হতে চাননি; বরং তাঁর সমগ্র জীবনযাত্রার পরতে পরতে সংগৃহিত সমগ্র উপলব্ধি, অনুভূতি ছবির মত ধারণ করে পাঠকের কাছে অকৃত্রিমভাবে তুলে দিয়েছেন। এই মহান কর্ম করতে সাহিত্যের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণে উপন্যাস বা গল্পের মান কোথাও ক্ষুন্ন হয়েছে। চরিত্রসজ্জা কাঠামোও বিঘ্নিত হয়েছে, আবার কখনও কখনও প্রকৃতি, বন-বনানী, গাছপালা, নদী-নালা, খাল-বিল মূখ্য চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে। লেখক অবচেতন মনে বার বার ফিরে গেছেন শেকড়ের সন্ধানে। গ্রামের মাটিও সহজ-সরল মানুষ উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টির উপজীব্য হয়ে। লেখকের পুরো জীবনটাই তিনি ভিডিও ফুটেজের মত পাঠকের কাছে অমীয় বার্তা হিসেবে পৌঁছে দিয়েছেন। এখানেই আমাদের ঋণ; আমাদের সাহিত্যিক মন দায়বন্ধ তাঁর অমর কর্মের কাছে।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
পাঁজিয়া, কেশবপুর, যশোর, বাংলাদেশ ।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
মসজিদের দক্ষিণপাশের মসজিদ সংলগ্ন প্রায় বিঘা খানেক জমির উপর প্রাচীর ঘেরা জমিদারদের পারিবারিক কবরস্থান। এখানে জমিদারদের কবর আছে কিন্তু পাঁকা করা হয়নি। এমনকি জমিদার আহাদ আলী সরদারের কবরও সুনির্দিষ্ট করে তার বংশধরদের পক্ষেও বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর সময়টাও জানা যায়নি। তবে আহাদ আলী সরদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুন্সি মোবারক আলী সরদার ইন্তেকাল করেন ১৯৫০ সালে। তার কবরের স্থানটি চারটি জমানো পিলার চার কোনায় গেড়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। মুন্সি মোবারক সরদারের পুত্র মজিদুল ইসলাম সরদারের (বুলু ও বাকার ভাই এর পিতা) কবর আমেরিকার নিউ জার্সিতে। তিনি ইন্তেকাল করেন ১২ জুলাই ১৯৯১ সালে। মসজিদের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে দুইটি কবরের জায়গা পাঁকা করে রাখা আছে। খোঁজ নিতেই বুলু ভাই জানালেন, “তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই ইন্তেকাল করুণ না কেন, তার শেষ ইচ্ছা তিনি পিতৃভূমির ওই নির্দিষ্ট স্থানে চিরদিন থাকতে চান। তাই কবরের স্থানটি নির্ধারণ করে রেখেছেন”। প্রাচীর ঘেরা কবরস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে মণিরামপুরের সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতানের বাঁধানো পাঁকা কবর। সেখানে লেখা আছে, জন্ম -১৩ ডিসেম্বর ১৯৫০ সাল, মৃত্যু- ১৯ আগষ্ট ২০১৭ খ্রিঃ।
“জমিদার” শব্দের আভিধানিক অর্থ “ভূস্বামী”। যে ভূস্বামীকে খাজনা বা কর দিতে হয়। পারিভাষিক অর্থ হল- দেশের শাসক শ্রেণী তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী জনগণের উপর আরোপিত কর বা খাজনা, উপঢৌকন ও আনুগত্য আদায়ের জন্য মধ্যেসত্ত্বভোগী একটি শ্রেণী সৃষ্টি করেন; ওই শ্রেণীর উপাধি ‘জমিদার’। জমিদারকে আঞ্চলিক শাসকও বলা হয়ে থাকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, অধিকাংশ জমিদার তাদের প্রজাদের উপর নিপীড়ন করেছেন। তারা প্রজাদের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর রাখতেন না। যে সকল জমিদার প্রজাপালনে মনোযোগী ছিলেন, তারা তাদের প্রজাগণের মনে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে রয়েছেন। এমনই ব্যতিক্রমী জমিদার ছিলেন ধামালিয়া সরদার বাড়ির জমিদারগণ। আমাদের দেশের(বাংলার) জমিদারদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে কিছুটা পিছনে ফিরে যেতে হবে।
ধামালিয়া জমিদারদের ইতিহাস
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন আফগান শাসক সোলেমান খাঁ কররানী। তিনি দিল্লীর সম্রাট আকবরকে যৎ সামান্য কর ও উপঢৌকন দিয়ে আনুগত্য স্বীকার করে নির্বিঘ্নে রাজ্য শাসন করতেন। সোলেমান খাঁ কররানীর মৃত্যুর পর তার পুত্র দাউদ খাঁ কররানী বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অদূরদর্শী শাসক। মুঘলদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারনা তার ছিল না। সম্রাট আকবর যখন গুজরাট অধিকারের জন্য যুদ্ধ অভিযান করছিলেন, ঠিক তখনই দাউদ খাঁ কররানী আকস্মিক মুঘলদের পূর্বাঞ্চলিয় যামানিয়া দূর্গ আক্রমণ করে দখল করেন এবং মুঘল কর্তৃত্ব অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সংবাদ দ্রুত সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছালে সম্রাট আকবর ক্রুব্ধ হন। গুজরাট জয়ের পর সম্রাট আকবর বাংলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং দাউদ খাঁ কররানীর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। কয়েকস্থানে খন্ড যুদ্ধের পর রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খাঁ কররানী পরাজিত ও নিহত হন। বাংলা মুঘলদের শাসনাধীনে চলে আসে। এরপরও বাংলার বার ভূঁইয়ারা দীর্ঘদিন প্রায় স্বাধীনভাবে জমিদারী পরিচালনা করেও একে একে মুঘল বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। তৎকালীন সময়ে বাংলায় ছোট-বড় অনেক জমিদার শ্রেণী গড়ে উঠে। ওই সকল জমিদারেরা অঞ্চল ভিত্তিতে পত্তনী নিত। সৃষ্টি হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদার, গাতীদার শ্রেণীর। যারা কর-খাজনার বিনিময়ে স্ব-স্ব এলাকায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন।
১৭০০ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার প্রথম দেওয়ান নিযুক্ত হয়ে আসেন। পরে ১৭১৩ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার নায়েব সুবেদার নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন আদর্শবান সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাবাদর্শের মানুষ। দীর্ঘদিন রাজস্ব বিভাগের গুরুদায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। ১৭১৪ সালে ভূষনার জমিদার সীতারাম স্বাধীনভাবে জমিদারী পরিচালনার চেষ্টা করেন। মুর্শিদ কুলি খাঁ তাকে পরাজিত ও নিহত করেন। ধারনা করা হয়, তার সময় পূর্ব বাংলার অনেক জমিদারের জমিদারীর গোড়াপত্তন হয়। নবাবের প্রিয়ভাজন রঘুনন্দন নাটোর অঞ্চলের জমিদারী লাভ করেন। ভূষনার জমিদারীর অনেকাংশই লাভ করেন রামজীবন। একইভাবে দক্ষিণবঙ্গেও অনেক হিন্দু জমিদার জমিদারী লাভ করেন। পরে ইংরেজ শাসনামল পর্যন্ত তাদের জমিদারী কাল প্রলম্বিত হয়। জানা যায়, পাঁজিয়ার জমিদার দেওয়ান রুক্নিনী কান্ত বসু ও রাজা পরশনাথ বসু নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর দেওয়ান ছিলেন। বিভিন্ন তথ্য থেকে ধারনা করা যায়- ধামালিয়ার জমিদারদের জমিদারীও প্রায় সমসাময়িক। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ধামালিয়া জমিদারদের জমিদারির সময়কাল অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে বিংশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত। ডুমুরিয়ার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্যমতে ‘ নয় পুরুষের প্রতিষ্ঠিত এই বংশের প্রথম পুরুষ বাবর সরদার। পরবর্তী বংশধরেরা হলেন- ওসমান, বাহাদুর ও চিকন মাহামুদ। প্রাপ্ত তথ্যে এদের নাম থাকলেও তাদের কর্মকাণ্ডের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। যতদূর জানা যায়, মুন্সী ভিকন আলী সরদার জমিদার হিসেবে প্রথম জমিদারীর গোড়াপত্তন করেন। অপর একটি সূত্র অনুসারে পাঁজিয়ার দেওয়ান রুক্নিনী কান্ত বসুর কাছ থেকে মুন্সি ভিকন আলী সরদার জমিদারীর পত্তনী কেনেন। দেওয়ান রুক্নিনী কান্ত বসু চেঙ্গুটিয়া স্টেটের জমিদার ছিলেন। এছাড়া কলিকাতার জিতেন সেনের কাজ থেকে মুন্সি ভিকন আলী সরদার আরও একটা পত্তনী কেনেন। সরদারদের জমিদারি ছিল-ধামালিয়া, বরুনা, কৃষ্ণনগর, রঘুনাথপুর, দেড়ুলি, মৌখালি ও বিল খুকশিয়ার অংশবিশেষ।
মুন্সি ভিকন আলীর পুত্র আহাদ আলী সরদারের সময় তাদের জমিদারীর প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এলাকায় কিংবদন্তী আছে, ধামালিয়ার সরদারদের চারো বা গুন্সি’তে (মাছ ধরার যন্ত্র বিশেষ) টাকা বাঁধতো। অনুসন্ধানে জানা যায়, মুন্সী ভিকন আলী সরদার ও তাঁর পুত্র আহাদ আলী সরদার জমিদারীর পাশাপাশি ব্যাবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী হন।
তাদের আট-দশ খানা বড় ব্যবসায়িক পদী নৌকা ছিল। নদী পথে সুন্দরবনের সুন্দরী, শাল, সেগুন, গেওয়া, গরান, গোলপাতা ও মধুসহ সুন্দরবনের আরোহিত সম্পদ কলকাতায় নিয়ে বিক্রি করতেন। বরুনা বাজার হতে হরিহর ও কপোতাক্ষ নদের মাধ্যমে ঝিকরগাছা পথে এগুলো চলাচল করতো। নদীপথে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বাজারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। নৌ- ব্যবসার মাধ্যমে তাঁরা প্রচুর লাভবান হতেন। এছাড়া কলকাতায় তাদের ইটের ভাটা ও ঠিকাদারী ব্যবসা জমজমাট ছিল। কলকাতার নারিকেল ডাঙ্গায় ৩০ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ‘মুন্সীবাজার’ সরদারদের প্রতিষ্ঠিত ও নিজস্ব সম্পত্তি। এখানে তাদের বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। ওই সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের এত বিপুল পরিমাণ অর্থের আগমন ঘটতো যে কারণে সাধারণ মানুষ মনে করতেন- “ধামালিয়ার জমিদাররা চারো পাতলেও টাকা বাঁধে”। আসলে কথাটা কিংবদন্তী। কালক্রমে এটা প্রবাদ বাক্য হয়ে যায়। আহাদ সরদার একাধিক বার গুপ্তধন পেয়েছেন বলে এলাকায় এখনও জনশ্রুতি আছে। ফলে অন্যান্য জমিদারদের ন্যায় তাঁর জমিদারি থেকে জোর-জুলুম বা প্রজা পীড়নের অভিযোগ শোনা যায় না। বরং ধামালিয়া জমিদারদের এলাকায় জনকল্যাণমূলক কাজের কথা জানা যায়। পাশাপাশি পুরাতন ভবণের উত্তর পাশে দুটি হাজত ঘর এখনও বিদ্যমান। যেটা অবাধ্য প্রজাদের শাস্তির ব্যবস্থা বলে ধারণা করা যায়।
ধামালিয়া জমিদারদের জনকল্যানমূলক কাজ ছিল প্রশংসনীয়। এই কাজের মধ্যে জনসাধারণের চলাচলের জন্য রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, যার মধ্যে ভোলাপোতা রাস্তাটি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে এই রাস্তাটি ফুলতলা ও অভয়নগর উপজেলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক। পানীয় জলের কষ্ট নিবারনের জন্য তাঁরা পুকুর-দিঘী খনন করেন। ডুমুরিয়া উপজেলার পাকুড়িয়াতে ৩ একর জমির উপর বিরাট দিঘী খননসহ বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করেন। লেখাপড়া শেখার জন্য মক্তব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সহায়তা প্রদান করেন। এর মধ্যে রঘুনাথপুর ও রুদাঘরা মিকশিমিল হাইস্কুল অন্যতম। জমিদাররা ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। মসজিদের সংগে মক্তব বিদ্যমান ছিল। মক্তবে আরবি ও ফার্সি শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। বাড়িতে দলিজ ঘর (বৈঠক খানা) ছিল। সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর দূর-দুরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হতো। এমন কথাও শোনা যায়, কখনও কখনও শুক্রবারে দুর-দুরান্ত থেকে আগত মুসল্লিদের খাসি জবাই করেও খাওয়ানো হতো। জমিদার বাড়িতে ইসলামি পরিবেশ বিরাজিত ছিল।
জমিদারবাড়ির বর্ণনা
ধামালিয়া মূল জমিদার বাড়িটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশটি দক্ষিণ দূয়ারি, ছয় কক্ষ বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন। পিছনের অংশ দিয়ে সিড়ি দ্বিতলে উঠে গেছে । দ্বিতল ভবনের ছাঁদে যাওয়ার জন্য কোন সিঁড়ি ছিল না। এই দ্বিতল ভবনের পূর্ব পাশের ঘরে একটা নক্সাকরা পালঙ্ক ও একটি কাঠের সিন্দুক আজও পড়ে আছে। বাকী অংশটা ভগ্নপ্রায়। দ্বিতল ভবনের ছাঁদবিহীন খিলানের ভগ্ন দেওয়ালগুলি বাড়িটির পূর্বের গৌরবময় দিনের কথা দর্শনার্থীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
দ্বিতল ভবনের নিচ তলায় উত্তরপাশ সংলগ্ন আরও অনেকগুলি ঘরের অবয়ব লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে দুইটি হাজত ঘর, রন্ধন শালা, হল ঘর, মালামাল সংরক্ষণ ঘর, পালকি ঘর ও কর্মচারিদের থাকার ঘর। ভগ্ন ভবনের পূর্ব পাশের খোলা আঙ্গিনা রয়েছে। জমিদার বংশের লোকেরা দ্বিতলে বসবাস করতো। পারিবারিক লোকসংখ্যা বেশী হওয়ার কারণে পশ্চিম পাশের দ্বিতীয় ভবনটি করা হয়। জমিদার আহাদ আলী সরদার এই ভবনের প্রতিষ্ঠাতা। এই ভবনটি পূর্ব ও দক্ষিণ দূয়ারি। ভবনটি সংস্কার করে মুন্সি মোবারক আলী সরদারের বংশধররা এখানে বসবাস করেন। এই বংশের কৃতি সন্তান ডঃ শামসুল করিম বাকার, মোঃ মাশরুখ হাসান, মোঃ মনিরুল ইসলাম ও বাশারুজ্জামান (পিতাঃ মাজিদুল ইসলাম সরদার) বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসি। সেখানে তারা সফল শিল্পপতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারাও মাঝে মাঝে দেশে আসেন এবং তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুযায়ী এলাকায় তাদের অবদান রেখে চলেছেন। দেশে এসে পশ্চিম পাশের ভবনেই অবস্থান করেন।
দেশের সকল জমিদারগণ তাদের ঐতিহ্য প্রকাশের জন্য জমিদার বাড়ি সংলগ্ন বা অনতি দূরে মসজিদ বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করতেন। ধামালিয়া জমিদারও তাদের বাড়ি সংলগ্ন তিন গম্বুজবিশিষ্ট একতলা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত ছিল। মসজিদের গায়ে খোদাই করা স্থাপিত- ১৭১৭ খৃঃ, পুনঃনির্মাণ ২০০৫ খৃঃ। পুনঃনির্মাণের সময় মসজিদটি দ্বিতলে সম্প্রসারিত করা হয়। বর্তমানে দুই ভবনের সাথে মসজিদের উত্তর দেওয়ালটি মিশে আছে। পূর্বে এমনটি ছিল না। পূর্ব পাশের দ্বিতল ভবন ও মসজিদের মাঝে সামান্য ফাঁক ছিল। যে পথ দিয়ে একজন মানুষ চলাচল করতে পারতো। পুনঃনির্মানের সময় উত্তর দিকে কিছুটা সম্প্রসারিত হয়ে আবাসিক ভবনের সাথে প্রায় মিশে যায়। মসজিদের বর্ধিত অংশে পূর্বে মহিলারা নামাজ পড়লেও বর্তমানে পড়েনা। ওই অংশে এখন কুরআন শিক্ষা ও তালিমের কাজটি করা হয়ে থাকে।
জমিদার বাড়ির উত্তর-পশ্চিম পাশের, পূর্ব-পশ্চিম লম্বা ও উভয় পাশের বিরাট সান বাঁধানো ঘাটের গভীরতম বড় একটা পুকুর আছে। ওই পুকুরের তলা বাদে চার পাশ ইট দিয়ে বাঁধানো। যা এখনও দৃশ্যমান। পুকরটি নিয়েও কিংবদন্তী আছে। অনেকে ভয়ে এই পুকুরে গোসল করতো না। গভীর পুকুর খননের পরও পুকুরে পানি না উঠায় নদীর সংগে সংযোগ করা হয়। যতদূর জানা যায়, পুকুরের পূর্ব ঘাট মেয়ে ও বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা এবং পশ্চিম ঘাট পুরুষরা ব্যবহার করতো। ২০০২ সালে পুকুরের পাড়ে লিটন ফ্লাওয়ার কিণ্ডার গার্ডেন ও শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জমিদারদের কাছারী ঘর ও বিচারালয় ছিল জমিদার বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে বরুনা বাজারে। সেখান থেকে জমিদাররা তাদের জমিদারী পরিচালনা করতেন। বিচারের জন্য বিচার কার্যালয় ছিল। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত এখানে শরিয়তি আইনে বিচার ব্যবস্থা টিকে ছিল। এছাড়া জমিদারদের ব্যবসা-বাণিজ্যও এখান থেকে পরিচালিত হতো। বরুনা বাজারে নৌবন্দর ছিল। জমিদারদের দ্বি-তল কাছারি ঘর ছিল।
মুন্সি মোবারক আলী সরদারের তিনজন স্ত্রী ছিলেন। জমিদারবাড়ির তথ্য প্রদানকারী মোঃ মাশরুখ হাসান সরদারের (বুলুভাই) দাদা মোবারক আলী সরদারের দ্বিতীয় স্ত্রী তার আপন দাদী। তিনি ছিলেন নন-বেঙ্গলি, বিহারী। বুলুভাই প্রদত্ত তথ্যসমূহ তার নিজের দাদী ও ছোট দাদীর মুখ থেকে শোনা এবং তার নিজের চোখে দেখা।
