সবাই অপেক্ষা করছে। কখন আসবে সুমী। সকলের চোখে-মুখে বিষাদের চিহ্ন। কারো কারো চোখের কোনে অশ্রু চিক চিক করছে। কেউ কেউ সংগোপনে অশ্রু মুছছে। কিভাবে, কার সাথে আসবে সুমী! সুমীর বাবা সুকাশ বাবু ও গ্রামের দুরসম্পর্কীয় এক আত্মীয় সুমীর সাথে আছে। কেউ বলছে আসবে এ্যাম্বুলেন্সে, কেউ বলছে অন্য গাড়িতে। সন্ধ্যা সমাগত। সকলের অপেক্ষা তাদের বাড়ি ফেরার। এই অপেক্ষা সুখকর নয়। অন্তরে চাপা ব্যাথা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সবাই। কেউ কেউ শ্মশানে চিতার কাঠ প্রস্তুত করছে।
সুমী পিতা-মাতার বড় সন্তান। সবই ছিল তার। বাবা-মা ও ছোট একটা ভাইসহ চার জনের ছোট পরিবার। বাবা সুকাশ হালদার পাশ্ববর্তী উপজেলার নামকরা ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। মা গায়িত্রী দেবী পাশে গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। বাবা-মায়ের চাকরির সুবাদে আর্থিক দিক দিয়ে খুবই স্বচ্ছল পরিবার। গ্রামের ভিতর এল প্যাটানে দ্বিতল বাড়ি। সুমীর কাকা-জ্যাঠাদের পরিবারও স্বচ্ছল। বাবা-মায়ের ইচ্ছানুযায়ি সুমী ও অমি গ্রামে স্কুল থাকা সত্ত্বেও দূরে অপেক্ষাকৃত ভাল স্কুলে পড়াশুনা করেছে। সুমী সেই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছে সুনামের সাথে। বাবার ইচ্ছা থাকা থাকলেও সুমি পাড়ার অন্যান্য সহপাঠিদের ছেড়ে বাবার কলেজে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়নি। সুমীর বাবার কর্মস্থল তার মায়ের কর্মস্থলের বিপরীতে। তাই তার বাবা নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পূর্বে তার মা’কে মটর সাইকেলে যোগে তার কর্মস্থলে পৌছে দিয়ে যান। এ কারণে সুমীর বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার পূর্বে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। আবার সুকাশ বাবুকে নিজ কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফিরে আহারাদি নিজেই সেরে গায়িত্রী দেবীকে বাড়িতে আনতে তার কর্মস্থলে যেতে হয়। যে কারণে সন্তানদের সাথে পিতা-মাতার তদারকিটা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও কর্মব্যস্তার কারণে সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারে না।
পিতা-মাতার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সুমীর লেখাপড়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। সুমি প্রায়ই কলেজ কামাই করে। সার্বক্ষণিক সঙ্গের সাথী অ্যানড্রোয়েড মোবাইল ফোন। বর্তমানে দেশের গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাটের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। সে জন্য কারণে-অকারণে উঠতি বয়সের ছেলেদের যত্র-তত্র মটর সাইকেলে অনাবশ্যক ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়। তাদের ওই ঘোরাঘুরিতে অন্যান্য বাবা-মার মত সুমীর বাবা-মার মনেও অজানা শংকা বিরাজ করে। সুমীর সুশ্রী চেহারা তাদের দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়। তারা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছে মেয়ে লেখাপড়ায় যথেষ্ঠ অমনযোগী। অতীতের ন্যায় সামাজিক পরিবেশও এখন আর নেই। যৌথ পরিবার ভাঙ্গার কারণে এখন আর কেউ অন্য কারো পরিবার নিয়ে ভাবেনা। সবাই আত্মকেন্দ্রিক। তাই তারাও এখন নিরুপায় হয়ে অনেকটা নিয়তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থ-যশ-সম্মান থাকা সত্ত্বেও তারা ভিতরে ভিতরে খুব অসহায়।
প্রকৃতিতেও বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ৬০ এর দশকে অপদা নদী শাসনের নামে ব্যাপক ভেড়ীবাঁধ নির্মাণ করে। প্লাবন ভূমি না থাকায় নদীবাহিত পলি নদীবক্ষে জমতে থাকে। মাত্র ২০বছর পর নদীবক্ষ উঁচু হয়ে এই অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধ অঞ্চলে মৎস্য চাষই এলাকাবাসির একমাত্র অবলম্বন। সুকাশ বাবুর বাড়ির পাশদিয়েই মৎস্য ঘেরের অবস্থান। সেই মৎস্য ঘেরে সময়-অসময় বিভিন্ন এলাকার উঠতি বয়সের কিছু ছেলে আসা-যাওয়া করত।