মুন্সি মোবারক আলী সরদারের সময় উষারাণী নামে এক পরমা সুন্দরী মহিলাকে কলিকাতা থেকে এনে কাছারী ঘরের দ্বিতলে রাখেন। উষারাণী কলিকাতার জনৈক ব্যারিস্টারের স্ত্রী। তার দুটি ছেলে সন্তানও ছিল। মামলা-মকদ্দমার সূত্রে মোবারক আলী সরদারের সাথে ব্যারিস্টারের পরিচয় ঘটে। পরে ব্যারিস্টারের সাথে সুসম্পর্কের মধ্যে দিয়ে তার স্ত্রীর সাথে মোবারক আলীর ঘনিষ্ঠতা হয়। মোবারক আলী ও উষারাণীর ঘনিষ্ঠতা এমনই এক পর্যায় পৌঁছায় যে; উষারাণী স্বামী, সন্তান ও সংসারের মায়া ত্যাগ করে অতি সংগোপনে মোবারক আলীর লোকজনের সঙ্গে ধামালিয়ায় চলে আসেন। ধামালিয়া জমিদার বাড়ীতে ইসলামি মূল্যবোধের কারণে মোবারক আলী উষারাণীকে বাড়িতে তুলতে সাহস করেননি। উষারাণীকে কাছারি ঘরের দ্বিতীয় তলায় থাকার ব্যবস্থা করেন। উষারাণীকে আরাম-আয়েসে রাখার জন্য মোবারক আলী সরদার অনেক অর্থ ব্যয় করতেন। তার স্নানের জন্য কাছারী পাশে একটি পুকুর খনন করেন এবং পুকুর থেকে দ্বিতল পর্যন্ত সিঁড়ি তৈরী করে দেন। পুকুরটিকে এলাকার লোকে উষারাণীর পুকুর বলতেন।
বর্তমানে পুকুরটি ভরাট করে সেখানে ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মিত হয়েছে। ধামালিয়া এলাকায় উষারাণীর নামে কবিতা এখনও লোকমুখে শোনা যায়। ডুমুরিয়ার ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত উষারাণীকে নর্তকী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা মোবারক আলীর পৌত্র মোঃ মাশরুখ হাসান দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখান করেন। তিনি আরও জানান, তিনি তার ছোট দাদীর মুখেই ঘটনার বিবরণ জেনেছেন। প্রায় ৫/৬ মাস অনুসন্ধানের পর ব্যারিস্টার মহাশয় জানতে পারেন, তার স্ত্রী মোবারক আলী সরদারের তত্ত্বাবধানে আছেন। ব্যারিষ্টার তার স্ত্রীকে ফেরত পাওয়া ও মোবারক আলীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আদালতে মোবারক সরদারের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা রজ্জু করেন। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর আপস মিমাংসার মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি হয়। ছয়মাস থেকে এক বছর পর উষারাণীও ধামালিয়া জীবনের ইতি টেনে স্বামীর ঘরে ফিরে যান।
গ্রামে একটা প্রবাদ চালু আছে, জাহাজ চলে যাওয়ার পর নদীর পানি উথাল-পাথাল করে নদীর পাড় ভাংগে। তেমনি উষারাণী চলে যাওয়ার পর ধামালিয়া জমিদার বাড়ীতে যে ধাক্কা লাগে তা কেটে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। উষারাণীর মামলার কারণে জমিদার মোবারক আলী সরদারের অপূরণীয় অর্থ ক্ষতি হয়। জমিদারীর তদারকিতেও যথেষ্ঠ গাফিলতি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভাঁটা পড়ে। ফলে অচিরেই মোবারক আলী অর্থকষ্টে নিপতিত হন। জমিদারীর বিভিন্ন তৌজিতে খাজনা বাকী পড়ে। কোথাও কোথাও সম্পত্তি নিলামে উঠে।
১৭৭২ সালে ওয়ারেন্ট হেস্টিংস কোম্পানির আয় বৃদ্ধির জন্য পাঁচশালা বন্দোবস্ত করেন। পরবর্তী সময় এই ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। লর্ড কর্ণওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় দশশালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী ঘোষণা দিয়ে বাৎসরিক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনার ভিত্তিতে জমিদারগণকে জমির স্থায়ী মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এরপর বৃটিশ সরকার জমিজমা সংক্রান্ত যশোর গেজেট প্রকাশ করে। ১৯২৫ সালে আহাদ আলী সরদারের ৫৭ তৌজি খরিদ করেন আব্দুল মাহামুদ, পিতা মৃত- মারিফুল হক, ১৫ নং চেতল হাট রোড, কলিকাতা। এই খরিদের ফলে মণিরামপুর ও ডুমুরিয়ার কিছু সম্পত্তি সরদারদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ইতিপূর্বে জমিদারীর কিছু অংশ ৪৯ নং তৌজির শ্যামনাথ চ্যাটার্জীর আওতাভুক্ত হয়। তবে কি কারণে শ্যামনাথ চ্যাটার্জীর হস্তগত হয়, তা জানা যায়নি। আর্থিক অনটনের সময় জমিদারী ওয়ারেশদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। ১৯২৭ সালে ধামালিয়া জমিদারদের বিভিন্ন ওয়ারিশের সম্পত্তি নিলামে উঠলে ফুলতলার যুগনিপাশা গ্রামের মোল্যা মোঃ এহিয়া খরিদ করে। পরে ১৯২৯ সালে ওই সম্পত্তি কলকাতার চেতল হাট রোডের সেই আব্দুল মাহামুদই খরিদ করেন।
শ্যামনাথ চ্যাটার্জীর সম্পত্তির অংশে নিয়মিত কর পরিশোধ না করায় নিলামে উঠলে ফুলতলা থানার পয়গ্রাম কসবা গ্রামের কাজীবাড়ির কাজী গোলাম নবী ১৯৩৬ সালে নিলাম খরিদ করেন। এই নিলামের বিরুদ্ধে ১৯৩৭ সালে মোবারেক আলী সরদার ও আব্দুল কাদের সরদার দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করেন। এই মোকাদ্দমায় মোবারক আলী সরদার ও আব্দুল কাদের সরদারের বিরুদ্ধে সাব- জজ কোর্ট রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মোবারক আলী সরদাররা ১৯৩৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন। এই সময় উভয় পক্ষ বিরোধের কারণে উক্ত সম্পত্তির খাজনা বাকী পড়ায় আবারও নিলামে ওঠে। এ সময় কাজী গোলাম নবী নিজ নামে খরিদ না করে জনৈক মৌলবি মফিজ উদ্দীনের নামে বেনামে খরিদ করেন। অতঃপর সরদারদিগরের পক্ষে উক্ত নিলাম রদের পক্ষে মিস কেস দায়ের করেন। মিস কেসের ফলে নিলাম রদ হয়ে যায়। নিলাম রদের ফলে কাজী গোলাম নবীর পক্ষ হতে ১৯৩৮ সালে সিভিল রিভিশন আনীত হলে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস মিমাংসা হয়। উক্ত ছোলেনামার শর্তানুসারে মোবারক আলী সরদার ও আব্দুল কাদের সরদার ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালের মধ্যে খুলনা সাব জজ আদালতে ১৫,০০০ (পনের হাজার) টাকা জমা দিলে নিলাম রদের আদেশ বহাল থাকবে। মামলা-মোকদ্দমা চালাতে গিয়ে মোবারক আলী সরদার ও আব্দুল কাদের সরদারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। বাধ্য হয়ে তারা কলিকাতার জিতেন্দ্রনাথ সেনের কাছ থেকে ৫০০০(পাঁচ হাজার) টাকা ধার করেন। সম্মান বাঁচানোর জন্য তারা পুনঃরায় জিতেন্দ্রনাথ সেনের নিকট থেকে আরও ১৫,০০০ (পনের হাজার) টাকা পাওয়ার জন্য নিলাম রদে প্রাপ্ত সম্পত্তি জিতেন্দ্রনাথ সেনের কাছে অগ্রিম বিক্রয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করেন। সরদাররা আদালতের শর্ত মোতাবেক যথা সময়ে খুলনা সাব-জজ আদালতে ১৫,০০০(পনের হাজার) টাকা জমা দেন। একই দিনে জিতেন্দ্রনাথ সেনের নামে উক্ত সম্পত্তি কবলামূলে রেজিষ্ট্রি হয়।
১৯৪৭ সালে বৃট্রিশ ভারত স্বাধীন হয়। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। কলিকাতায় বসবাসকারী জিতেন্দ্রনাথ সেনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থিত ধামালিয়ার সম্পত্তি দেখাশুনা করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কর-খাজনা বাকী পড়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে বাকী রাজস্বের দায়ে ৪৯ নং তৌজি খাস করে নিলামে বিক্রির জন্য নোটিশ জারি করে। এই নিলামের বিরুদ্ধে সরদার বংশের কন্যা আঞ্জুমান আরা খাতুন ও তার স্বামী আব্দুল হামিদ খান নিলাম রদের জন্য আদালতে মামলা করলে ১৯৫৩ সালে নিলাম রদ হয়। আব্দুল হামিদ খান তার স্ত্রীর নামে উক্ত সম্পত্তি খরিদ করে সরদারদের ফেরত দেন। উল্লেখ্য ওই সময় ধামালিয়া জমিদারীর হাল ধরার মতো তেমন কেউ ছিল না। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বাতিল করলে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে জমিদারদের মামলা চলতে থাকে। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় জমিদার ও গাতীদারদের খাজনা আদায়ের ক্ষমতা। এরপরও কোন কোন জমিদার বা গাতীদাররা ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বকেয়া খাজনার নাম করে কিছু খাজনা আদায় করেন। ওই সময় ধামালিয়ায় আঞ্জুমান আরা খাতুনের পক্ষে কিছু কিছু খাজনা আদায় সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার তখন থেকে সকল জমির মালিকানা জমি চাষাবাদকারী কৃষকদের মধ্যে প্রদান করে। কৃষকরা জমির মালিকে পরিণত হয়। পাশাপাশি জমিদাররা তাদের বসবাস ও ভরণপোষন জন্য তাদের অধীনস্ত বিভিন্ন খাস জমির ১০০ (একশত) একর পর্যন্ত ভোগ দখলের অধিকার লাভ করে।
জমিদারী বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশের সকল জমিদারদের জৌলুস কমে য়ায়। যতটুকু জানা যায়, ধামালিয়া জমিদাররা বড় মাপের জমিদার ছিলেন না। অনেক বড় বড় জমিদারও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপরও ধামালিয়া জমিদারদের বংশধররা তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে এখনও মোটামুটি সুনামের সংগে টিকে আছে। এই বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ড. শামসুল করিম বাকার ও তার ভায়েরা আমেরিকা প্রবাসি হলেও দেশের টানে মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসেন। এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই প্রচেষ্টা তার পূর্বপুরুষের মুখ উজ্জ্বল করে। তাই আজও এলাকার লোকেরা ধামালিয়া জমিদারদের নাম শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করে।
—- ০ —-
[ বিঃ দ্রঃ ] ধামালিয়ার জমিদারদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে যে সব তথ্য বর্ণিত হলো, তা লোকমুখে শোনা ও প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। সকল বিষয়গুলি যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। যদি কারো নিকট কোন তথ্য অসংগতি মনে হয়; তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানালে সংশোধনের চেষ্টা করবো এবং কৃতজ্ঞ থাকবো।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
পাঁজিয়া, কেশবপুর, যশোর, বাংলাদেশ ।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
তথ্যসূত্রঃ
ক) বাংলাদেশের ইতিহাস – ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ডঃ আবদুল মমিন চৌধুরী, ডঃ এ বি এম মাহমুদ, ডঃ সিরাজুল ইসলাম।
খ) ডুমুরিয়ার ইতিহাস – উপাধ্যক্ষ শেখ আবদুল জলিল।
গ) মোঃ মাশরুখ হাসানের স্মৃতিচারণ (জমিদার মুন্সি মোবারক আলী সরদারের পৌত্র)।
ঘ) এলাকার বয়োবৃদ্ধদের সাক্ষাৎকার।
“নিশি কুটুম্বু” ‘নিশি’ অর্থ রাত আর ‘কুটুম্ব’ শব্দার্থ বিবাহজনিত লৌকিকতা বা আত্মীয়তা। লেখক এখানে মৃদু ব্যাঙ্গার্থে রূপক হিসেবে নামকরণ করেছেন। মনোজ সাহিত্যে গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল বিষয়গুলো দক্ষ মালির ন্যায় এক সুতায় গেঁথে সুদৃশ্য মালায় রূপ দিয়েছেন। উনবিংশ শতাব্দীতে গ্রাম বাংলায় এক সময় চোরের ব্যাপক উপদ্রব ছিল ; বিশেষকরে সিঁধেল চোরের। তাদের চৌর্যবৃত্তিকে তুলে ধরার মানসে লেখকের এই প্রায়াস।
১৯৬৭ সালে দিল্লীর সাহিত্য একাডেমিতে ‘নিশিকুটুম্ব’’ রচনা সম্পর্কে লেখক বলেন-“সমাজের আদিম পাপ দুইটি- চৌর্য আর গনিকাবৃত্তি। গনিকা নিয়ে পৃথিবীর নানা সাহিত্যে কালজয়ী সৃষ্টি রয়েছে, কিন্তু চৌর্য কর্মনিয়ে কোন বৃহৎ সৃষ্টি আমার নজরে পড়েনি। উপন্যাস লিখতে বসে কয়েকটি বৃদ্ধ চোরের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদরে অতীতের কথা শুনলাম। শুনে রোমাঞ্চ লাগে, ঘৃণ্য চৌর কর্মের মধ্যেও আশ্চর্য মানবিকতা মাঝে মাঝে তাদের জীবনে ঝলক দিয়ে গেছে। এত কালের অনাবিষ্কৃত এক আশ্চর্য জগৎ ‘নিশিকুটুম্ব’ বইয়ে সেই বিচিত্র জগতের পরিচয়। তাদের চলাচল নিশিরাতে (তাদের) অলিখিত আইন আছে, সেগুলি তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সুনিপুন কর্ম বিভাগ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা। চোরদের মত সাধু অতিশয় বিরল। সাধুতা দলের মধ্যে… কাঞ্চনলিপ্সু তারা, কিন্তু কামিনিতে অনীহা। লেখকের হাত নিসপিশ করে এমন জিনিস নিয়ে লিখতে”।
এটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়। বিশ্বসাহিত্যেও এই উপন্যাসখানি আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়েই সৃষ্ট। সকল সাহিত্যে চোর-ডাকাতের বর্ণনা দেখা যায়, তবে মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত। এটা লেখকের অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় বাস্তব চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক সমাজের নিন্দনীয় শ্রেণীপেশার মানুষের বাস্তব রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসের কুশিলবরা সিঁধেল চোর, পতিতা, পকেটমার, থলিলদার এরা সবাই সমাজের চোখে নিন্দিত ও ঘৃনিত।
শিক্ষার সংজ্ঞা কারকরা সকলেই সুশিক্ষাকে ‘শিক্ষা’ বলেছেন। এই উপন্যাসে মনোজ বসু চৌর্যবৃত্তি শিক্ষাকে ‘ শিক্ষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। আদিকাল থেকে আমাদের সমাজে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা”। সেই চুরিবিদ্যার নিশিকুটুম্ব উপন্যাসের নায়ক গনেশ ওরফে সাহেব। সাহেবের প্রশিক্ষিত হাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘গায়ের উপর মৃদু স্পর্শ। বাহুর উপর, বাহু থেকে গলায়, তারপর কোমরের দিকটায়, … চঞ্চল আঙ্গুলগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে সরীসৃপের মতন’। ঘুমন্ত যুবতী, নববধু আশালতার শরীর থেকে সুকৌশলে গহনা খুলে নিচ্ছে সাহেব চোর। গুরুর শিক্ষা কাজের সময় (চুরির সময়) যত সুন্দরী হোক না কেন , তার শ্লীলতাহানি করা যাবে না। গুরুর শিক্ষা এই ধর্মকে সাহেব বরাবর মেনে চলেছে। পঞ্চানন বাইটা (পচা বাইটা) সাহেবের চুরি বিদ্যার শ্রেষ্ঠ গুরু। তার আদেশ-নিষেধ সাহেবের কাছে অলঙ্ঘীয়। গুরুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা তার। গুরু নিন্দা তার কাছে অসহনীয়। তাই গুরুপুত্র মুকুন্দ যখন পিতার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে, সাহেব তার প্রতিবাদ করেছে। সাহেবের প্রথম গুরু স্ব-ঘোষিত পালক পিতা নফর কেষ্টা। কিন্তু চুরি বিদ্যা শিক্ষায় তার শ্রেষ্ঠ গুরু পঞ্চানন বাইটা(পচা বাইটা)।
চুরি বিদ্যায়ও কর্ম বিভাজন আছে। আছে সময়জ্ঞান, কাল প্রহর। কর্ম বিভাজন তিন স্তরে বিভক্ত। তিন স্তরে যথাযথভাবে কার্য সম্পাদন হলেই একটি সফল অভিযান সম্পন্ন হবে। এখানে কোন স্তরে ভুল হলে কাজতো সমাধান হবেই না; বরং সমূহ বিপদের সম্ভাবনা খুবই বেশী।
প্রথম স্তরঃ খুজিয়াল বা খোচড় যে বাড়িতে চুরির কাজটি সম্পাদন হবে তার যাবতীয় খোঁজ তাকে নিতে হবে। বাড়ির লোক সংখ্যা কতজন, কতজন পুরুষ, কতজন মহিলা, কয়টি বাচ্চা, বুড়ো মানুষ আছে কিনা, থাকলে কেমন অসুস্থ। রাতে কতবার ঘুম থেকে ওঠে, অন্ধকারে ভালো দেখতে পারে কি না ইত্যাদি।
দ্বিতীয় স্তরঃ ডেপুটি বা সহকারি – চুরির কাজটি যেখানে করা হবে তার আশপাশের রাস্তার খোঁজ, কোন পথ অধিক নিরাপদ, মালামাল কোন পথে সরাতে হবে, বিপদ বুঝলে কখন সংকেত পাঠাতে হবে, কোন জন্তু-জানোয়ারের ডাকে সংকেত পাঠাতে হবে ইত্যাদি।
তৃতীয় স্তরঃ কারিগর-চুরির মূল কাজটি যিনি সম্পন্ন করবেন তিনিই হলেন ‘কারিগর’। কারিগরকে অতি দক্ষতার সাথে কাজটি সম্পাদন করতে হবে। কাজটি করে ডেপুটির হাতে তুলে দিতে পারলেই তার দ্বায়িত্ব শেষ। তখন তিনি নিরাপদ জায়গায় চলে যাবেন।
চুরির মালের ভাগাভাগি সততার সংগে করা হয়। যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে বঞ্চিত করা হয় না। কেউ ধরা পড়লে দলের কারো নাম প্রকাশ করবে না। দলের লোকেরা সুযোগ বুঝে তাকে ছাড়িয়ে আনবে। নিজেদের ভিতর তাদের সততার কোন ঘাটতি নেই। তারা কাজে নামার সময় একাজের তাদের ঈষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে। চোরদের ঈষ্ট দেবতা হলো স্কন্দ তথা দেব সেনাপতি কাত্তিক। বাঙ্গালী চোররা তাদের কাজের শুভ কামনায় মা’কালীকে স্মরণ করে থাকে।
চুরি কাজে আবার সময় ও কাল বিচার আছে। যেমন – শীতকালে রাতের প্রথম ভাগে কাজ সমাধা করতে হয়। লেপের নিচে শোয়ার পর ওম হলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যায়। তখনই কাজ সমাধা করতে হবে। আবার গরম কালে ঠিক তার উল্টো- সারা রাত আই ঠাই করে শেষরাতে ঘুম আসে। ঠিক সেই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য্যহারা হলে কাজ সমাধা হবে না। সিঁধ কাটারও নিয়ম আছে – কোথা দিয়ে কাটতে হবে, কতটুকু পরিমান কাটতে হবে। সিঁধ কাটার পর নির্বিঘ্নে ঘরের ভিতর কিভাবে উঠতে হবে ইত্যাদি।
সাহেবের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, সুধামুখী দাসী আদি গঙ্গার তীরে পরিত্যক্ত নবজাতক সাহেবকে কুঁড়িয়ে পেয়ে ছিলেন। দেবশিশুর মতো এই পুত্র সন্তানটিকে পেয়ে তার ঘরে নিয়ে এসে সন্তান স্নেহে লালন-পালন করেন। পতিতা পল্লীর শত দুঃখ-কষ্ট ও গ্লানির মধ্যে সাহেবকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। সাহেবকে ঘিরেই তার আশা-আকাঙ্খার কুঁড়ি একদিন প্রস্ফুটিত হবে। সাহেবকে লেখাপড়া শিখিয়ে একদিন সে মানুষের মত মানুষ করবে। সাহেবকে নিয়ে এই নোংরা পল্লী থেকে দূরে কোন ভদ্র পল্লীতে গিয়ে সাহেবের মা হয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে। তাই সুধাময়ী এই পল্লীতে জন্মগ্রহণ করা ছোট বোনের মত পারুলের সুন্দরী মেয়ে রাণীর সংগে সাহেবের বিয়ের প্রস্তাবকে বার বার এড়িয়ে গেছে। সাহেব রাণীকে পছন্দ করা সত্ত্বেও সুধামূখী চায়নি রাণীর সংগে সাহেবের বিয়ে হোক। সুধামুখীর বিশ্বাস সাহেব কোন বড় ঘরের ছেলে। তাই তার ঘরে আসা রাজা বাহাদুরকে সুধামুখী সাহেবের বাবা বলে সম্ভোধন করেন; রাজা বাহাদুরও সুন্দর অবয়বের এই পুত্র সন্তানটিকে সন্তান পরিচয়ে আহাল্লাদিত হয়। তাই সুধামুখীর ঘরে আসার সময় সাহেবের জন্য কিছু না কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে বা যাবার সময় কিছু অর্থ সাহেবের হাতে দিয়ে যায়। সাহবেকে সন্তান পরিচয় দিতেও সুধামুখীর পুরাতন খরিদ্দার নফর কেষ্টা আগ্রহী। তাই সে সাহেবকে স্কুলে ভর্তির সময় পিতার নামের স্থানে তার নাম লিখিয়েছে। এতেই নফরকেষ্টা মহাখুশি । সুধামুখীও সাহেবের প্রয়োজনে নফর কেষ্টাকে দিয়ে এটা-ওটা করিয়ে নেয়। সাহেবও জানে নফরকেষ্টা তার বাবা নয়, তবে সে সাহেবকে খুব ভালবাসে।
সাহেব বড় হয়ে তার পরিচয় জানতে পেরেছে। তাই সে সুধামুখিকে মা মনে করে না। সুধামুখি তাকে গঙ্গার তীরে কুঁড়িয়ে পেয়েছিল। সে তাকে লালন-পালন করেছে। সে তার পালিত মা। পালিত মা হলেও তার কষ্টে সাহেব নিজেও কষ্ট পেত। তাই শিশু সাহেব মার অভাব দূর করার জন্য আড়তের পড়ে যাওয়া চাল কুড়িয়ে এনে মাকে দিয়ে মায়ের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছে। চুরি শেখার পর চোরাই মাল মাকে দিয়ে মায়ের অভাব দূর করার চেষ্টা করেছে। সত্যিকারের পিতা-মাতার প্রতি সাহেবের ঘৃণা ও অভিমান। সে ভাবে মা-বাবার অনাকাঙ্খিত হওয়ায় তারা তাকে ত্যাগ করেছে। কখনও ভেবেছে বাবা তার মাকে বাধ্য করেছে ত্যাগ করতে, তার দুখিনী মা হয়তো আজও তাকে খুঁজে বেড়ায়। কখনও ভেবেছে বাবা হয়তো তার কথা জানেই না। নিজের প্রতি সাহেবের ঘৃণা হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন বলতে যাদেরকে বুঝায় সেই বাবা-মা তাকে ত্যাগ করেছে। বর্তমানে যে জীবন সে পেয়েছে, তা তার কাম্য নয়। তাই সে মা’কালীর কাছে প্রার্থনা করেছে, “ আমাকে মন্দ করে দাও মা-জননী – একেবারে নিখুঁত নির্ভেজাল মন্দ”।
সাহেবের ভিতর দ্বৈতসত্তার অপূর্ব মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। সাহেব চোর, কিন্তু পাষাণ্ড নয়। তার অনুভূতিশীল হৃদয় লক্ষ্য করা যায়। সে মেয়েদের কান্না, শিশুদের কষ্ট সইতে পারেনা। তাই নিজে যে বাড়ি চুরি করে তাদের সর্বস্ব হরণ করেছে, সেই বাড়ির জন্য তার অন্তরে মমত্ববোধ লক্ষ্য করা যায়। এই যন্ত্রণা প্রমাণ করে সৎ জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ। যেটা আমরা সুধামুখীর মধ্যে প্রবলভাবে দেখি। রাণীও স্বতী-সাধ্বী গৃৃহলক্ষ্মী হয়ে সাহেবের সংগে সংসার করতে চেয়েছিল কিন্তু অভিশাপ্ত পরিবেশ তাকে সে সুযোগ দেয়নি। বংশীর সাথে স্কুল ঘরে রামায়ন শুনতে গিয়ে রামের বনবাস শুনে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছে, তার দু’চোখ বয়ে নেমেছে অশ্রুধারা।
পাঠক মুকুন্দ বাইটাসহ প্রায় সকলেই দেখেছে সেই দৃশ্য। সাহেব রামের বনবাসের সংগে নিজেকে মিলাতে গিয়ে রামের চেয়ে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে করেছে। রামের বনবাসের মেয়াদও আছে। মেয়াদ শেষে তার ফেরার স্থানও নির্দিষ্ট আছে কিন্তু সাহেবের পরিচয় কি? তারতো নির্বাসন দুইযুগ হতে চলল, তার ফেরার জায়গাও নেই। রামের বনবাস হয়েছিল সাড়ম্বরে; দু’জন সংগী-সাথীও ছিল। কিন্তু সাহেবের তো কিছুই নেই। সে স্রোতে ভাসা শেওলার মতো ভেসেই চলেছে। কোথাও তার স্থায়ী ঠিকানা নেই।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি মনোজ বসু গ্রাম-বাংলার একেবারে নিম্নস্তরের ঘৃণিত মানুষ থেকে উঁচু তলার মানুষের প্রতিচ্ছবি তার লেখায় স্বার্থকভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণে সমাজের কাছে হেয় ও অবহেলিত পতিতা আর চোরের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না তুলে ধরতে সার্থক চিত্র শিল্পীর ন্যায় চিত্রকল্প রূপ দিয়েছেন। তাই “নিশিকুটুম্ব” মনোজ বসুর সার্থক সৃষ্টি।
]]>কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। কিন্তু সৃষ্টি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গেলে অবাক হতে হয়। তাঁর চৌষট্টিটি সৃষ্টির মধ্যে তেত্রিশটি উপন্যাস আটটি নাটক, চারটি ভ্রমণ কাহিনী, তিনটি ছোটদের গল্প, গল্পগ্রন্থ পনেরটি ও পদ্যরচনা একটি। যে সাহিত্যিকের হাত দিয়ে এতগুলো সৃষ্টি বেরিয়ে আসে, তার সাহিত্য অংগনে স্থায়ী আসন পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় তিনি অবহেলিত। সংগত কারণে প্রশ্ন জাগে তবে কি তাঁর সৃষ্টি তাঁকে মর্যাদার আসনে বসাতে ব্যর্থ হয়েছে! তাঁর এই ব্যাপক সৃষ্টির মধ্যে প্রকৃতি কতটুকু এসেছে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তার আগে ব্যক্তি মনোজ বসু ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে একটু ফিরে দেখা যাক।
কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর জন্ম কবি সাহিত্যিকের তীর্থভূমি যশোরের কেশবপুরে। তীর্থভূমি এই অর্থে বলতে চাই, তার জন্মের প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এই কেশবপুরে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কাব্যলক্ষ্মীর বরপুত্র, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যাঁর হাতের ছোঁয়ায় ভেঙ্গেছিল পয়ারের বেড়ি, সৃষ্টি হয়েছিল প্রবাহমান পয়ার, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, সনেট ও সাহিত্যের সার্থক ট্রাজেডি। গগণস্পর্শী প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন বলে বিশ্বসাহিত্য কানন থেকে তিল তিল করে মধু সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যে মধুচক্র রচনা করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে আধুনিক বাংলা সাহিত্য পঙ্গুত্ব থেকে হাঁটতে শুরু করেছিল। সেই মধুসূধনের জন্মভূমি এলাকায় তার জন্মের সাতাত্তর বছর পর কেশবপুরের নিভৃত পল্লী ডোঙ্গাঘাটা গ্রামের বসু পরিবারে মনোজ মনোজ বসু জন্মগ্রহণ করেন।
একই এলাকার কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর তুলনামূলক প্রতিভা ছিল পূর্ণিমার রাতে শুকতারার মত। লেখালেখির স্বভাব তিনি পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে। পিতা রামলাল বসু ও ঠাকুর দাদা ঈশ্বরচন্দ্র বসুর লেখালেখির হাত ছিল। মনোজ বসুর নিজস্ব দ্যুতি যেটুকু চোখে পড়ে তার প্রায় অর্ধেকটাই প্রকৃতির বর্ণনার জন্য। গ্রামের মেঠো পথ, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, খাল বিল নদী-নালা, ডোবা-পুকুর, বন-বনানী সবই তাঁর চিরচেনা।
তার জন্মস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন- “গাঁয়ের নাম ডোঙ্গাঘাটা! জেলা যশোর। আমি জন্মেছি সে গাঁয়ে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে। অজ পাড়া গাঁ বলতে যা বোঝায় ডোঙ্গাঘাটা ছিল অনেকটা তাই। বড় স্কুল ছিলনা। রাস্তা- ঘাট কাঁচা, রেল স্টেশন থেকে দূরে। আমরা চলাচল করতুম বেশী সময় খালি পায়ে খালি গায়ে। গর্ব করার মতো ব্যাপার নয় নিশ্চয়ই। আজকের ছেলেরা শুনলে লজ্জায় মাথা হেট করবে। বলবে গেঁয়ো মানুষ।”
এই অল্প কথার ভিতর দিয়ে তিনি তৎকালীন গ্রাম বাংলার যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তা শুধু তার নিজ গ্রামই নয়, এই জনপদের শাশ্বত রূপ। সাহিত্যের বিচারে তার মূল্য যায় থাকুক না কেন, সেটা একটা কাল বা সময়ের একটি জনপদের খাঁটি দলিল। সাহিত্য গ্রাম বাংলার বর্ণনা যেখানে আসুক না কেন, সবার আগে ফুটে ওঠে গ্রামের কাঁচা রাস্তা। শুষ্ক মৌসুমে ধূলায় পরিপূর্ণ ও বর্ষাকালে এক হাটু কাঁদার কথা সবার আগে আসে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘বিলাসী’ গল্পে গ্রামের রাস্তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন- “চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশী। বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল ও পায়ের নীচে একহাঁটু কাদা এবং গ্রীম্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধূলার সাগর”। মনোজ বসু ‘ইস্কুলের গল্পে’ বলেছেন- “বর্ষাকালটা ছিল সত্যিকারের দুর্ভোগের সময়। রাস্তার জমত এক হাঁটু কাদা। পা ডুবে গেলে সহজে পারতুম না। এঁঁটেল মাটির এই এক দোষ। গাঁয়ের লোক তাই বলে ছড়া বানিয়েছিল- “চিন্তেখালির মাটি, দুই ট্যাং আর লাঠি”।
মনোজ বসুর চেতনায় এলাকার মাঠ-ঘাট-হাট-প্রান্তর প্রতিষ্ঠান এক কথায় এই জনপদের কিছুই বাদ যায়নি। কেশবপুরের গরুহাট, গড়ভাঙ্গা থেকে নাগরঘোপের কাঁচা রাস্তা, নাগরঘোপ থেকে কসবার কথা, বাড়ি বাড়ি খেঁজুরের গুড় ও চিনি তৈরীর কথা, মনিরামপুরের হাটে গুড়ের আমদানী ও কোষ্টার দর সবকিছু চিরচেনা পরিচিত জনপদের গ্রামগুলি তাকে হাতছানি দেয়। মির্জানগর, রাজগঞ্জ, ব্যালোকাটির ফকিরবাড়ী, আটঘরা, হাসাডাঙ্গা, কানাইডাঙ্গা, মনোহরনগর, কানাপুকুর, পূর্ববাড়ী, পাইকগাছা, রাজীবপুর (রোজিপুর) সাগরদত্তকাটী, ন’পাড়া, মাদারডাঙ্গা, কোনাখোলা, ঝিকরগাছা অন্নপুন্নার হোটেল, প্রহ্লাদ মাষ্টারের পাঠশালা, কাজেম গুরুর পাঠশালা, রায়-রায়ানের দেউল (ভর্তের দেউল) সবই তার আত্মার আত্মীয়। পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা তথা গ্রামের স্মৃতি তাকে সবসময় ঘিরে থাকত। তাই তিনি বলেছেন, গ্রামকে আগে চেনা দরকার। আমাদের দেশের মানুষ গ্রামে গ্রামে ছড়ানো। তাদের বাদ দিয়ে কোন কিছু কল্পনা করা যায় না, গ্রামোন্নয়নের প্রয়োজন বুঝেছি আমি অল্প বয়স থেকেই।”
কপোতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা এ অঞ্চলের জনপদ গঠিত। তিনি পথ চলি গ্রন্থে বলেছেন, “কত সমস্ত মানুষজন ঘরবাড়ী, কত রকম সুখ-দুঃখ, আশা-আশ্বাস, আলাপনে ও বিশ্রামে সময় বয়ে যায় পথ এগোয় না। চারদিকে উছলা ধরণী নব রূপ মেলে ধরেছে- কাকে ফেলে কাকে দেখি, তাড়াতাড়ি এগোবো কি করে।” গ্রামের পথ-ঘাট, খাল-বিল, বন-বনানীর সংগে মনোজ বসু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছেন, এরা সকলেই তার আত্মার আত্মীয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে মনোজ বসু নিজ দেশে প্রবাসী হয়ে গেলেন। গ্রামের সংগে যোগাযোগের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ল, ইচ্ছা মাফিক গ্রামে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে না পারার কষ্ট তাকে সব সময় পীড়া দিত। প্রকৃতির বুক থেকে শহরের ইট কাঠের মধ্যে আটকা পড়ে জলের মাছ ডাঙ্গায় পড়ে যেমন ছটফট করে তেমনি ছটফট করেছেন, তিনি বলেছেন- “সর্বদাই মনে হয় যে, এখানে আমি প্রবাসী, আমি একজন বহিরাগত … … … বাল্য ও কৈশোরকাল আবার যদি একটু নাগালে পাই, আঁকড়ে ধরি বুকের উপরে, ছেড়ে যেতে দেইনা। কত ভালোবাসার ধন, এবারে মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি। শুধুমাত্র মানুষগুলি নয়, গাছপাল, গরু-বাছুর, খাল-বিল, সুখ-দুঃখ আশা উল্লাসে ভরা আমার সেকালের গ্রাম আর সমস্ত অঞ্চলটা। কোন গাছের ডালটা কোনদিকে তাও সঠিকভাবে বলে দিতে পারতাম। চোখ বুজে ভাবলে আজও বোধ হয় পারি।”
এরপর আর মনোজ বসুকে চিনতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। শুধু উপন্যাস আর প্রবন্ধ নয়, তার কবিতার ভিতর দিয়ে প্রকৃতি প্রেম ফুটে উঠেছে। তার “পাট ক্ষেতের মায়া” এর উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতায় তিনি গ্রাম বাংলার কৃষকদের মাতৃতুল্য গাভী বিক্রি করার পর হৃদয়ের ক্রন্দনকে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন-
“গেল বছর চৈত মাসেতে তিনটে বেচলাম গাই
গোয়াল কাঁদে ডাক ছাইড়ারে
তিনটে দিন আর গোয়াল পানে নজর তুলি নাই।
গোয়ালের কান্না অর্থাৎ কৃষকের হৃদয়ের আহাজারি। কবিতায় তিনি আরও উল্লেখ করেছেন-
“বার বেঁকির খাল চেন ভাই? শামুক পোতার চর
সেই খানে মোর সোনার ক্ষেতে ঐ গড়ই গাঙের পর
আর পারেতে তালের সারি দীঘল গাছের দেমাগ ভারি
মাথর উপর মেঘের বোঝা, পায়ের গোড়ায় ধান
ধানের গোছা দেইখ্যা যে প্রাণ করবে আনচান।”
নদী-খাল বিল, ফসলের ক্ষেত এ যেন গ্রামের শাশ্বত রূপ। এছাড়া তার প্রথম কবিতা “গোপন কথায়” বলেছেন-
সই কিরা কর কারেও কবি না-কহিব তব সে কথা।
* * * *
বিল কিনারায় উড়ে চলেছিল সাদা সাদা বক গুলি
মেঘের গলায় সাতনরী হার যায় যেন দুলি দুলি।
তুলসি তলায় সন্ধার দীপ বাতাসে কাঁপিয়ে মরে।
এত বড় বাড়ি- কেউ কোথা নাই, দু’জনে একেলা ঘরে।
দূরে বিয়াবাড়ি কত কোলাহল বাঁজিতেছে ঢোল কাঁশি
ও কহে তখন সেই পুরাতন-ভালোবাসি-ভালোবাসি-
এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানব-মানবীর চিরাচরিত অব্যক্ত মনের গোপন কথা ফুটে উঠেছে।
গ্রামের মাটি মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, আচার অনুষ্ঠান কুসংষ্কার সবকিছুর সংগে তিনি মিশে আছেন। তিনি বলেছেন- “পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বাড়ীর সামনে বিল, ছেলে বয়স থেকে ঋতুতে ঋতুতে বিলের রূপ বদলানো দেখেছি। চৈত্র-বৈশাখে ক্রোশের পর ক্রোশ ধূ ধূ করে। রাত্রি বেলা বাইরের উঠানে দাঁড়িয়ে দেখতাম দূরে আগুন জ্বলে জ্বলে উঠছে। আলেয়া নাকি ঐগুলো। কল্পনা করতাম কালো কালো ভয়াল অতিকায় জীব বিলের অন্ধকারে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শিকার ধরার আশায়। হাঁ করছে আর আগুন বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে … … … আতঙ্কে চেতনা বিলুপ্ত হয়। আলেয়ার দল তখন চারিদিক থেকে ঘিরে এসে ধরে।”