তাদের মধ্যে এক ছেলের নাম প্রদীপ পাল। প্রদীপের পিতার পূর্বে আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ছোট-খাট ব্যবসা করে দিনাতিপাত চলতো। বর্তমানে অজ্ঞাত কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে বড় ব্যবসায়ি হয়েছে। মৎস্য ঘেরের প্রয়োজনীয় মালামালের ব্যবসাও শুরু করেছে। হটাৎ পয়সাওয়ালা হওয়ায় তার চলাচল ও হাব-ভাবের পরিবর্তন হয়েছে। তার ছেলের সাথেও জুটেছে বখে যাওয়া কিছু বন্ধু-বান্ধব। প্রদীপ বন্ধুদের সাথে মিশে সুকাশ বাবু ও তার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বাড়ির আশ-পাশে ঘোরাঘুরি করতো। কিশোরী সুমী ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হতে থাকে প্রদীপের প্রতি। এক সময় উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। পিতা-মাতার দীর্ঘ অনুপস্থিতি সুমী ও প্রদীপ কিছুটা বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা যত্র-তত্র দেখা সাক্ষাত করতে থাকে। উভয়ের ভিতর ভাললাগা থেকে ভালবাসার সৃষ্টি হয়। পিতা-মাতার আর্থিক সচ্ছলতা অনেকের পরশ্রীকাতরতায় রূপ নেয়। তাই সুমীর অসতর্ক চলাফেরায় প্রতিবেশীদের কেউ মাথা ঘামায়নি।
বরাবরের মত সুকাশ বাবু একদিন নিজ কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আহারাদি সম্পন্ন করে স্ত্রীর কর্মস্থলে গিয়ে তাকে বাড়িতে আনতে যান। যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দেখতে পান সুমীর ঘরের ফ্যান চলছে। সংগত কারণে তিনি ভাবেন সুমী ঘরে আছে। গায়িত্রী দেবীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে উভয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে প্রায় সন্ধ্যার সময় মেয়ের ঘরের দরজা খুলে দেখতে পান সুমী ঘরে নেই। তখনও ফ্যান চলছে। তারা ভাবে আশে-পাশে কোথাও আছে। বিভিন্ন ঘর খোঁজার পর প্রতিবেশীদের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে না পেয়ে পুনঃরায় সুমীর ঘরে এসে খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারে একটি ব্যাগ, ভাল কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা, গয়নাসহ সুমি বাড়ি থেকে চলে গেছে।
মা গায়িত্রী দেবীর মাথায় আসে সুমী প্রদীপ নামে এক ছেলের সাথে প্রায়ই কথা বলতো। সুকাশ বাবু প্রদীপের গ্রামের সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারে প্রদীপ বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে বাড়ির কেউ বলতে পারে না। সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হয়। অপেক্ষা করতে থাকেন সুকাশ বাবু। সহকর্মীরা কেউ কেউ পুলিশকে অবহিত করার কথা বললেও সুকাশ বাবু পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে চাননি। রাত কেটে ভোর হয়, মেয়ে ঘরে ফেরেনি। মা-বাবা বিনিদ্র রাত কাটায়। পরদিন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো, সুমীর সুনির্দিষ্ট কোন খোঁজ নেই। ইতিমধ্যে এলাকার অনেক লোকই বিষয়টা জেনে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় চলছে কানাঘুষা।
রাত আট’টা নাগাদ দুটি মটর সাইকেলে তিনজন মানুষ সুমীকে সংগে করে এনে বাড়িতে পোঁছে দেয়। সুমির সংগে করে নেওয়া টাকা-পয়সা, গয়না কিছুই খোয়া যায়নি। যারা তাকে পৌছে দেয়, তারা কেউই তার সাথে অসৌজন্যমূলক কোন আচরণ করেনি। সুমীকে বাড়ী পৌঁছে দেওয়া ওই তিন জনকে স্থানীয় লোকজন প্রথমে আটকে রাখলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়। সুমী স্বীকার করে সে প্রদীপের সঙ্গে আলোচনা করেই বাড়ি থেকে খুলনায় গিয়ে প্রদীপের সঙ্গে দেখা করে। সেখান থেকে তারা এক মন্দিরে বিয়ে করেছে। এরপর প্রদীপের এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটায়। পরদিন প্রদীপের বাবা বিমল পাল ওই বাসায় গিয়ে প্রদীপ ও সুমীর সাথে দেখা করে। বিমল সুমীকে আশ্বস্ত করে সে তাদের বিয়েকে মেনে নেবে। আপাততঃ তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। পরে দুই পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যবস্থা করবেন তিনি। এখন তাকে শাখা খুলে, সিঁদুর মুছে তার বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে হবে। বিমল পালের কথাকে সহজ-সরল সুমী বেদ বাক্যের মতো বিশ্বাস করে এবং তার কথামতো শাখা-সিঁদুর পরিত্যাগ করে তার পাঠানো লোকদের সাথে মা-বাবার কাছে ফিরে আসে।