মনোজ বসুর দীর্ঘ সৃষ্টির ভিতর চারটি গ্রন্থ ও দুই-একটি কবিতায় ব্যাপক ভাবে প্রকৃতির বর্ণনার সমাবেশ ঘটেছে। এর মধ্যে “জলজঙ্গল” ও “বন কেটে বসত” গ্রন্থ দু’টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সমুদ্র উপকূল ও সুন্দরবন তথা বাদা অঞ্চলের কথা নিয়ে লেখা। “ছবি আর ছবি” ও “সেই গ্রাম সেই সব মানুষ” লেখকের স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থ। কবিতার ভেতর ‘পাট ক্ষেতের মায়’ ও ‘গোপন কথায়’ গ্রাম বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে। চারটি গ্রন্থ ও কবিতা গুলির ঘটনা বর্ণনা লেখকের দেখা-শুনা-বুঝা ও অনুভবের বাস্তব প্রতিফলন।
লেখক তার জলজঙ্গল ও বন কেটে বসত সম্বন্ধে বলেছেন- “শিশুরা শুনতে চাইত বাঘের গল্প। ভাল করে যদি বলতে পারি বয়স্ক শিশুরাই বা কেন সে জিনিষ পছন্দ করবে না? গ্রাম আমার সুন্দরবন অঞ্চল থেকে দূরবর্তী নয়। কাঠ কাটতে, মধু ভাঙ্গতে জীবিকার শতাধিক প্রয়োজনে লোকে বনে যায় বাঘ-কুমির-সাপের কবলে পড়ে। তার মধ্যে কত জনে আর ফেরে না। জনালয় থেকে বিচ্ছিন্ন, বনবিবি ও বাঘের সওয়ার গাজী-কালুর রাজ্য রহস্যময় সুন্দরবন ছোট বেলা থেকে আমায় আকর্ষণ করত। সুন্দরবনের বেশীর ভাগ এখন পাকিস্তানে। দেশ বিভাগের আগে সমগ্র সুন্দরবন আমি ঘুরেছি। পরে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনেও গেছি কয়েকবার। ঠিক বাঘের গল্প নয়-কিন্তু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা সুন্দরবন নিয়ে দুটো উপন্যাস (জলজঙ্গল ও বন কেটে বসত) ও কতকগুলো গল্প লিখেছি আমি। কোন কোন অংশে একেবারে বনের ভিতরে খালের উপর নৌকায় বসে লেখা।”
গ্রাম ও বাদাবনের কুসংস্কারও তিনি সযতনে বুকের মধ্যে লালন করে প্রকৃতির সংগে এক করে দেখেছেন। সুন্দরবনকে ঘিরে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের অন্যতম অবলম্বন। এখানে আছে, সুন্দরী, বান, পশুর, ধোন্দল, কেওড়া, গরান, গেয়ো, গর্জন, হেঁতাল, সিঙড়, কাঁকড়া, খলসি, ভাঁড়ার, করঞ্জ প্রভৃতি গাছ। কাঠ, গোলপাতা, মধু, মাছ আহরণ, নৌকা বাওয়া বেড়ীবাঁধ জীবন জীবিকার অবলম্বন হওয়ায় সুদূর অতীত থেকে রহস্যময় সুন্দরবনকে ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বনবিবি, দক্ষিণারাও, ছাওয়াল পীর, গাজী-কালু-চম্পাবতী ইত্যাদি লোকজ কাহিনী ঐ অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির সাথে মিশে আছে। তাদের সংগে সুন্দরবনের বগ মামা (বাঘ), গুণিন, বাওয়ালী, কুমির, সাপ, বনমোরগ, বনর, হরিণসহ কত অশরীরি আত্মা ও কত রকম কিংবদন্তী। এর সবাই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
‘জলজঙ্গল’ উপন্যাস স্বপ্নাদিষ্ট্য গুণিন দক্ষিনা রাওয়ের সন্তুষ্টি লাভের আশায়, বহরের সাথী দলের মধ্যে অকর্মন্য, অনাথ, সহজ-সরল নির্বোধ ফেলনাকে বাঘরূপী দক্ষিণা রাওয়ের মুখে উৎসর্গ করেছে বহরের সাথীরা, শুধুমাত্র তিন ক্ষেপের পরিমাণ মধু এক ক্ষেপে পাওয়ার আশায়। এটা সহজ-সরল গ্রাম্য মানুষের স্বার্থপরতা ও কুটিলতার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর পাশাপাশি তিনি অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ করেছেন। বাঘের মুখে উৎসর্গীকৃত ফেলনার কাতর আর্তনাদ সাথীদের লোভকে টলাতে পারেনি। তখন নিরুপায় ফেলনা বাঁচার শেষ আশ্রয়স্থল বনবিবিকে স্মরণ করেছে। বিপদসংকুল বাদার মাতৃস্বরূপা জ্যোতির্ময়ী রমনী বনবিবি তাকে হিংস্র বাঘের মুখ থেকে উদ্ধার করেছে এবং পরে সুন্দরবনের কুমিরের পিঠে করে তিন জোয়ারের উজানে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
এমন অসংখ্য অতিপ্রাকৃত ঘটনা বাদাবন তথা সুন্দরবনকে ঘিরে রয়েছে। এছাড়া লোনা পানির প্রভাব থেকে বেড়ীবাঁধ তৈরী, নদীর চরে বসবাস তাদের আচার-বিচার-ব্যাভিচার প্রেম, লোভ, মোহ, প্রতিহিংসা, দয়া-দৌরাত্ম, উপকার-উপদ্রব প্রভৃতি প্রবণতা লক্ষণীয়। মধুসূদন, দূর্লভ, কেতুচরন, এলোকেশী, গগন, অনন্ত, ভবনাথ, দেবনাথ, উমাসুন্দরী, তরঙ্গিনী প্রকৃতির অংশ হয়ে বিরাজ করছে। এরা সকলে প্রকৃতির মাঝে জন্মগ্রহণ করে প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে উঠেছে। প্রকৃতিকে নির্ভর করে সৃষ্টি হয়েছে শাস্ত্রসম্মত নয় এমন অনেক পূজা পার্বণ। এগুলো হলো বুড়ি ঠাকুরুণ, রণচন্ডী, রণগাজী, বনবিবি, দক্ষিণা রায়, গাজী-কালু, ছাওয়াল পীর প্রভৃতি।
মনোজ বসুর প্রকৃতি কেন্দ্রিক রচিত জলজঙ্গল ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থে উপন্যাসের ধারা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। পারতেও চাননি বলে মনে হয়। সৃষ্টির আপন গতিতে বেরিয়ে এসেছে বন কেটে বসত, সেই গ্রাম সেই সব মানুষ। ছবি আর ছবিতে লেখক অনন্তের জবানীতে অপরিমাণদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের ভুলসিদ্ধান্তে দেশবিভাগের বেড়াজালে পারিবারিক পীড়নের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। ভবনাথ, দেবনাথ, উমাসুন্দরী, তরঙ্গিনীর মধ্য দিয়ে তার চিরচেনা একান্নভূক্ত পরিবারের মায়াময় বন্ধনের চিত্র দেখা যায়।
মনোজ সাহিত্যে প্রকৃতির যে রূপবৈচিত্র্য ধরা পড়েছে তা প্রতিটা পাঠককে আন্দোলিত করবে। তাঁর বাদাবনের কাহিনী সম্পর্কে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন “কল্লোল যে রোমান্টিসিজম খুঁজে পেয়েছে শহরের ইট, কাঠ, লোহা-লক্কড়র মধ্যে, মনোজ তাই খুঁজে বনে বাদায়, খালে-বিলে পতিতে আবাদে।”
তার সেই গ্রাম সেই সব মানুষ সম্পর্কে ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন “এটি মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ রচনা।” ডঃ অমলেন্দু বসু গ্রন্থটিকে মহাকাব্যোচিত বলেছেন। ডঃ অসিত কুমার গ্রন্থটি সম্পর্কে আরও বলেছেন- “এই উপন্যাস, আমার দৃঢ়বিশ্বাস একালের বাংলা কথাসাহিত্যে একক মহিমায় বিরাজ করবে এবং অল্পকালের মধ্যেই এটি চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা পাবে।”
গত ২০০৫ সালে কেশবপুরের সাবেক ইউএনও মোঃ খলিলুর রহমান সাহেবের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে মনোজ বসু ও তার সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। এছাড়া পশ্চিম বাংলায়ও কাজ চলছে। পশ্চিম বাংলায় ডঃ মৃত্যুঞ্জয় দাশ ও ডঃ দীপক চন্দ্র মনোজ বসুকে নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন। মনোজ সাহিত্য অচিরেই যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাহিত্যের চুলচেরা বিচারে মনোজ সাহিত্য কতটুকু মর্যাদার আসন পাবে আমি নিশ্চিত জানিনা, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকৃতির নির্ভেজাল চিত্র তুলে ধরার জন্য যশোর- খুলনার মানুষের কাছে তাঁর সৃষ্টি চির অম্লান, চির অক্ষয় হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। আর মনোজ বসু যদি বাংলা সাহিত্যের ভুবনে স্থায়ী আসন পান- তবে তাঁর ভিতে থাকবে তার প্রকৃতির বর্ণনা।
পরিশেষে আমি ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যেপাধ্যায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, কথা সাহিত্যে মনোজ বসু একদিন একক মহিমায় বিরাজ করবে এবং অল্পকালের মধ্যেই এটি চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা পাবে।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ
পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা। নজরুল প্রতিভার ভেতর আমরা এক সাথে দু’টি প্রবাহের পাশাপাশি অবস্থান লক্ষ্য করি। একটি প্রবাহ হল প্রেম সৌন্দর্য ও অপরটি হল বলিষ্ট বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের পেছনে যে শক্তি কাজ করেছে তাও হল প্রেম-দেশপ্রেম। বাংলা সাহিত্য ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যেই প্রেম সৌন্দর্য ও বিদ্রোহের বাণী ঝংকৃত হতে শোনা যায়। কিন্তু একই কবি বা সাহিত্যিকের মধ্যে এই দুটো গুণের সমাবেশ যথেষ্ট বিরল। নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি বলে পরিচিত। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তার বিদ্রোহী সত্তার সাথে রোমান্টিক প্রেমানুভূতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।
নজরুল ইসামের বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও তৎকালীন শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। কবি সমাজের হীন স্বার্থান্বেষী শ্রেণীর হাতে দরিদ্র নিপীড়িত, অসহায় মানুষের নির্যাতিত হওয়ার চিত্র অতি কাছে থেকে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্রের স্বাধীনতাই যে যথার্থ স্বাধীনতা, তারই কণ্ঠে তা সরবে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এবং বিদ্রোহ করলেন-
“ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন,
বেলা বয়ে যায় খায়নিকো বাছা, কচিপেটে তার জ্বলে আগুন,
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়।
কেঁদে বলি ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে নাকো তাদের গালে, যারা খায় শিশুর খুন?”
নজরুল ইসলাম সকল সময় ভণ্ডামীকে ঘৃণা করতেন। মানুষ কবিতায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। ধর্মের নামে অর্ধম নজরুল ইসলামকে যথেষ্ট পীড়া দিত। তাই তিনি স্বার্থন্বেষী ধর্ম যাজকদের ধিক্কার দিলেন-
‘তব মসজিদ মন্দিরে, প্রভু, নাই মানুষের দাবী
মোল্লা-পুরুত লাগাইয়াছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’
নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। পরাধীন জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি যে অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছেন তা বর্তমান যুগের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রর চেয়েও কার্যকরী। তার সেই অস্ত্রের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কোন সাম্রাজ্যবাদের নেই। তার অগ্নিঝরা বাণী-
‘পরের মুলক লুট করে খায়
ডাকাত ওরা ডাকাত
তাই তাদের তবে বরাদ্দ ভাই
আঘাত শুধু আঘাত।’ (অগ্নিবীণা)
কিংবা……..
‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ ।’
নজরুল ইসলাম কখনও অত্যাচারিত শাসক শ্রেণীর সংগে আপোস করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি বরং তিনি কখনও কখনও ইংরেজদের প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ প্রীতি আসলে আপোষবাদিতারই নামান্তর। নজরুল ইসলাম ‘ধুমকেতু’তে তীব্র ভাষায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীর পাশাপাশি প্রভুভক্ত আপোসবাদী ও মধ্যপন্থীদের ভৎসনা করে বললেন-
‘যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই
কবর সেথায় বিদ্রোহ।
ধামাধরা! জামাধরা!
মরণ-ভীতু চুপ র হো!
আমরা জানি, সোজা কথা
পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।’ (বিষের বাঁশী)
এহেন ইস্পাত কঠিন বলিষ্ঠ পুরুষদ্বীপ্ত মনের মানুষটির ভেতর যে প্রেম সৌন্দর্যের এক স্বচ্ছ ফল্গুধারা তর তর করে বয়ে গেছে তা তার কবিতা ও গান না পাঠ করলে বিশ্বাস করা যায় না। চর্যাপদের যুগ হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত সাহিত্যে প্রেম একটা চিরন্তন বিষয়। কিন্তু নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবি হিসেবে অন্ধকার রাতে শুকতারার মত আজও জাজ্বল্যমান। তার প্রেমানুভুতির এ তীব্রতা বস্তুতপক্ষে তার পৌরুষের প্রতীক। বাংলা কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্যের চিত্রাবলী প্রায়শই লালিত মধুর, কিন্তু নজরুল যখন আহব্বান করেন-
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল। ’
তখন এই প্রেম নিবেদনের পৌরুষ দীপ্তিতে কোন সংশয় থাকে না। সৌন্দার্যাভিসারের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য নজরুল কবি মানসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রেমের মধ্যে তিনি বিরহকে যথার্থ বলে জেনেছেন। তিনি প্রেম বা বিরহকে সমগ্র প্রকৃতিতে পরিব্যাপ্ত ও প্রসারিত করে দিয়েছেন। ‘সিন্ধু হিল্লোল’-এর ‘মাধরী প্রলাপ’ কবিতায় দেহগত প্রেমের তীব্রতা ও প্রেমকে সার্থক করে তোলার জন্য দেহের তীব্র আকুলী দানা বেঁধে উঠেছে। দেহের রক্তে আগুন ধরে যাওয়ার নামই যৌবন। প্রকৃতির যৌবন যেন বসন্তকাল। তখন প্রকৃতি প্রেম চরিতার্থ করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে কবি বলেন-
‘আজ লালসা অলস মদে বিবশারতি
শুয়ে অপরাজিতার ধনী মরিছে
পতিতার বিধুবন উম্মন
ঠোঁটে কাঁপে যৌবন
বুকে পীন যৌবন
উঠেছে ফুঁড়ি
মুখে কাম কন্টক এল মহুয়া কুড়ি।’
মানবিক প্রেমের সৌন্দর্য দেহকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে এবং সে প্রেমের বিচিত্র স্বাদ আস্বাদনের জন্য মন একান্ত ব্যাকুল হয়ে উঠে ‘অনামিকা কবিতায়’ নজরুল এ জীবন আস্বাদনের পরিচয় দিয়েছেন-
‘যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন
যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর
সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ অনুভব করিয়াছি।’
দোলনচাঁপায় কবি প্রেম সম্পর্কিত অস্থির মানসিকতা চিত্রিত করেছেন। এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ কবিতা পূজারিণী কবির জীবন্ত মানস প্রতিমা। এ কবিতায় দেহ সচেতনতা সুস্পষ্ট। নিজ প্রিয়তমার সাথে কাল্পনিক মিলন বিরহ, অবিশ্বাস সংশয় তৃপ্তি-অতৃপ্তি প্রচণ্ড আলোড়নে তরাঙ্গিত দেহমুখী প্রেম-তরঙ্গের এক আশ্চর্য পরিচয় সংরক্ষিত হয়েছে নজরুলের এ কবিতায়-
‘ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়
যাচে বহুজন।’
দোলনচাঁপার মধ্যে নজরুলের যে প্রেম ভাবনা তারই অধিকতর পরিষ্ফুট রূপসমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়ানট’ কল্পনা মাধুর্য্যে নিসর্গ সম্ভোগে ও প্রেমের অন্তরঙ্গ আস্বাদনে পরিণত চিন্তা স্পষ্ট। এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা বিজয়িনীতে কাব্যের মূল সুরই নয়, নজরুলের মানবিক প্রেমমূলক কাব্যগুলোর মূল সুরও এতে ধ্বনিত।
‘হে মোর রাণী। তোমার কাছে
হারমানি আজ শেষে, আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার
চরণ তলে এসে।’
‘সিন্ধু হিল্লোল’-এর ‘সিন্ধু’ কবিতায় কবি সিন্ধুকে চির বিরহের প্রতীক ভেবেছেন। সমুদ্রকে কবি সমব্যথী মনে করেছেন-
‘এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি
কাঁদে মোর প্রিয়া।’
চক্রবাক নজরুলের শ্রেষ্ঠ প্রেমমূলক কাব্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এরও মূলসুর প্রেম-বিরহ। এখানে কবি প্রকৃতিকে আর তার প্রেমিকাকে এক করে দেখেছেন। বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, কর্ণফুলিল প্রভৃতি কবিতায় এ স্বাক্ষর বিদ্যমান-
‘তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আখিঁর কাজল রেখা
তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা।’ (গুবাক তরুর সারি)
অথবা
‘তুমি পদ্মা, হারানো গোমতী ভুলে যাওয়া ভগীরথী
তুমি কি আমার বুকের তলায় প্রেয়সী অশ্রুমতি(কর্ণফুলি)
নজরুলকে ঘরের বাঁধন কোনদিন বেঁধে রাখতে পারেনি। তাই বাঁধন হারা চির পথিক পৃথিবীর প্রেমে ধরা দিতে প্রলুব্ধ হয়েছিল বটে; কিন্তু কোন মর্ত্যবাসিনী বেশী দিন তাকে স্নেহাঞ্চলে বেঁধে রাখতে পারেনি। চির চঞ্চল কবি তাই বার বার বের হয়েছেন- কারণ
‘সে যে পথের চির পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?’
সুতরাং এই ‘পথ পাগল’ কবিকে কে বন্ধনে আবদ্ধ রাখবে? তাই কবি আবেগ ভরা কণ্ঠে ‘অভিশাপ’ কবিতায় বলেছেন-
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারে সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।’
নজরুলের প্রেমানুভুতি ও সৌন্দর্যের মধ্যে কোন অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা ছিল না, সব সংস্কার মুক্ত খাঁটি মানবিক প্রেম ও সৌন্দর্যের সাধক ছিলেন তিনি। মানবিক রূপ দেখে তিনি আধ্যাত্ম বিলাসে মগ্ন হননি। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ঐশ্বর্যের মধ্যেও অনুভব করেছেন নিজের বাসনা, রঙ্গিন হৃদয়ানুভূতিরই ক্রন্দন ও উল্লাস। বাংলা সাহিত্যের আধ্যাত্ম প্রবণ প্রেমে নজরুল সংযোগ করেছেন মানবিক প্রেমের বিরহ মিলন।
তাই আমরা বলতে পারি, নজরুল ইসলাম বিদ্রোহে ছিলেন হিমালয়ের মত সুউচ্চ ও জীবন্ত আগ্নেগিরির মত দহন ক্ষমতা সম্পন্ন এবং প্রেমের ক্ষেত্রে ছিলেন স্রোতস্বিনী নদীর জোয়ারের মত। তার প্রেমের ফেনায়িত তরঙ্গ কুল ছাপিয়ে একাকার হয়ে গেছে। তার বিদ্রোহের পেছনেও ছিল খরস্রাত নদীর মত দেশপ্রেম। তার দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম দুটি ধারাই কোথাও কোথাও বানের পানির ন্যায় সব কিছুকে একাকার করে দিয়েছে।
পরিশেষে আমার এক লেখক বন্ধুর কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, নজরুলের বক্ষটা (ভালবাসার হৃদয়টা) এতই প্রশস্ত ছিল যে, সমস্ত পৃথিবী তার বক্ষের ভেতর ঢুকে যাওয়ার পরও আরও জায়গা খালি ছিল।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।
]]>তাই ঐতিহ্যবাহী পাঁজিয়ার পারিভাষিক অর্থ হল ‘পরম্পরাগত ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তী পদচিহ্ন গ্রথিত স্থানের নামই ‘পাঁজিয়া’। পাঁজিয়া একটি গ্রামের নাম, একটি ইউনিয়নের নাম, একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম। ঐতিহ্যবাহী পাঁজিয়াকে তুলে আনতে পালে একটি পৃথক পুস্তক হয়ে যাবে। স্বল্প পরিসরে এটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। এরপরও খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সে কারণে সকল বর্ণনার খণ্ডিত চিত্র তৈরী হওয়ায় তার সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ক্রটির জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
‘পাঁজিয়া’ নামকরণ সম্পর্কে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে। পাঁজিয়া অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে ওঠার সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের জনৈক ছাত্র কিছু পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে পাঁজি (পঞ্জিকা) লিখতেন। তার পাঁজি লেখাকে কেন্দ্র করে ‘পাঁজিয়া’ নামকরণ হয়েছে। বিষয়টি গবেষণার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ৭নং ইউনিয়নের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামের নাম ‘পাঁজিয়া’। উপমহাদেশের বৃটিশ রাজত্বের পুরাতন জেলা যশোর। যশোর সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে কেশবপুর উপজেলা সদর। উপজেলা সদর থেকে পূর্বে ৯ কিলোমিটার গেলেই পাঁজিয়া বাজার ও পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। নামকরণ ‘পাঁজিয়া’ হলেও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও বাজার মাদারডাঙ্গা মৌজায় অবস্থিত।
এছাড়াও স্কুল, কলেজ, পোষ্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, মন্দির, মসজিদ, ব্যাংক, কৃষি ভবন, তহশীল অফিসসহ যাবতীয় পাবলিক প্রতিষ্ঠান মাদারডাঙ্গা মৌজায় অবস্থিত হলেও নাম ‘পাঁজিয়া’। পাঁজিয়া, মাদারডাঙ্গা ও মনোহরনগর এই তিন গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামের মৌখিক পরিচয়ে পাঁজিয়া পরিচয় দিয়ে থাকে। সুদূর অতীত থেকে গ্রামটির গুরুত্ব অপরিসীম। বহু ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক পাঁজিয়া গ্রাম। নবাবী ও ইংরেজ আমল থেকে পাঁজিয়ার সংগে কলকাতার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পাঁজিয়ার প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিকটজন কেউ না কেউ কলকাতায় অবস্থান করত। এছাড়া রেল যোগাযোগের মাধ্যমে পাঁজিয়ার লোক ৪ থেকে ঘন্টার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে যেতে পারত। সে সময় অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে কলকাতায় যাতায়াত করত।
পাঁজিয়া জনপদটি বহু পুরাতন নয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে ধারণা করা হয় এই জনপদটির বয়স ‘তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর হতে পারে। সমগ্র কেশবপুর উপজেলাটি কপোতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা গঠিত। হরিহর কপোতাক্ষের শাখা নদী।
এই হরিহরই পাঁজিয়া অঞ্চলের ভূমি গঠনের কাজটি সম্পন্ন করে। ধারণা করা হয় প্রায় দু’শ পঞ্চাশ বছর পূর্বে হরিহর (বর্তমান নাম সাতনল) নদীর নাব্যতা ছিল। তখন এই নদীপথে নৌকা চলাচল করত। জনশ্রুতি আছে এই নদী দিয়ে যাতায়াতকারী নাবিকরা (মাঝিরা) আড়–য়ার খলিল মেম্বারদের বাড়ীর দক্ষিণ পাশে নদীতে তীরে পুরাতন তেঁতুল গাছে নৌকা বেঁধে বিশ্রাম নিত। এখানে গোসল রান্না ও খাওয়া দাওয়ার পর পরবর্তী গন্তব্যে জোয়ার বা ভাঁটায় নাবিকরা নৌকা ছেড়ে দিত। পাঁজিয়া গ্রামটি হরিহর নদীর দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। সাতাশকাটি থেকে বড়বাগ পর্যন্ত নদীর দক্ষিণ পাড়ের গ্রামের নাম পাঁজিয়া। উত্তর পাড়ের গ্রামটির নাম মাদারডাঙ্গা। দক্ষিণ ও উত্তর পাড়ের গ্রামের নাম মৌজা অনুযায়ী যথাক্রমে পাঁজিয়া ও মাদারডাঙ্গা হলেও উভয় পাড়ের গ্রাম পাঁজিয়া গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
পাঁজিয়া মৌজার দক্ষিণাংশের নিম্নভূমির ভূমির গঠন প্রক্রিয়া চলছিল ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা। বিগত ষাটের দশকে ওয়াপদার নদী শাসনের আওতায় পড়ে এই অঞ্চলের ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নিচু অঞ্চলটি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। পাঁজিয়া মৌজার এই অংশে (২৩২১ দাগে) আমার বাড়ী। মৌজা অনুযায়ী পাঁজিয়া মৌজার উঁচু ও নিচু জমির পরিমাণ সমান। তবে কথিত পাঁজিয়া গ্রামের (পাঁজিয়া ও মাদারডাঙ্গা) উঁচু ভূমির পরিমাণ বেশী। এই অঞ্চলটি সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১০/১২ ফুট মাটি খুড়লেই এর প্রমাণ মেলে।
পাঁজিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তেমন কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। কেউ কেউ আশুতোষ দেবনাথের কবিতার পাণ্ডুলিপিকে পাঁজিয়ার ইতিহাস মনে করেন। যারা এটা মনে করেন তারা স্মৃতিকথা ও ইতিহাসকে গুলিয়ে ফেলেছেন বলে আমার মনে হয়। তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে পুরানো দিনের কিছু সত্য ঘটনা পাওয়া যাবে; তবে সেটার পরিমাণ খুবই সামান্য। তাতে অধিকাংশ শ্রুতিকথা, কবিকল্পনা ও আবেগ মিশ্রিত ঘটনার বর্ণনা। তিনি সত্য উৎঘাটনে আদ্যে সচেষ্টা ছিলেন বলে মনে হয়নি। তবে তিনি চারণ কবি ছিলেন। কাব্য বিচারে তিনি কোন মাপের কবি ছিলেন সময় ও সুযোগ এলে তা বিচার করা যেতে পারে। তার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। তার লেখার মাধ্যমে পুরোনো কিছু কথা সংরক্ষিত হয়েছে। এছাড়া ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে গণ উদ্যোগ ফোরামের সহযোগিতায় পাঁজিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের চর্চা কেন্দ্র থেকে ‘পাঁজিয়া’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেই পত্রিকায় ইতিহাসের প্রেক্ষাপট যেখানে এসেছে; সেখানেও আশুতোষ দেবনাথের স্মৃতিকথাটির উপর নির্ভর করা হয়েছে। সেখানেও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। তারপরও ধন্যবাদ জানাই ‘পাঁজিয়া’ পত্রিকার সংগে সংশ্লিষ্ট সমকলকে পাঁজিয়ার ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করার জন্য, আমি বিশ্বাস করি কোথাও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে থমকে না দিয়ে হাতড়ানোর সুযোগ করে দেওয়াও ভাল। হাতড়াতে হাতড়াতে কেউ সঠিক স্থানে একসময় ঠিকই পৌঁছে যাবে। আমাদের উচিৎ হবে, যে বা যারা অনুসন্ধানের পথে চলবে, তাদের যে যতটুকু পারি সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা। না পারলে বিনয়ের সংগে ক্ষমা চাওয়া।
তবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করলে হয়তো সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসতে অধিক বিলম্ব হবে। পাশাপাশি যে যতটুকু জানি তা প্রকাশ করা। হয়ত এমন হতে পারে কোন একটা ছোট তথ্য সঠিক ইতিহাস নির্বাচনে সহায়ক হতে পারে। ধন্যবাদ জানাই সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদকে তাদের শুভ উদ্যোগে পাঁজিয়াতে সম্মেলন হতে যাচ্ছে। আসন্ন সম্মেলনে পত্রিকা প্রকাশ করে সেখানে পাঁজিয়ার উপর লেখা তৈরীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
পাঁজিয়ার প্রথম বসতি স্থাপনকারী কারা এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কেউ বলেছে বোসরা, কেউ বলেছে সরকাররা, কেউ বলেছে মজুমদাররা, আবার কেউ বলেছে জমাদ্দার বংশীয়রা। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে জানা যায় বোসদের পূর্বে সরকার মজুমদাররা এখানে বসতি স্থাপন করে। বাণিজ্যিক কারণে বোসরা এখানে আসে। পরে সরকার বংশীয় মেয়ে বোসরা বিয়ে করে। এ কারণে বোসরা কুল হারায়। ধারণা করা হয় বোসদের পূর্বে সরকার ও মজুমদাররা তৎকালীন জমিদারদের প্রজা ছিল। পরে বোসরা এখানকার জমিদারী কিনে নেয়। যে যাই বলুক না কেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিচারে প্রথমে বোস, পরে সরকারদের অবদান অনস্বীকার্য।
বোসরা প্রথম বসতি স্থাপন করে পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হরিহর নদীর (সাতনলের) উত্তর পাড়ে। অপরদিকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে সরকার বংশীয়দের বসতি ছিল। বোসদের অর্থবিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, মান-সম্মান ও সর্বোপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এদের একটি শাখা পূর্ব পাড়ায় বসতি স্থাপন করে। অন্য শাখাটি কালীবাড়ীর উত্তর পাশে বর্তমান পাঁজিয়া মহাবিদ্যালয়ের স্থানে বসতি গড়ে তোলে। পুরাতোন বাড়ীর একই পরিবার দু’ভাগ হওয়ার কারণে পূর্ব পাড়ায় বসবাসকারীদের ‘পূর্বের বাড়ী’ এবং কলেজের স্থানে বসবাসকারীদের ‘নূতনবাড়ী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। পুরাতন বাড়ী হলো প্রথমেই বসতিবাড়ী (চকের বাড়ী) পূর্বের বাড়ী ও নতুন বাড়ীর স্বনামধন্য ব্যক্তিদ্বয় হলেন যথাক্রমে রবক্ষিণী কান্ত বোস ও পরেশ নাথ বোস, এরা উভয়ে মুর্শিদাবাদের নবাব কর্তৃক ‘দেওয়ান’ ও ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরা উভয়ে জমিদার ছিলেন। রাজা পরেশ নাথ সিলিমাবাদ পরগণার ও দেওয়ান রবক্ষিণী কান্ত চেঙ্গুটিয়া স্টেটের। বর্তমান পাঁজিয়া হাইস্কুল ও মনোহরপুর কাছারীবাড়ী পরেশ নাথের কাছারী ছিল।
অন্যান্য জমিদারদের ন্যায় এই জমিদারদের সদর মহল, অন্দর মহল, নাচমহল, নাট মন্দির, তহশীল ও কাছারী ছিল। প্রয়োজনীয় লোকবলও ছিল। দু’বাড়ীর দুই কর্তা ব্যক্তিকে ঘিরে পাঁজিয়ায় তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা পবেশ নাথ বসুর জমিদারীর গল্প আজও পাঁজিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষের মুখে-মুখে। মূলত পাঁজিয়ার যে ঐতিহ্য তার সিংহ ভাগই বোস পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। তন্মধ্যে নতুন বাড়ীর গুরুত্ব অপরিসীম। বোসরা পাঁজিয়া এলাকার উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু জনকল্যাণ মূলক কাজ করে তারা অমর হয়ে রয়েছেন। জমিদার ও তার সহযোগীতায় সে সকল জনকল্যাণমূলক কাজ করেন, সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে প্রদত্ত হল।
পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষা বিস্তারের জন্য শ্রীনাথ বসু ও যোগেন্দ্র নাথ বসু কর্তৃক পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও পাঁজিয়া ২০ কিলোমিটার ভিতর উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ছিলনা। ১৮৯৭ সালের ৪ জানুয়ারী এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বোসেরাই প্রথম উচ্চ শিক্ষার দ্বারা উন্মোচন করে। তাদের চেষ্টায় ১৮৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলটিকে স্থায়ী স্বীকৃতি দান করে যা আজও বলবৎ আছে। এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাগের হাটের প্রফুল্ল বাবু, দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক যোগেন্দ্রনাথ বসুর পুত্র অনুকূল চন্দ্র বসু। স্বাধীনতা উত্তর এই প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ শিক্ষক মণ্ডলী ছিল। এরা সকলেই আমার শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বিষ্ণুপদ ঘোষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক কানাই লাল পাল, ফজলুল করিম, আব্দুল মালেক, বলাই কবিরত্ন, গোপাল চন্দ্র দে, আমজাদ হোসেন, সুনিল কুমার পাল, দীপক মজুমদার, অশোক কুমার বিশ্বাস, মশিয়ার রহমান প্রমুখ। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ে কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র মন্ত্রী শরৎ চন্দ্র মজুমদার, সাহিত্যিক মনোজ বসু ও সাহিত্যিক ও চিত্রাভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য জগন্নাথ বসু প্রমুখ।
পাঁজিয়া দাতব্য চিকিৎসালয়: পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের চিকিৎসা সুবিধার জন্য ১৯২৫ সালে বিজয় গোপাল বোস, বিনয় বোস প্রমুখের চেষ্টায় পাঁজিয়ার পূর্ববাড়ীতে উপেন্দ্র কৃষ্ণ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কুসংস্কারের বেড়াজালে আবন্ধ মানুষ যখন ভূত-প্রেত-দেও-দানবের আছরকে অসুস্থতার কারণ বলে জানত, তখন কয়েকজন মহৎ ব্যক্তির চেষ্টায় দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। বর্তমানে দাতব্য চিকিৎসালয়টি পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সংগে একিভূত হয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেন্টার হিসাবে কার্যক্রম পরিচালতি করে যাচ্ছে।
পাঁজিয়া পোষ্টা অফিস: পাঁজিয়া অঞ্চলের মানুষের সংবাদ আদান-প্রদানে মাধ্যম হিসেবে পোষ্ট অফিসের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে ইংরেজ আমলে যোগাযোগের সর্ব উৎকৃষ্ট মাধ্যম পোষ্ট অফিস। পাঁজিয়ার পূর্ব পাড়ার জমিদার বোসদের চেষ্টায় পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে পাঁজিয়ার সংগে কোলকাতার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পোষ্ট অফিস। তৎকালে পাঁজিয়ার শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এই পোষ্ট অফিসের মধ্যমে উপকৃত হত। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পোষ্ট অফিসটি পূর্বপাড়া থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমান মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডাকঘরের গুরুত্ব কমে এসেছে। শুধু অফিস-আদালতের চিঠিপত্র ডাকঘরের মাধ্যমে বিলি বন্টন হচ্ছে।
পাঁজিয়া বাজার প্রতিষ্ঠা: জমিদারদের জমিদারীর প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ পাঁজিয়া অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। জমিদারদ্বয় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সুবিধার জন্য বাজারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যতদূর জানা যায় দ্রব্য বিনিময়ই বাজার ব্যবস্থার প্রথম সোপান। মানুষের বসবাসের এলাকায় দূরত্বে হলেও বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পাঁজিয়ায়ও বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এলাকার প্রয়োজনে। গ্রাম বাংলায় গড়ে ওঠা অন্যান্য বাজারের তুলনায় পাঁজিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর। প্রতিদিন সকালের বাজার পাঁজিয়া বাজারের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জনশ্রতি আছে জমিদার ও জমিদারীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা টাটকা বাজার সওদার প্রয়োজনে প্রতিদিন সকালের বাজার প্রয়োজন হয়। এখনও সেই ব্যবস্থার ব্যত্য় ঘটেনি। বর্তমান সময়ও গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এমন বাজার ব্যবস্থা বিরল। এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে পাঁজিয়ার তরকারী বাজারের মালামাল পাঁজিয়া থেকে সরাসরি রাজধানীতে পাঠিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
পাঁজিয়ার পাঠাগার: মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায়। মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য শ্রেণীর শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বই পুস্তক পাঠের আবশ্যকতা অনুভব করে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকে সুনিল কুমার বোসের প্রচেষ্টায় পাঁজিয়ায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়। জনশ্রুতি আছে জমিদারদের অন্দরমহলের বিনোদনের জন্য নাচমহল ছিল। লক্ষ্মৌ থেকে আনা নর্তকীরা সেখানে নাচ-গান করত। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পঠন পাঠনের পাশাপাশি সাংস্কৃতি চর্চা ও শরীর চর্চামূলক ক্রীড়াদিও অনুষ্ঠিত হত। ১৯২৮ সালে পরিবর্ধিত হয়ে চারুচন্দ্র পাঠাগার নামকরণ করা হয়। বর্তমানে পাঠাগারের একটি ভবন ছাড়া আর কিছুই নেই। এই ভবনটি ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হিসেবে আজও খাড়া হয়ে আছে। আর একটি সূত্র থেকে জানা যায় পাঁজিয়াতে নেতাজী সুভাষ পাঠাগার ছিল। গোল টেবিলের উত্তর পার্শ্বে উঁচু ভিটাটি ছাড়া তার আর কিছুই নেই।
এই পাঠাগারের সংগে বিগত শতাব্দির চল্লিশের দশকে পাঁজিয়া সাহিত্য-সাংস্কৃতির আন্দোলন নামে একটি সংগঠন ছিল। যাদের প্রতি পূর্ণিমায় আসর বসত। আসর শেষে পরবর্তী আসরের বিষয় নির্ধারণ করা হত। ফজলুল করিম ও আবন্দুল মালেক সেই সংগঠনের সভ্য ছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ‘প্রগতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। ব্যক্তি উদ্যোগে পাঁজিয়ায় ১৯৮৫ সালে সাতনল পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্য সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মূলত রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁজিয়ার সাহিত্য সংগঠন গতি পায়। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া বিগত দিনে পাঁজিয়া অঞ্চলে কোন সাহিত্যকর্ম দৃশ্যমান হয়নি। বিগত শতাব্দী থেকে অদ্যাবধি তার সাহিত্য সংগ্রহশালা হতে সমৃদ্ধ ও আর কারো দেখা যায়নি। বর্তমানে পাঁজিয়া অঞ্চলে প্রায় ডজন খানেক সাহিত্য সংগঠন কাজ করছে। এখনও পাঁজিয়াতে প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য আসর বসে।
গোল টেবিল: পাঁজিয়ার গোল টেবিল পাঁজিয়ার ঐতিহ্যের একটি বড় উদাহরণ। এমন গোল টেবিল সমগ্র বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। এই গোল টেবিলে বসে সামাজিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করে সিন্ধান্ত নেওয়া হত। পাঁজিয়ার কংগ্রেস নেতা ও কৃষক নেতারা নিয়মিত এখানে বসে তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করতেন। এখনও ভগ্ন ও জরাজীর্ণ অবস্থায় গোলটেবিলটি তার অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে। নেতাজী সুভাষ পাঠাগারের সংশ্লিষ্ট ‘পাঁজিয়া’ সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোল’ সংগঠনের সভ্যগণ গরমের দিনে এই গোল টেবিলে বসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন।