বাড়ি ফিরে সুমী বুঝতে পারে বাড়ির সকলে তার আচরণে অসন্তুষ্ট। কিছুদিনের মধ্যে বাড়ির পরিবেশ অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে। সুমীর মাসি ‘প্রিয়া’ ও কাকাতো বোন ‘বর্ণা’ উভয়ে যথাক্রমে দুই ও পাঁচ বছরের বড় হলেও তাকে সময় দিচ্ছে। বাড়ির পরিবেশ প্রায় স্বাভাবিক। সুমীর আচারণে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। ইতিমধ্যে সুমী বার কয়েক প্রদীপদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বিয়ের বিষয় আলোচনা করার জন্য মাকে তাগিদ দিয়েছে।
আরও দিন দুয়েক পর সুকাশ বাবু নিজ কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে মেয়েকে না পেয়ে খুঁজতে থাকে। দোতালায় উঠতে গিয়ে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। অজানা আশংকায় পিতার বুক কেঁপে ওঠে। বিকল্প পথ দিয়ে গিয়ে দেখতে পায় সিঁড়ির শেষাংশে সুমী ফাঁসিতে ঝুলে রয়েছে। সুকাশ বাবুর চিৎকারে আশপাশের সবাই ছুটে এসে সুমীকে ফাঁস থেকে নামিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সুমী বেঁচে নেই। মুহূর্তের ভিতর পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-ইউনিয়ন-থানা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সুমীর আত্মহত্যার খবর। থানা থেকে পুলিশসহ এলাকার বহু লোক সুকাশ বাবুর বাড়িতে হাজির হয়। রাতের ভিতর পুলিশ সুমীর মৃতদেহ পোষ্টমর্টেমের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে পাঠায়।
কেন এমন হল! সকলেই হতবাক। সুমীর বাবা-মা সুমীকে প্রদীপের সংগে বিয়েতে রাজি ছিল। প্রদীপের বাবাও সুমীকে আশ্বস্ত করেছিল। এমন কি ঘটনা ঘটলো, যার জন্য সুমীকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হল! এতটুকু জানা গেল, প্রদীপ ও তার বাবা সুমীর সংগে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা ভঙ্গ করেছে। প্রদীপ সুমীর সংগে মোবাইল যোগাযোগ বিছিন্ন করেছে। সে সুমীকে ধোঁকা দিয়েছে। এই সত্যতা আরও স্পষ্ট হলো- মৃত্যুর দিন সকালে সুমীর বাবা-মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রদীপের দুই বন্ধু সুমীর বাড়িতে এসে সুমীকে জানায়, প্রদীপ সুমীকে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছে। ঘটনার সত্যতার বিষয়টি সুমী নিশ্চিত হয়েছে। মৃত্যু পূর্বে ক্রন্দনরত অবস্থায় সেলফি তুলে রেখে গেছে।
সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সুমী ফিরে এলো এ্যাম্বুলেন্সে। শেষ বিকালের আভায় এ্যাম্বুলেন্স সুমীর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। শোকের মাতমে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। প্রায় এক ঘন্টা পর সুমীকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স পুনরায় চললো শ্মশানে। পূর্বেই শ্মাশানে চিতা প্রস্তুত করা হয়েছে। শুরু হলো শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা। চিতার আলোয় সুমী নিষ্ঠুর প্রতারককে ধিক্কার ও বিদায় জানাল পৃথিবীকে। রাতের আঁধার, অন্ধকারের কাল চাদরে ঢেকে দিলো পৃথিবী, সেই কালো চাদরের আঁচল মুড়ি দিয়ে সুমী যাত্রা করল না ফেরার দেশে।
(এটা একটা কাল্পনিক গল্প, বাস্তবের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই)
লেখক পরিচিতি
অধ্যক্ষ মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ ruhulamin0655@gmail.com
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।