কালী মন্দির: নূতন বাড়ীর জমিদার রাজা পরেশ নাথ বসুর পিতা তারিণীকান্ত বসু তৎকালীন পাঁজিয়া পুরাতন বাজার সংলগ্ন পূর্ব-উত্তর কোণে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালে সকল হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ বাড়ীর সন্নিকটে সার্বজনীন মন্দির প্রতিষ্ঠা করতেন। এটা তাদের রীতি ও ঐতিহ্যের বাহক। মন্দিরের সেবায়েতদের জন্য তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করেন। বর্তমানে এই মন্দিরে প্রতিদিন শ্যামাপূজার পাশাপাশি নারায়ণ ও শিবপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
পাঁজিয়া বাজার দীঘি: সামন্ত প্রভুরা বিভিন্ন কারণে প্রজাদের উপর অত্যাচার করত। কিন্তু তারা প্রজাসাধারণের জন্য কিছু কিছু জনকল্যাণ মূলক কাজও করত। এই জনকল্যাণমুলক কাজের প্রথমেই প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট নিবারণের জন্য বড় পুকুর বা দীঘি খনন করত। এটা তাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। নূতন বাড়ীর কর্তা ব্যক্তি তারিণী কান্ত বসু সেই ভাবনায় পাঁজিয়া বাজার সংলগ্ন একটি বড় দীঘি খনন করেন। এই দীঘির উত্তর পাড়ে বিরাট শান বাঁধানো ঘাট ছিল। ঘাটের উপর জমিদারদের হাতি বাঁধা থাকত। দীঘিটি আজ হাজামজা হয়ে কালের স্বাক্ষী বহন করছে।
কংগ্রেস অফিস: ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষ কোম্পানীর শাসন থেকে সরাসরি ইংল্যান্ডের শাসনের অধীনে চলে যায়। ইংরেজরা ভারতবাসীর মনোভাব জানার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভবন করে। ইংরেজদের এই ভাবনাটিকে ভারতবাসী ইতিবাচক মনে করে এবং তারা রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। এ সময় ১৮৮৫ সালে অক্টোভিয়ান হিউম ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাঁজিয়াতেও কংগ্রেস অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান তহশীল অফিসের স্থানে পাঁজিয়া কংগ্রেস অফিস ছিল। পাঁজিয়ার কংগ্রেস নেতাদের ভিতর প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্য প্রমোদ বসু ওরফে বিল্লে বসু, অধীর বসু, বিনোদরিহারী গাঙ্গুলী, সুবোধ ঘোষ, কমলা ত্রিম, মাদারী ঘোষ, বৌদি ঠাকুরূপ, কুসুম কুমারী, হরিপদ বোস প্রমুখ। এই কংগ্রেম অফিসের উদ্যোগে একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অনাথ আশ্রমের সংগে দরিদ্র ভান্ডার খোলা হয়। উল্লেখিত কংগ্রেস নেতাদের তত্ত্বাবধানে চরকা, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আইন অমান্য, ইংরেজ ভারত ছাড়, বঙ্গভঙ্গরদ প্রভৃতি আন্দোলনের কর্মসূচী এই পাঁজিয়ায় পালিত হত। বর্তমানে কংগ্রেস অফিসের অস্তিত্ব আর নেই।
দূর্গা ও বাসন্তিপূজা উৎযাপন: দেশ বিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ায় ১ কিলোমিটারের ভিতর বাড়ী বা পাড়ায় ১৩/১৪ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে পূজা উৎযাপন করা হত। তৎকালে এত অল্প জায়গায় এমন সাড়ম্বরপূর্ণ দূর্গাপূজা উৎযাপন বিরল দৃষ্টান্ত। এ সময় পাঁজিয়া অঞ্চলের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনন্দ উপভোগ করত। জমিদার বাড়ীর পূজায় মুসলিম প্রজাদেরও পাঁঠা প্রদানের রেওয়াজ ছিল বলে শোনা যায়। দেশ বিভাগের পর পাঁজিয়ায় ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে দূর্গাপূজা উৎযাপিত হত। রবি কুমার সরকারের বাড়ী সংলগ্ন পাঁজিয়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দির, ডাক্তার সুশীল কুমার বোস ও পূর্ব পাড়ার বোস বাড়ীর পুরানো মন্দিরে। বর্তমানেও প্রতিবছর ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ডাক্তার সুশীল কুমার বোসের বাড়ী হাত বদল হয়ে পাঁজিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ইন্তাজ আলী গাজী বাস করছেন। ডাঃ সুশীল বাবুর বাড়ীর পূজা বন্ধ হলেও পাঁজিয়া কালী মন্দিরে নূতন করে দূর্গা পূজা হওয়ায় ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। জমিদারী আমলে নূতন বাড়ীতে ধূমধামের সাথে বাসন্তি পূজা অনুষ্ঠিত হত। নূতন বাড়ীর প্রতিমা বড়েঙ্গা খেয়াঘাটের স্থানে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হত।
নাট্য সমাজ : ১৩১৪ সালে পাঁজিয়ার নাট্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় নেপাল চন্দ্র মিত্রের নেতৃত্বে। জমিদারী আমলে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাট্য সমাজ সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে প্রতিবছর দূর্গাপূজার সময় যাত্রাপালা, নাটক, কীর্তন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মঞ্জায়িত হত। পাঁজিয়ার চতুর্পার্শ্বের গ্রাম থেকে অসংখ্যা নাটক ও যাত্রাপালা উপভোগ করার জন্য আসত।
উভয় জমিদার বাড়ীর সংশ্লিষ্ট সহায়তায় নাট্য সমাজ পরিচালিত হত। এক সময় পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ ধীরাজ ভট্টাচার্যের সংস্পর্শে এলে নাটকের পালে হাওয়া লাগে। প্রতি বছর ধীরাজ পূজার সময় পাঁজিয়াতে এসে কোলকাতা কেন্দ্রিক গঠিত নাট্য সমাজের সক্রিয় সহযোগীতায় যাত্রাপালা, নাটক মঞ্চায়িত করতেন। কলিকাতায় ধীরাজ তখন নামী-দামী অভিনেতা। সিনেমার নায়ক হিসবে ধীরাজের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় পাঁজিয়ার নাট্যমঞ্চে ধীরাজকে অভিনেতা হিসেবে স্বশরীরে দেখা লোকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করত। ধীরাজ পাঁজিয়ায় আসলে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। ধীরাজ আসা বন্ধ করলে পাঁজিয়ার নাট্যসমাজও ঝিমিয়ে পড়ে। পশুপতি বসুর দাদা পূর্ণচন্দ্র বসু মারা গেলে পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এসময় নাট্য সমাজের সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন গোপাল ঘোষ (হৃদ), রবি কুমার দাস, দীপক মজুমদার, প্রনব চৌধুরী (কাজল)।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পাঁজিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক আব্দুল মালেকের অনুপ্রেরণায় পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ আর একবার ক্ষণিকের জন্য হলেও কিছুটা উজ্জীবিত হয়েছিল শের আলীর অভিনয়কে ঘিরে। ধীরাজের মত পেশাদার অভিনেতা না হলেও শের আলীর অভিনয় ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনিও বেশ কিছুদিন পাঁজিয়ার নাট্য সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে সময় সুঅভিনেতা মৃণাল কান্তি রায়, সোহরাব হোসেন, দেবাশীষ চক্রবর্তী, বসুদেব দেবনাথ, আনন্দ মহন বসু, আফছার উদ্দীন (ঘাঘা), ইমদাদ হোসেন (ঘাঘা), পাঁজিয়ার মিলন বসু, তাপস বসু, শম্ভুনাথ বসু, সুব্রত বসু, ইয়ার মাহমুদ, সমির দাস, রানজিৎ দেবনাথ, জয়দেব চক্রবর্তী, দীপক বসু, প্রমুখ অভিনয় করতেন। শের আলীর অভিনয় ছাড়ার পর থেকে অদ্যাবধি তেমন কোন ভাল নাট্যকর্মী পাঁজিয়া কেন্দ্রিক দেখা যায় না। আটচালা নাট্যমঞ্চটি এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে উপনীত।
পাঁজিয়া কালীবাড়ী মাঠ : পাঁজিয়া কালীবাড়ীর উত্তর পার্শ্বে বিশাল মাঠটি কালীবাড়ী মাঠ নামে পরিচিত। বহুকালের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী এই মাঠ। এই মাঠে খেলা-ধুলা, সংস্কৃতি চর্চ্চার পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা, জনসভা ও গণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪০ সালে ৪র্থ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পাঁজিয়ার কৃষকনেতা সুনীল বোস ও তার সহকর্মী সুধীর মিত্র, অধীর ঘোষ, অধীর ধর, প্রমুখের নেতৃত্বে এই কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন শম্ভু বসু ও সহ অধিনায়ক অনন্ত মিত্র।
এই সম্মেলনে প্রায় ৫০ হাজার কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সর্বভারতীয় কৃষক নেতা, পি সি যোশী, হক সাহেব, ভবানী সেন, মোঃ ইসমাইল, মহিতোষ চৌধুরী, নওশের আলী প্রমুখ। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনেও পাঁজিয়া ও কালীবাড়ীর মাঠের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দেশবিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ার কংগ্রেসের নেতৃত্বে এই মাঠে চরকা আন্দোলন, ইংরেজ ভারত ছাড়, বঙ্গভঙ্গ রদ প্রভৃতি আন্দোলনে পিকেটাররা পিকেটিং করত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনেটর নির্দেশক্রমে সার্ভেয়ার র্যাডক্লিফ দেশ ভাগের যে সিমানা নির্ধারণ করেন প্রথম দিকে পাঁজিয়া অঞ্চল হিন্দু স্থানের ভাগে পড়েছে জেনে স্থানীয় পাঁজিয়ার শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি মহলের অনেকে এই মাঠে খোলা ছাতা উপরে ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। পরে খবর আসে পাঁজিয়া অঞ্চল পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে, তখন তারা মর্মাহত হন। কেউ কেউ দু’একদিনের ভিতর পাঁজিয়া অঞ্চল ত্যাগ করে হিন্দুস্থান অংশে চলে যান। এই মাঠে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় টিমের সংগে পাঁজিয়া টিমের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ খেলায় পূর্ব পাকিস্তান টিমের দ্বিতীয় গোলরক্ষক অনাথ পাঁজিয়া টিমের পক্ষে খেলেছিলেন। অমলেন্দু বিশ্বাস রচিত চেনা মুখ অচেনা মানুষ গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই মাঠে কলকাতার মোহন বাগান ফুটবল টিমের সংগে মশিহাটী ফুটবল টিমের খেলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এই মাঠে ক্রিকেট খেলা হত।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুজ পাঁজিয়ার এই মাঠে বিশাল জনসভা করেন। ১৯৭১ সালে পাঁজিয়া অঞ্চলের শতাধিক যুবক এই মাঠে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষণ দানের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য হাবিলদার ক্লার্ক চাঁদের আলী মহালদার। যাঁর বাড়ীছিল মাদারডাঙ্গা গ্রামের বর্তমান ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে। তাঁর জন্ম ১৯২২, মৃত্যু ১৪/৬/১৯৮৫। ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর বাড়ীতেই সবসর জীবন-যাপন করছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহোরের খাড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে অবসর নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন গ্রামের কয়েকশত তরুণ এই প্রশিক্ষণে যোগদান করে। তাঁকে সহয়তা করেন ল্যান্সনায়েক আব্দুল মবিন। তাঁর বাড়ী কুমিল্লা জেলার বরুরা থানায়। কিন্তু যুদ্ধে যাবার সময় অর্থাৎ আব্দুল মবিনের নেতৃত্বে মাত্র ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা যাত্রা করে। এটাই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাঁজিয়া মুক্তিযুদ্ধের।
১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগীয় স্ব-নির্ভর অনুষ্ঠান পাঁজিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় মাহাবুবুল আলম চাষী ও তার সফর সঙ্গীরা ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসে এই মাঠে অবতরণ করে। ৩ দিন ব্যাপী ঐ অনুষ্ঠান সফল করার জন্য তৎকালে কেশবপুর কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক নাসির উদ্দীন ও পাঁজিয়ার প্রণব চৌধুরী (কাজল) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঐ কর্মযজ্ঞে বিভাগীয় পর্যায়ের সকল দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তা অংশ গ্রহণ করে।
পাঁজিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: দেশবিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ার প্রায় সকল ঐতিহ্য গড়ে ওঠে নূতন ও পূর্বের বাড়ী ঘিরে। জমিদার ও পূর্বে আলোচিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও পাঁজিয়ার যে সকল ব্যক্তি তাদের কর্মকান্ডের জন্য মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন তারা হলেন নারায়ণপুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠাতা জমিদাতা হরিপ্রসসন্ন বসু, কাটাখালি হাটের প্রতিষ্ঠাতা অম্বিকা চরণ বসু, পাঁজিয়া নাট্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা নেপাল চন্দ্র মিত্র, পাঁজিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট যতীন্দ্র নাথ মিত্র, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ললিত মোহন ঘোষ, যামিনী সরকার, আওয়াল সরদার, ইউসুফ সরদার ও রবি কুমার সরকার। আরও যে সকল মানুষ মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে উকিল বিনয় বসু, চারুচন্দ্র মিত্র, অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট বিজয় কৃষ্ণ সরকার, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ক্যাপটেন ডা: কে কে সরকার।
চিত্র অভিনেতা ও সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য, লেখায় পাঁজিয়াকে তুলে ধরেছেন মনোজ বসু; ডা. হিমাংসু বসু, পশুপতি বসু, জিনিতুল্য বিশ্বাস প্রমুখ। বৃটিশ আমলের শেষ দিকে জমিদারী অধিগ্রহণের পর জমিদারদের মর্যাদা ফিকে হয়ে আসে। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হলে জমিদারী প্রথার বিলোপ হয়। এ সময় এদেশের প্রায় সকল হিন্দু জমিদাররা দেশ ত্যাগ করে হিন্দুস্থান ভাগে চলে যায়। পাঁজিয়াও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। নূতন বাড়ীর জমিদারদের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আমাদের জানিয়েছিলেন পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মরহুম ফজলুল করিম সাহেব।
তিনি বলেছিলেন পাঁজিয়ার বাবুদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন পশ্চিম সারুটিয়া গ্রামের (কৃষ্ণনগর) কাজেম আলী সরদার ওরফে কাজেম গুরু। কাজের গুরু সম্পর্কে তিনি একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। ঘটনাটি হল প্রতি বছর পূজার সময় জস্টিস রমেশ চন্দ্র বসু কাজেম গুরুকে ধূতি গেঞ্জি উপহার দিতেন। তাই বাবুর (রমেশ চন্দ্র বসু) নায়েব বাবুর কাছে কারণ জানতে চাইলে বাবু নায়েবকে তার পায়ের পিছনের হাঁটুর নিচে একটি কাটা দাগ দিখিয়ে বলেছিলেন, ঐ কাটা দাগটি কাজেম গুরুর লাটির আঘাটেতর চিহ্ন। তিনি তার নায়েবকে আর বলেছিলেন, গুরুর লাঠির দাগ থাকার জন্য তিনি বিচারক হতে পেরেছেন।
তাই তিনি গুরুভক্তির নিদর্শন হিসেবে কাজেম গুরুকে প্রতি বছর পূজার সময় ধূতি-গেঞ্জি উপহার দেন। পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে কাজেম গুরু পাঁজিয়ার বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে শিক্ষাদান করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে ফজলুল করিম সাহেব জানিয়েছিলেন, তার পিতাও কাজেম গুরুর ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যিক মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘সেই গ্রাম সেই সব মানুষ’ গ্রন্থেও কাজেম গুরুর পাঠশালার কথা উল্লেখ আছে। তৎকালে আইন-আদালতের ভাষা ছিল ফার্সী। ধারণা করা হয় পাঁজিয়া সে সকল ব্যক্তি কোর্ট কাছারী, আইন-আদালতের সংগে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন তারা ফার্মী শেখার জন্য কাজেম গুরুর কাছে লেখাপড়া করত। কাজেম গুরু ফার্সী ছাড়া বাংলা, ইংরাজী অংক জানতেন বলে তার উত্তর পুরুষদের কাছ থেকে জেনেছি।
বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে পাঁজিয়ার মাটিতে অনেক নামী-দামী লোকের পদচারণা ছিল। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে কেশবপুর থেকে বাই-সাইকেল যোগে পাঁজিয়াতে আসেন। পাঁজিয়ার পশুপতি বোসের সংগে তার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। রবি কুমার সরকারের সংগেও তার পরিচয় ছিল। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কয়েক বার পাঁজিয়াতে এসেছেন। একটি বর্ণনায় ১৯৭৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান পাঁজিয়ার আসেন বলে উল্লেখ থাকলেও নিরপেক্ষ সূত্র থেকে তা সমর্থিত হয়নি। দেশ বিভাগের পর পাঁজিয়া তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে থাকে। পাকিস্তান আমলে রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসু যথেষ্ট সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের ভিতর পশুপতি বসু ছিলেন অন্যতম। শ্রদ্ধার সাথে আজও কলেজ লাইব্রেরীতে তাঁর ছবি বাঁধানো আছে। কেশবপুর থানা ও জেলা সদরে সকল অফিস আদালতে রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসুকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হত। রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসু সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। রবি কুমার সরকারকে আধুনিক পাঁজিয়ার রূপকার বল্লেও অত্যুক্তি হয় না। ১৯৬৫ সালে তিনি পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার চেষ্টায় পাঁজিয়াতে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। তিনি পাঁজিয়া সবুজ বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ।
তিনি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ীর (নূতন বাড়ী) ইট দিয়ে পাঁজিয়া কেশবপুর রাস্তা পাকা করেন। এছাড়া পাঁজিয়া গ্রামের অলিগলি রাস্তা তার সময় পাকা হয়। তার নেতৃত্বে নূতন বাড়ীতে ১৯৬৪ সালে হাইস্কুল নির্মাণের জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়। যশোর জেলার প্রায় সকল বিশিষ্টজনরা চেয়ারম্যান রবি কুমার সরকারকে চিনত। আজও এলাকার সিংগভাগ লোক শ্রদ্ধার সংগে রবি কুমার সরকারের কর্মকাণ্ডকে স্মরণ করে। ১৯৬৫ সাল হতে ১৯৭৭ সাল প্রায় এক যুগ ধরে রবি কুমার সরকার পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৭ সালে পাঁজিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক ফজলুল করিম পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রবি কুমার সরকারের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসু পুনরায় পাঁজিয়াকে পুনঃগঠনে সচেষ্ট হন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি ছিল। এ সময় দক্ষিণ বাংলায় বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসুর বাড়ী লুঠ করা হয়। এই লুঠপাটের ঘটনা তাদের মনে দারুণ রেখাপাত করে। সবকিছু ভুলে নিজেদের সামলিয়ে নিয়ে পুনরায় পূর্বের ন্যায় চলার চেষ্টা করছিলেন। এমনি সময় ১৯৭৭ সালে উভয় বাড়ী পুনরায় লুটেরাদের হামলায় শিকার হয়। ঘটনার পূর্বাভাস পেয়ে প্রশাসনের সহায়তায় রবি কুমার সরকারের বাড়ীতে পুলিশ প্রহবার ব্যবস্থা করা হয়। ঘটনার দিন লুণ্ঠনকারীর ডা. অজিত কুমার ঘোষের ছেলে নুপুর ঘোষের সহায়তায় বাড়ীর সদর দরজা খোলার চেষ্টা করেন। ওই সময় পুলিশের গুলিতে নুপুর ঘোষ নিতহত হলে লুঠকারীরা রবি কুমার সরকারের বাড়ী লুঠ করতে ব্যর্থ হয়; তবে পশুপতি বসুর বাড়ী তারা লুট করে। লুটেরারা শতশত গরুর গাড়ীতে ধান-চাউল, কলাই-মুসুরীসহ যাবতীয় লুঠের মালামাল নিয়ে উত্তর-পূর্ব, ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে চলে যায়। এমন লুঠ-পাটের ঘটনায় এলাকার সকল গৃহস্ত পরিবারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরই প্রেক্ষাপটে রবি কুমার সরকার দেশত্যাগের সংকল্প গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৭ সালে সরকারী পর্যায়ে বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতে চলে যান। অপর দিকে পশুপতি বসু সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে জীবনের শেষ কটা দিন জন্মভূমিতে পার করার চিন্তার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। পাঁজিয়া এবার সত্যি সত্যি ছন্নছাড়ায় পরিণত হয়। দিনতো বসে থাকে না। ১৯৮৪ সালে এন্তাজ আলী গাজী পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সাধারণ মানুষের ভিতর আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
১৯৮৮ সালে গড়ভাঙ্গা গ্রামের মুকুন্দ মুরারী কুন্ডু পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ইউনিয়ন পরিষদ স্থানান্তরের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পুনরায় পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এন্তাজ আলী গাজী।
পাঁজিয়া বাজার মসজিদ:
১৯৬৩ সালে পাঁজিয়া বাজার দীঘির পশ্চিম পাড়ে বাজার মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই
মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল লতিফ সরদার, কাসেম
আলী সরদার ও আব্দুল গাজী। এই মসজিদ তৈরীতে ডাক্তার আব্দুল কাদের সরদার ও
পরশউল্যা সরদার অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছেন।
তাদের সংগে সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসেন গোলাম
মোস্তফা ও সুলতান মৌলবী। এদের চেষ্টার পাশাপাশি তৎকালীন পাঁজিয়ার সি,ও এর
সার্ভেয়ার জাহাতাপ উদ্দীনের আত্মীয় পাঁজিয়া তহশীল অফিসের নায়েব কেরামত আলী
মিয়ার সরকারী জমি বরাদ্দ পাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগীতার আশ্বাসের
প্রেক্ষিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠার কাজটি দ্রুত অগ্রসর হয়।
প্রথমে ১০ শতাংশ জমি নিয়ে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মসজিদ তৈরীর সময় প্রথম মিস্ত্রি ছিলেন মনিরুদ্দিন। মসজিদ প্রতিষ্ঠায় প্রথম খুঁটি গেড়ে মসজিদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন ডাক্তার আব্দুল কাদের সরদার ও পরশউল্যা সরদার। মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর এলাকার সকল মুসলমানদের সক্রিয় সহযোগীতায় মসজিদের উন্নয়ন হতে থাকে। প্রথম ৩ বছর মসজিদটি ছিল পাঞ্জেগানা, পরে জামে মসজিদ করা হয়।
বর্তমানে মসজিদটির নামে ১৬ শতাংশ জমি রেকর্ড আছে। এখন মসজিদটি দোতলা হলেও জুম্মার দিন মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় মসজিদের চত্বরটিও ১ তলা তৈরীর নির্মাণ কাজ চলছে। ১৯৮৪ সাল থেকে অদ্যাবধি এই মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন চেয়ারম্যান এন্তাজ আলী গাজী। তার নেতৃত্বে মসজিদের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। একই দীঘির পূর্বপাড়ে কালী মন্দির ও পশ্চিম পাড়ে জামে মসজিদ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধার এমন উজ্জ্বল উদাহরণ গ্রাম বাংলায় সত্যিই বিরল।
পাঁজিয়া ক্বওমী মাদ্রাসা: পাঁজিয়া দারুল উলুম ক্বওমী মাদ্রাসাটি ১৯৫৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা নওয়াপাড়ার পীর সাহেব আব্দুল মজিদ শাহ্। এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় যারা সহায়তা করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হাজী আব্দুল গফুর, ধোনাই গাজী ও রবি কুমার সরকার। এছাড়া বাদল সরকার, কিনু মুন্সী, সনু মুন্সী, আব্দুস সবুর মুন্সী, কাদের মুন্সী, ডাক্তার আব্বাস আলী, আহমদ সানা প্রমুখ। রবি কুমার সরকারের সংগে পীর সাহেবের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠায় রবি কুমার সরকারের অনেক দান আছে। বর্তমানে মাদ্রাসাটি কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলে দীন শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান।
পাঁজিয়া মহাবিদ্যালয়: পাঁজিয়ার নূতন বাড়ীর উত্তর পুরুষ রবি কুমার বসু ও সুধারানী বসু ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে এই বাড়ীতে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শর্তসাপেক্ষে ৫ একর ৮৭ শতাংশ জমি দান করে যান। শর্তানুযায়ী স্কুলের সেক্রেটারী রবি কুমার সরকারের নেতৃত্বে ১৯৬৫ সালে একটি খ (এল) প্যাটার্ন পাকা ভবনও নির্মিত হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্কুল ভবন স্থানান্তরিত না হওয়ায় কিছু দিন জায়গা অভাবে পাঁজিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ঐ ভবনে পরিচালিত হয়। এরপর বালিকা বিদ্যালয় নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠিত হলে ভবনটি আবারও পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এন্তাজ আলী গাজী ও আব্দুল নঈমের নেতৃত্বে পাঁজিয়ার বিশিষ্ট জনেরা ১২ মার্চ পাঁজিয়া মহাবিদ্যালয় নূতন বাড়ীর পরিত্যক্ত ভবনে প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে কলেজটি এইচ, এস, সি মানবিক, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিভাগসহ ডিগ্রী, বিএ, বি,এস,এস ও বি, বি, এস পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে কলেজটিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ রুহুল আমিনসহ প্রায় অর্ধশত শিক্ষক কর্মচারী কর্মরত আছেন ও প্রায় ১ হাজার ২ শত শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করছে। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর পাঁজিয়ার হারান ঐতিহ্য অনেকাংশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে এক শুক্রবার ছুটির দিন নূতন বাড়ীর বংশধর ভারত প্রবাসী বোস পরিবার তথা রাজা পরেশ নাথের উত্তর পুরুষ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ড. হিমাংসু বসু তাদের পূর্ব পুরুষের বসত ভিটায় প্রতিষ্ঠিত কলেজটি পরিদর্শন করে খুব খুশি হন। ওই দিন জুম্মার নামাজের কারণে প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করে কেশবপুরে আমার সংগে তিনি সাক্ষাত করে আমাকে ধন্য করেছেন। সাক্ষাতের সময় তিনি এই কলেজের কৃতি শিক্ষার্থীদের পরেশ নাথ পদক প্রদান ও কলেজ লাইব্রেরীর জন্য বই প্রদানের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব ও পূর্ব পুরুষদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধার জন্য তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদঃ যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ০৭ নং পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদ একটি আদর্শ ইউনিয়ন পরিষদ। বহু জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিবর্গ এই পরিষদের প্রেসিডেন্ট বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই পরিষদের সভ্যগণের ভিতর অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। কেশবপুর কাটাখালী সড়কের উত্তর পার্শ্বে ও বাজারের পূর্বপার্শ্বে এই ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। বৃটিশ আমলের পঞ্চায়েত নাম ছিল। তখন পঞ্চায়েতের প্রধান পঞ্চায়েত প্রধান বলা হত। ১৯১৯ সালে পঞ্চায়েত নাম পরিবর্তন করে ইউনিয়ন বোর্ড নামকরণ করা হয়। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হত। সে সময় পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। ১৯৫৯ সালে ইউনিয়ন বোর্ড নামকরণ পরিবর্তন করে ইউনিয়ন কাউন্সিল করা হয়। ১৯৬২ সালের মেম্বারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন।
১৯৭৩ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিল বাতিল করে ইউনিয়ন পরিষদ নাম করণ করা হয় এবং তখন থেকে জনগণের সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান ও মেম্বার নির্বাচিত হতো। পাঁজিয়া ইউনিয়নের প্রেন্সিডেন্ট ছিলেন ললিত মোহন ঘোষ, যামিনী সরদার, আওয়াল সরদার, ইউসুফ সরদার ও রবি কুমার সরকার। ১৯৬৫ সালে দেশ ভাগের পর প্রথম চেয়ারম্যান রবি কুমার সরকার ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফজলুল করিম সরদার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এন্তাজ আলী গাজী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মুকুন্দ মুরারী কুন্ডু পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পুনরায় এন্তাজ আলী গাজী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ইয়ার মাহমুদ পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৩ সালে মাদারডাঙ্গা গ্রামের নিজাম উদ্দীন পাঁজিয়ার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের ১১ জুন ইউপি নির্বাচনে শিক্ষক মকবুল হোসেন (মুকুল) পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ায় সারাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সংগে ই-সেবা কেন্দ্র চালু হওয়ায় জনসাধারণ দরকারী সেবা এই কেন্দ্র থেকে পাচ্ছে। পাঁজিয়া ই-সেবা কেন্দ্র চালু হয় ১০/১১/২০১০ সালে। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে রয়েছে মনোহরনগর গ্রামের মেঃ আব্দুর রাজ্জাক। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী পাঁজিয়া গ্রামের লোকসংখ্যা ৩৫০২ জন। এরমধ্যে মহিলা ১৬৭৭ জন। হিন্দু ও মুসলমানদের শতকরা হার যথাক্রমে ২০% ও ৮০%, শিক্ষার হার ৬৫ ভাগ। মাদারডাঙ্গা গ্রামের জনসংখ্যা ৩২৪০ জন। এর মধ্যে মহিলা ১৪৮৫ জন। শতকরা মুসলমান ৬৫ ভাগ ও হিন্দু ৩৫ ভাগ। শিক্ষার হার শতকরা ৮২ ভাগ। মনোহরনগর গ্রামের জনসংখ্যা ৪৮০৭ জন। এর মধ্যে মহিলা ২২৯৫ জন। শতকরা মুসলমান ৭২ ভাগ ও হিন্দু ২৮ ভাগ। শিক্ষার হার শতকরা ৮০ ভাগ। পাঁজিয়া, মাদারডাঙ্গা ও মনোহরনগরের লোকসংখ্যা ১১,৫,৪৯ জন। উল্লেখিত ৩টি গ্রামের আয়তন ৩ বর্গকিলোমিটার।
৩ বর্গকিলোমিটার জনপদের মানুষ ছাড়াও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু কিছু মানুষ পাঁজিয়া গ্রামের পরিচয় বলে থাকে। এই জনপদের প্রায় ১৫,০০০ মানুষ পাঁজিয়া পরিচয়ে পরিচিত। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পাঁজিয়ার ভূমিকা প্রশংসনীয়। মনোহরনগর গ্রামের মকছেদ আলী গাজী সংস্কৃতি অঙ্গনে দীর্ঘদিন অনুপ্রেরণা জুড়িয়েছেন। অনেক ছন্দপতনের পরও এই জনপদটি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যশোর জেলার খ্যাতিমান গ্রামের তালিকায় পাঁজিয়া নাম শীর্ষে বল্লেও অত্যুক্তি হয় না। আগামী দিনে পাঁজিয়া তার অতীত মর্যাদা অনেকাংশে উদ্ধার করতে পারবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে এই জনপদের ইতিকথা লেখা শেষ করলাম।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।
]]>সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব অনুপম ইসলামের সংগে গল্প সংখ্যা ঘাসফুল নিয়ে সেপ্টেম্বর’১৬ প্রথম সপ্তাহে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর তার রচিত গ্রন্থসমূহ নিয়ে কাজ করার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি আ’হুজার কোন গ্রন্থ নিয়ে কাজ করতে চাই কিনা? ইতিপূর্বে আমি আহুজার “ডহরী” উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে বলেছিলাম সময় সুযোগ হলে চেষ্টা করে দেখব। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর ঠিক করলাম কষ্ট করে হলেও কাজটি আমি করতে চাই। কারণ মাস তিনেক আগে জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে “সুন্দর বনের লোকজীবন” বইটি আমার কাছে পাঠান। ঠিক করলাম এই বইটির উপরই কাজ করব। আমার সিদ্ধান্তটা ফোন করে রফিক ভাইকে জানাতেই তিনি খুশি হলেন। বইটি আমার বই এর আলমারিতে ছিল। পড়ার উদ্দেশ্যে বইটি বের করলাম।
সুন্দর অফসেট কাগজে ছাপানো বইটি। প্রচ্ছদ বরাবরের ন্যায় চারুপিটুর করা। প্রচ্ছদের উপরিভাগে বৃক্ষরাজির নিচে জনা চারেক পুরুষ, দু’জন মহিলা ও এক পাশে বাচ্চা কোলে দাড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে একটি মেয়ে একখানা পুস্তক সাদৃশ্য মেলে ধরে শ্রোতা-দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কভার পেজটি অবসেটের পুরু কাগজের উপর রঙ্গিন ছবিটি দারুন দেখাচ্ছে। ১১২ পৃষ্ঠার বইটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটি ৮৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় খণ্ডটি মাত্র ২৪ পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। প্রথম খণ্ড ২২টি পর্বে এবং দ্বিতীয় খণ্ড পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। উপন্যাসটির প্রকাশ কাল বই মেলা ২০১৫। বই-এর স্বত্ব সংরক্ষিত লেখক দ্বারা। ঢাকার শাহবাগের ৪৭ আজিজ মার্কেটের নিচতলা পলক প্রকাশনী উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন। বইটির মুদ্রণ হয়েছে ঢাকার নিউ মার্কেটের অপরপারে ১৪৭-১৪৮ গাউছুল আজম সুপার মার্কেটের ফাগুন এ্যাডভাটাইজিং থেকে। উপন্যাসটির মূল্যমান রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা। সুন্দর অপসেটে ছাপানো উপন্যাসটির ধার্যকৃত মূল্যমান যথার্থই নির্ধারণ করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের নিজ আবাসিক এলাকা তথা ঝাঁপা বাওড় এলাকার বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ লেখকের বন্ধুবর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুস সাত্তার ও তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী জনাবা মিসেস নাছিমা আখতার (জুঁই) দম্পতিকে। লেখক এবং এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঝাঁপা বাওড়ের পাশের মানুষ। এদের জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে আছে ঝাঁপা বাওড়ের প্রভাব। এ অঞ্চল আমারও খুব ভাল লাগে। আমার ভাল লাগার একটা কারণ হল ২০১৪ সালের মে মাসে সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদ কর্তৃক “ঝাঁপা” পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ঐ পত্রিকার মূল প্রবন্ধ লিখতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়ায় লেখার প্রয়োজনে আমাকে কয়েকবার ঝাঁপা বাওড়ের চার পাশের গ্রামগুলোতে তথ্য সংগ্রহের জন্য যেতে হয়েছে। ঐ পত্রিকায় লেখা আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “ঝাঁপা জনপদের ইতিকথা”। তথ্য সংগ্রহের সময় ঝাঁপা বাওড় ও তার চার পাশের গ্রামগুলোর যে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছি তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। উপন্যাসটি উৎসর্গের ব্যাপারে লেখক যে ব্যক্তিদ্বয়কে বেছে নিয়েছেন, আমার মতে লেখকের সিদ্ধান্তটা ছিল যথার্থ।
উৎসর্গ পাতার পরবর্তী পাতায় লেখক পূর্বাভাস লিখেছেন। সেখানে “সিডর, আইলা ও নার্গিসের” মত মহা-সাইক্লোনে সমুদ্র উপকূলবাসির উপর দিয়ে যে ভয়াবহ ও করুণ পরিনতি বয়ে যায় তার একটা প্রাথমিক ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে উল্লেখিত সাইক্লোন সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকা পাঠকের জন্য উপন্যাস পাঠের পূর্বেই প্রাথমিক ধারণা নিয়ে পাঠের বিষয় সহজেই হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে সাহায্যে করবে। পাশা-পাশি বন্যা ও সাইক্লোনের সময় ঐ এলাকার নদী ও গ্রাম গুলোর নাম উল্লেখ করে পাঠককে গ্রাম ও নদী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি এই অংশে লেখককে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে যেসব মানুষ সহায়তা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করে তাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে লেখক বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। মুখবন্ধে লেখক সমুদ্র উপকূলীয় অংশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষ আদিবাসি ও নিম্নবর্ণের মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে কোল, দ্রাবিড়, আর্য, তুর্কি, মুঘল, বৃটিশ, জমিদার, সামান্তপ্রভু থেকে আজ পর্যন্ত এখানে বসবাসকারী মানুষদের আদি বাসস্থান ছেড়ে দুর্গম এলাকায় এসে বসবাস করার সংক্ষিপ্ত পূর্বকথা তুলে ধরে ইতিহাসের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। লেখকের নিরলস কষ্ঠার্জিত সত্য উৎঘটনে তার প্রচেষ্ঠা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল তথা যশোর-খুলনা অঞ্চল এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। আজও কেশবপুর-মণিরামপুর অঞ্চলের মাটি ১০/১৫ ফুট খুঁড়লেই মাটির নিচে বড়-বড় গাছের গুড়ি পাওয়া যায়। এ ছাড়া কোন কোন এলাকায় বাঘসহ অন্যান্য জীব-জানোয়ারের কঙ্কালও পাওয়া গেছে। সুন্দরবন ক্রমান্বয় দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে। অতীতে সুন্দরবন অঞ্চল আবাদ করার জন্য ভারতের বিহার রাজ্যের রাঁচি ও ছোট নাগপুর থেকে সাহসী, কর্মঠ, সৎ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিদের নিয়ে আসেন তৎকালিন শাসকশ্রেণী ও তার সহযোগীরা। এরা হল মুণ্ডা সম্প্রদায়। একটি তথ্য থেকে জানা যায় মুণ্ডা সম্প্রদায়ের যে ব্যক্তি এদেশে আসেন তার নাম ‘পাগল সরদার’। তারপর ছোট ছোট দলে এরা এসে দেশের সুন্দরবনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এদের জীবন আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক, প্রশাসনিক, সাংষ্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের পাশাপাশি এ দেশের দরিদ্র মুসলমান ও শুদ্র শ্রেণী নিয়ে আবুল হুসাইন জাহাঙ্গির “সুন্দরবনের লোকজীবন” উপন্যাস রচনা করেছেন।
সুন্দরবনের লোকজীবন উপন্যাসে তৃতীয় অধ্যায়ে ঔপন্যাসিক কয়েকটি বাক্যে যে মন্তব্য করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনি বলেছেন, “চারিদিকে নদী ও বন। গভীর সমুদ্র ও গহীন অরণ্য। গাবুরা জোড়াশিং আংটিহারা বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ জনপদ। এরপর তেপান্তরের মাঠ নেই, জনপদ নেই। শহর, গ্রাম, হাটবাজার নেই। কিন্তু মানুষ আছে। হিন্দু মুসলিম ও পৃথক জাতিসত্তার কর্মঠ কর্মজীবী মানুষ জন। যাদের জীবন-জীবিকা নদী ও বন নির্ভর। এখানে যে মানুষগুলো বাস করে তাদেরকে এই সব গ্রামের সন্তান না বলে প্রকৃতির সন্তান বলাই ভালো।” এই অংশে লেখক কোন সুনির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর কথা না বলে সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলিম, রাজবংশী, মুণ্ডা, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বুনো ও বগদি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পরিশ্রমী মানুষের কথা বলেছেন।
এই গ্রন্থে লেখক মুণ্ডা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক,পালা-পার্বন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রীতিনীতি-আচার অনুষ্ঠানের খুটিনাটি বিষয়গুলি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি প্রয়োজনে অন্য গোষ্ঠী বা সম্পদায়ের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় অতি সুন্দর ভাবে তুলে আনা লেখকের একটা বড় গুন। যেটা লেখক আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীরের ভিতর বরাবরই লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিকতায় অনেক কথ্য ভাষাও তিনি সাবলিলভাবে ব্যবহার করেন। তিনি মেস্কিকিয়ান পাদ্রীর ফাদার লুইজি পাজ্জী এস এক্স- কে তার দুই যুগেরও অধিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে যাচ্ছেন তার স্বীকৃতি এই গ্রন্থে দিয়ে গ্রন্থটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এই সুযোগে আমিও ঐ মহান ব্যক্তিকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাচ্ছি। প্রায় ২৪/২৫ বছর পূর্বে তার চুকনগর অবস্থান কালীন সময়ে বার দুয়েক তার সংগে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে তার হয়তো আমাকে মনে নেই; কিন্তু আমি তাকে শ্রদ্ধার সংগে মনে রেখেছি। তার শারীরিক ও মানুষিক সুস্থতার পাশাপাশি দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
লেখক এই গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে কারণে-অকারণে হাঁড়িয়া মদের প্রসঙ্গ এনেছেন। একই অনুষ্ঠানের বর্ণনা একাধিক জায়গায় একাধিক বার ব্যবহার করে বই-এর কলেবর বৃদ্ধির প্রয়াস লক্ষনীয়। প্রবাদ আছে-‘চালে কাঁকর আর সাহিত্যে নগ্নতা থাকলে তা সহজেই বিকোয়।’ মনে হয় লেখক এই প্রবাদটা জানেন। তাই তিনি মাঝে মাঝে আদিরসে কোথাও কোথাও সিক্ত করেছেন। যেমন-১৩ অধ্যায়ের শেষাংশে “জয়মনি ধনিয়ার দেয়া অঙ্গাবরণ অন্ধকারে খুলে জয়কৃষ্ণকে কাছে টেনে নিল। জয়কৃষ্ণ আঠার মত জয়মণির শরীরের সংগে লেগে রইল। ওয়াগানটা একটু একটু করে কাঁপতে লাগল। … …….. জয়কৃষ্ণ হাঁফাতে লাগলো। জয়মনি বললো, উঠো না। আর একটু থাকো।…………….ওয়াগনের মধ্যে ভূতুড়ে অন্ধকারে জয়কৃষ্ণ মুণ্ডা ও জয়মনি মুণ্ডা নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র খুঁজতে থাকে।” এরপর ১৬” অধ্যায়ে লিখেছেন “রাতে রামকৃষ্ণ লক্ষ্মীকান্ত ও সীতা একসঙ্গে হাঁড়িয়া মদ টেনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছিল নেশার ঘোরে। লক্ষ্মীকান্ত বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকছে। হুঁশ জ্ঞান নেই। প্রায় সারারাত লক্ষ্মীকান্তর বাহুডোর বিছিন্ন সীতারানী মুণ্ডা রামকৃষ্ণের সঙ্গে আদি ক্রীড়ায় মত্ত হয়ে রতি বিলাসে মগ্ন ছিল। নেশামগ্ন ঢুলু ঢুলু নয়নে অবিশ্রান্ত রতিবিলাসে কান্ত সীতারানী মুণ্ডা বিস্রস্ত বেশবাসে আলুলায়িত চুলে সিঁদুর লেপটানো কপালে ঢুলে ঢুলে পড়ে।” এখানে সীতারনী মুণ্ডা ও রামকৃষ্ণ মুণ্ডার উলঙ্গ পরকীয়ার রূপ ফুটে উঠেছে। একই অধ্যয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে- “সতীচ্ছদ পর্দা ছিড়ে সেই আদিম প্রবৃত্তির কালে রক্তের স্রোত ধারা নেমেছিল যোনিদ্বার দিয়ে তবুও রামকৃষ্ণ ছাড়েনি। একই রাতে হাঁড়িয়া মদের নেশার প্রাচুর্যে রামকৃষ্ণ জ্ঞান গরিমা ভুলে অবিরাম ধর্ষণ করেছিল বালিকা বধুকে”। ‘১৮’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন- “জয়কৃষ্ণ ময়দার মত ছেনে চলেছে জয়মনির স্তনযুগল-দুমড়াচ্ছে মোচড়াচ্ছ।” এ ছাড়াও অনেক স্থানে তিনি সচেতন ভাবে আদি রসের প্রভাব ফেলার চেষ্ঠা করেছেন।
৫৭ পৃষ্ঠায় লেখক বলেছেন ‘ বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক মুণ্ডাদের গোষ্ঠীর মধ্যে অঘোষিত ভাবে স্বীকৃত।’-এই কথাটির উপর আমার চোখ আটকে গেল। এটা কোন সভ্য সমাজের কথা নয়। কোন সভ্য সমাজ এটা মেনে নিতে পারে না। যে সমাজে এমন একটি জঘন্য প্রথা প্রচলিত থাকে, তাকে সভ্য সমাজ বলা যাবে না। কথাটি যদি সত্যি হয় তাহলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে আমরা মুণ্ডা সমাজকে কেমন সমাজ বলতে পারি ? তবে এই গ্রন্থে লেখক এই একটি জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও এমন কোন কথা বলেননি, যার জন্য মুণ্ডা সমাজকে হেয় ভাবা যায়। আর যদি সত্য না হয় তা হলে আমি বলব এমন একটি উক্তির মাধ্যমে তিনি ঐ সম্প্রদায়কে আহত করেছেন। যেটা কোন লেখকের কাছ থেকে কাম্য নয়। আমি বিষয়টি নিয়ে মুণ্ডা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যক্তির সংগে যোগাযোগ করে তার ঐ বক্তব্যের সত্যতা পায়নি। রথিকান্ত ও কৃষ্ণপদ মুণ্ডার সংগে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করেছি। কৃষ্ণপদ মুণ্ডা সুন্দরবন আদিবাসি মুণ্ডা সংস্থার পরিচালক। তিনি লেখকের ঐ বক্তব্যের সংগে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে এমন বক্তব্য অবিশ্বাস্য। এমন ঘটনার কথা যদি লেখক জেনেও থাকেন, তবে সেটা বিছিন্ন ঘটনা। এমন ঘটনা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও ঘটতে শোনা যায়। তার অর্থ কি এই যে ঐ সম্প্রদায়ের সেটা স্বীকৃত! গ্রন্থটিতে লেখকের বড় দুর্বলতা এই যে, লেখক পাঠক টানতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই উপন্যাস পাঠ করতে পাঠক ক্লান্ত হয়েছেন। লেখক বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায় জোড়া-তালি দিয়ে দেখানোর চেষ্টার মাধ্যমে গ্রন্থের কলেবর বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
একটি বিষয় আমার খুব ভাল লাগল। আদিবাসি মুণ্ডা সমাজে “সাগাই” প্রথার মাধ্যমে বিধবারা আবার বিবাহ বন্ধনে আবাদ্ধ হতে পারে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দু সমাজে বিধবা বিয়ের প্রচলন হলেও অদ্যাবধি হিন্দু সমাজ তা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। বর্ণে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ থেকে নিম্ন-বর্ণের শুদ্র শ্রেণী পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু পরিবারে অগণিত বিধবারা বৈধব্যের বলিকাষ্ঠে আত্মহুতি দেয়। বাল্য বিধবারা বিবাহ কি তা বুঝে উঠার আগেই বৈধব্যের সাজে সারাটা জীবন কষ্টে কাটায়। অনেক বিত্তশালী পরিবার সমাজে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তির কথা বিবেচনা করে তাদের পরিবারের বিধবাদের বৃন্দাবন-কাশীধামে তীর্থ ক্ষেত্রে পাঠিয়ে সমাজে তাদের মুখ রক্ষা করেন।
সেখানে হিন্দু সমাজ সাদৃশ্য আদিবাসি মুণ্ডা সমাজ “সাগাই” প্রথার মাধ্যমে বিধবা বিয়ের ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল মানুষিকতার পরিচয় বহন করে। এছাড়া সিডর, আয়লার মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে হিন্দু- মুসলমানের পাশাপাশি অবস্থান করাকে সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন উন্নত মানসিকতার পরিচয় বহন করে । তেমনি বর্তমানেও ব্যাপক হারে বাল্য বিবাহ প্রথা চালু তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। আবহাওয়ার আগাম ব্যাখা ঐ জনপদে বসবাসকারি জনগোষ্ঠির আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিচারের জন্য প্রকৃতির পরিবর্তনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। এখানে- “ আদিনাথ সকলকে ডেকে বললো, ঝড় হবে তুফান। গোত্র প্রধান রাজকৃষ্ণ গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিল আগামবার্তা। আদিনাথ বললো, আকাশের দক্ষিণ দিকে দু’টি বড় তারা থাকে এবং এই তারা দু’টি একই লাইনে অবস্থান করে। যখন এই তারা দু’টি সমন্তরাল অবস্থানে থাকে না তখন বন্যা ও ঝড় হয়। তা ছাড়া আজ দু’দিন হলো ঘরের চালের ওপর ছাগলগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, অতএব নিশ্চিত মিলে যাচ্ছে ঝড় বৃষ্টি বন্যা তুফান এর পূর্বাভাস। চার পাশে লবণ পানি, উষ্ণ বাতাস ,আকাশে দুরন্ত মেঘের ঘনঘটা। বজ্রবিদ্যুৎ। ঐ রাতেই এলো আইলা। ভেসে গেল সুন্দরবনের লোকজীবন…।” এখানে লেখক আদিনাথ মুণ্ডার জবানীতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন, তা যথার্থতা পায়নি বলে আমার মনে হয়।
একুশ অধ্যায়ে লেখক লিখেছেন “পাটকেলঘাটার বেগুনডাড়া গ্রামে ………সেখানে পঞ্চনন মুণ্ডার মেয়ে বন্দনা মুণ্ডা ধর্ষিত হয়েছে। তাকে কৃষ্ণপদ মুণ্ডা শ্যামনগর নিয়ে এলো ক্ষত্রিয় সমাজের এক গৃহস্থবাড়ি কাজের লোক হিসেবে। তাদের বড় বাড়ি। পাল পাল শুয়োর আছে। কৃষ্ণপদ মুণ্ডার সাথে খুব চেনা জানা।” এই অংশে লেখক ক্ষত্রিয় সমাজের মানুষের শুয়োর পালনের কথা বলেছেন। আমার জানা মতে বর্ণ প্রথা অনুযায়ী শুদ্র সমাজের ভিতর কাওড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা শুয়োর পালন করে। কোন ক্ষত্রিয় সমাজের লোকেরা শুয়োর পালন করে না।
উপন্যাসের শেষে “উপসংহারে” লেখক মেক্সকিয়ান ধর্মজাযক ফাদার লুইজি পাজ্জি’কে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার (নৃ-গোষ্ঠীর) আদিবাসী মানুষ মুণ্ডাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আরও একবার উপস্থাপন করেছেন। “আইলা” ও “সিডরে” বিধ্বস্ত উপকূলবাসিদের লণ্ডভণ্ড জীবনকে পুনঃরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, ঠিকানাহীনদের ঠিকানা ফিরিয়ে দিতে, সমাজের মূল স্রোতধারায় তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে মানুষটি রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, সেই আলোকিত মানুষটির দ্যুতি ছড়িয়ে তার লেখার সমাপ্তি টেনেছেন। এমন সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থে লেখক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও খেটে খাওয়া মানুষের নারী-পুরুষদের জীবন সংগ্রামের যে চিত্র অংকন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবী রাখে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর এমন একজন লেখক যিনি সমাজের নিম্নবর্ণ, পিছিয়ে পড়া, ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের কথা বরাবরই ভেবেছেন এবং তার লেখনির মাধ্যমে সেই সকল মানুষদের দৈনন্দিন জীবন, জীবনযাত্রার প্রণালি, আচার অনুষ্ঠান সকলের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে তাদেরকে আলোকিত করার চেষ্টা নিরলস-ভাবে করে যাচ্ছেন। তেমনি একটা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায় হল মুণ্ডা সম্প্রদায়। এই গ্রন্থে লেখক শুধু মুণ্ডা সম্প্রদায়ের কথাই বলেননি; বরং সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী সুন্দরবন ও নদীর উপর জীবন- জীবিকা নির্ভর এমন সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থে লেখক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও খেটে খাওয়া মানুষের নারী-পুরুষদের জীবন সংগ্রমের যে চিত্র অংকন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।
]]>জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম) কর্তৃপক্ষের আহবানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩ জন মহিলা অধ্যক্ষসহ ২৯ জন অধ্যক্ষ ২৮ তম শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সজ্ঞীবনী প্রশিক্ষণ কোর্সে গত ২৮/১১/২০১৭ থেকে ১১/১২/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকাতে অংশগ্রহণ করি। এই কোর্সের অংশ হিসেবে ১ দিন শিক্ষা সফর ধার্য ছিল। কর্তৃপক্ষের সংগে আলোচনান্তে সিদ্ধান্ত হয় আমাদের শিক্ষা সফরের স্থান ‘রাঙ্গামাটি’।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক নায়েমের তত্ত্বাবধানে গত ৬ ডিসেম্বর বুধবার রাত ১০.০০ টায় আমরা রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমাদের বহনকারী বাসটি হাতির ঝিল, শাহাবাগ, হাইকোর্ট, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ফ্লালওভার হয়ে কাঁচপুর ব্রিজ অতিক্রম করে। রাত ১.০০ টায় কুমিল্লার কোটবাড়ি ‘আইরিশ হিল’ রেষ্টুরেণ্টে আমরা চা বিরতি করি। হালকা শীতে চাঁদনি রাতে ভ্রমণটি বেশ উপভোগ্য ছিল। চা বিরতির পর আমরা পুনঃরায় যাত্রা শুরু করি। চট্টগ্রাম পেরিয়ে রাঙ্গামাটির পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পায়নি। হটাৎ বড় একটা ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে চেয়ে দেখি আমাদের গাড়িটি উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। অল্প কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়িটি রাঙ্গামাটির দোয়েল চত্বরে এসে থামল। পাশেই আমদের থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত ভাড়াকরা সুরম্য তিন-তলা লেকবেষ্টিত হোটেল প্রিন্স। আমরা হোটেলের রুমে নামাজ, প্রাতঃরাস, গোসল ও নাস্তা সেরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।
পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল ৯.০০ টায় আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে বোর্ড বাজার লঞ্চঘাটে গিয়ে একটি ইঞ্জিন চালিত লঞ্চ ভাড়ায় নিয়ে রওনা হই। লঞ্চের ছাঁদে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি। পাহাড় কন্যা এই রাঙ্গামাটির আয়াতন ৬১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় এক লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাবতে থাকি ১৮৬ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্য এবং ১৬ কিঃ মিঃ প্রস্থ এই নয়নাভিরাম লেকটির স্বচ্ছজল লক্ষাধিক মানুষের নয়নাশ্রু। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৮০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে আজও রাঙ্গামাটির চাকমা উপজাতীয়রা এই প্রকল্পকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেনি।
প্রায় ৩০ মিনিট চলার পর আমাদের লঞ্চটি রাজবন বিহার বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন ঘাটে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছে আমরা অনেক বানর দেখলাম, যেমনটা দেখেছিলাম মথুরা-বৃন্দাবনে। মন্দিরের আশ-পাশ ঘুরে দেখলেও মূল বিহারের ভিতর প্রবেশে আমরা বাঁধার সম্মুখীন হই। এ সময় আমাদের সাথে গাইডের দায়িত্ব পালন করছিলেন রাঙ্গামাটি টি,টি,সি’র ইন্সপেক্টর জনাব. সহেল আহম্মেদ (কুদ্দুস)। তিনি আমাদের জন্য বিহারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সংগে মোবাইল ফোনে কথা বলে শর্তসাপেক্ষে বিহার পরিদর্শনের সুযোগ করে দেন। শর্ত ছিল, ছবি না তোলা ও মাথা খোলা রাখা। বিহারের ভিতর আমরা একে একে নতুন-পুরাতন সকল মন্দির ও স্থাপনা দর্শন করি। সব শেষে আমরা যায় সাধনানন্দ মহাস্থিবির বনভন্তের মৃতদেহ মমিকৃত মন্দিরে। সেখানে মমি দর্শনের পর আমরা বিহার থেকে বেরিয়ে আসি।
রাজবন বিহার দর্শনের পর আমরা চাকমা রাজার বাড়ি দেখতে যায়। সেখানে গিয়ে রাজার আবক্ষ মূর্তি, মুঘল আমলের কামান, কাছারি ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা দর্শন করি । জানতে পারি বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায়ের পিতা প্রদীপ রায়ের সময়ে এই রাজবাড়ি অনেকটা জাকজমক ছিল। বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায় এখানে থাকেন না। তাই রাজ বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত বাড়ি হিসেবে পড়ে আছে। এই বাড়ির কাছারির বিপরীত পাশে চাকমা মেয়েরা তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রয় করে থাকে। ঘুরে দেখে ও ছবি তুলে সকলে কিছু টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে আমরা ৩০ মিনিট পর সকলে লঞ্চে ফিরে এলাম।
এবার আমরা সুভলং প্রাকৃতিক ঝরনা দেখতে অগ্রসর হলাম। আমাদের লঞ্চটি কাপ্তাই হৃদের নিটল স্বচ্ছ নীল জলরাশির বুক চিরে এগিয়ে চলছে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়, সবুজ আর সবুজ বন-বনানী। মনে হচ্ছিল চারিদিক দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের চাদরে মোড়া। মাঝে মাধ্যে কোথাও পাহাড়ের চূড়ায়, কোথাও পাহাড়ের ঢালে বসতবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। লেকের দু’পাশে পাহাড়ের পাথরগুলি এমনভাবে বিন্যস্ত করা, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোন অভিজ্ঞ শিল্পী তার সুনিপুন হাতের ছোঁয়ায় পাথরগুলি সাজিয়েছে। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়লো পাহাড়িদের কৃষিকাজ। কোথাও জুমচাষ, কোথাও কলাবাগান, কোথাওবা আনারসের বাগান। হৃদের পানিতে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। আমাদের লঞ্চের চালকরা জানাল এই লেকে ১০/১২ কেজি ওজনের মাছও পাওয়া যায়। লেকের মাছ খেতেও খুব সুস্বাদু। যেতে যেতে আমরা বরকল উপজেলার সুভলং ঝর্ণার কাছে পৌঁছে যায়। শুষ্ক মৌসুম হওয়ার কারণে ঝর্ণার পানির ধারা কম ছিল। তারপরও প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে পতিত পানি দূর থেকে সাদা চাদরের ন্যায় দেখাচ্ছিল। ঝরনার পানিতে আমরা অনেকেই ছবি তুললাম, নামাজিরা ওজু করে জোহরের নামাজ পড়লাম। এখানে লেকের ধারে পাহাড়ের ঢালে পেদাটিংটিং জুম বাংলার হোটেলে সবজি, কাঁচকি ফ্রাই, চাপিলা ভর্তা, বাম্বু চিকেন ও ডাল দিয়ে ভাত খেলাম। যা মনে রাখার মতো।
ইতোমধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। আমাদের লঞ্চটি রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রীজের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। আমরা কয়েকজন অধ্যক্ষ লঞ্চের ছাঁদে আসরের নামাজ পড়ে নিলাম। সূর্য অস্তে যাওয়ার পূর্বে ঝুলান্ত ব্রীজে পৌঁছে গেলাম। আমরা সকলে লঞ্চ থেকে নেমে ব্রীজের উপর চলাফেরা করে অস্তমিত সূর্যের সংগে প্রকৃতির মহোনীয় অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ব্রীজের নিচে ছোট নৌকায় পাহাড়ীরা সুমিষ্ট ছোট আনারস(জলডোগ) বিক্রি করছিল। আমরা সকলেই সেই টাটকা আনারসের স্বাদ গ্রহণ করতে ভুল করলাম না। সন্ধ্যা সমাগত, সকলে আমাদের লঞ্চে ফিরে এলাম। নামাজি অধ্যক্ষগণ মিলে লঞ্চের ছাঁদে জামাত করে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। আমাদের বহনকারী লঞ্চটি আমাদের রাঙামাটির অস্থায়ী ঠিকানা হোটেল প্রিন্সের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ডিসি’র বাংলোর পাশ দিয়ে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চললো। কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ, পাহাড়ি সবুজ বনানি, নীল আকাশ, স্বচ্ছ জলরাশি, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ ও স্প্রীট বোটের নীল জল-রাশির বুক চিরে ছুটে চলা সব মিলিয়ে আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। ঘাটে উঠে আমরা কিছুটা ক্লান্ত শরীরে নিয়ে হোটেলে যে যার রুমে চলে যায়।
পরদিন দুপুর ২.০০ টায় খাওয়ার পর আমরা বাসযোগে ঢাকা ফিরব এমন সিদ্ধান্ত ছিল। সেজন্য সকালের নাস্তার পর যে যার মত আশপাশ ঘুরে দেখা ও কেনাকাটা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমিও আমাদের প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী জনাব আব্দুল মান্নান স্যার আমাদের হোটেল থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে তবল ছড়ি বাজারে যায়। যেতে যেতে আলাপকালে জানতে পারি আমাদের উভয়ের একটি করে মেয়ে আছে। স্যারের মেয়ের বয়স ১২ বছর এবং আমার মেয়ের বয়স ১০ বছর। ওই বাজারের প্রায় সকল দোকানের মালিক উপজাতীয়রা। দোকানের মালিক ও সেলসম্যান সুন্দরী মহিলারা। দুই-একটি দোকানে বাঙালীরা তাদের কর্মচারি হিসেবে কাজ করছে। তাদের কাছে উপজাতীয়দের সংগে তাদের সম্পর্ক কেমন জিঞ্জাসা করায় তারা জানাল, উপ-জাতীয়দের সংগে তাদের সম্পর্ক যথেষ্ঠ ভাল। তবল ছড়ি বাজার থেকে আমি ও স্যার উপ-জাতীয়দের তৈরী দু’টি চাদর কিনে গেলাম আর একটি উপ-জাতীয়দের বাজার কাঁঠাল তলীতে। এখানেও আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একটি দোকান থেকে স্যার ও আমি আমাদের মেয়েদের জন্য দু’টি ফ্রগ কিনলাম। ওই দোকানের সেল্সম্যান সদা হাস্যজ্জ্বল পুটি চাকমা নামে একটি অপরুপ সুন্দরী উপ-জাতীয় মেয়েকে দেখলাম। তার সাথে আমার কথা হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে তার সুমিষ্ট হাঁসি যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করবে। তাকে দেখেই মনে পড়লো আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানের কথা, “তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়- সেকি মোর অপরাধ”। আরও অনেকগুলো দোকান ঘুরে-ফিরে দেখে, টুকি-টাকি কেনাকাটার পর আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
দুপুর বেলা ১.০০ টার সময় আমরা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বেলা ২.০০ টার দিকে আমাদের বহনকারী বাসটি হোটেল প্রিন্স-এর সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসি। যথাসময়ে আমাদের বহনকারী গাড়ীটি আমাদের নিয়ে উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে চলতে থাকে। পাহাড়-লেক-সবুজ বনানীর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে রাঙ্গামাটিকে বিদায় জানালাম, বিদায় জানালাম পুটি চাকমাকে।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ [email protected]
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।
]]>