jasim-uddin
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে কজন কবি সাহিত্যিক লেখনিতে পল্লী গ্রাম বাংলার কথা তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জসীম উদ্‌দীন। তাঁর সমগ্র লেখনিতে যে ছবি স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে, তার সিংহভাগই গ্রাম বাংলার মা-মাটি মানুষের কথা। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তাঁর লেখনিতে বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তরের ছবি ফুঁটে তোলাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
 
পল্লী বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি তার লেখনীর উপজীব্য। আর এই ধারণা তিনি লাভ করেছিলেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাধারণ মানুষের জীবনাচার দেখেই। বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতকারে কবি আকপটে স্বীকার করেছেন যে, জীবনের বড় একটা সময় তিনি গ্রামে কাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বিএ পড়া পর্যন্ত আমি গ্রামেই কাটিয়েছিলাম। বি.এ পড়া পর্যন্ত যে ছেলে গ্রামে থাকে গ্রামই তার হৃদয়পটে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। এটাই তো স্বতঃসিদ্ধ সত্য‍‍”। ওই সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেছেন, “একদিন হাঁটতে হাঁটতে নমসুদ্দুর পাড়ায় পৌঁছে গেলাম, সেখানে একটা সুন্দরী মেয়ে শাক তুলতে ছিল তাকে দেখে ভাল লাগল। তাকে নিয়ে কবিতাও লিখলাম ‘শাখ তুলানী’”
 
পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল হতেই তাঁর সঙ্গীত ও কবিতার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। যাত্রাপালা কবিগান, জারিগান তাঁকে দারুনভাবে আকৃষ্ট করত। ছাত্রাবস্থায় তিনি ড. দিনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে পল্লী গীতিকা সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত হন। এ কাজের পাশাপাশি তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম, এ পড়াশুনা করেন এবং ১৯৩১ সালে বাংলা সাহিত্যে এম, এ পাশ করেন। পল্লী গীতিকা সংগ্রহের কাজই তাঁকে পরবর্তী জীবনে কবি হবে অনুপ্রেরণা ভুগিয়েছিল।
 
গ্রাম থেকে নদীর ওপারে দিগন্ত বিস্তৃতি সরিষা ফুলের ক্ষেত্র কবিকে মুগ্ধ করত। কবি তাঁর সৃষ্টির উপজীব্য গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এখানকার মানুষের জীবনাচার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “আমি গ্রামের সকল বিষয় অবগত, গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনাচার আমার রক্তে মিশে আছে। আমি তাদের কথা তো আমি ভালভাবে বলতে পারব। তাদের সম্পর্কে যত কথা আমার জানা আছে। এতকথা আর কাহারও সম্পর্কে আমার জানা নেই। তাই আমি পল্লীর মা-মাটি-মানুষের কথা আমার লেখনীতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কত টুকু সফল হয়েছি, আপনারাই বলতে পারবেন।”
 
জসীম উদ্‌দীন কবি হলেও তাঁর প্রতিভা ছিল বহুমুখী। তিনি নাট্যকার, গীতিকার, গল্পকার প্রভৃতি প্রতিভার প্রতিভাবান। তাঁর ‘কবর’ কবিতা গ্রাম বাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠেছে। কবর কবিতার কবি এভাবে শুরু করেছেন-
“এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
ত্রিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।”
এই পংক্তির ভিতর দিয়ে মানব মানবীর হৃদয় নিড়ানো ভালবাসার কথা বলা হয়েছে।
 
২) পল্লি বাংলার অভাবক্লিষ্ঠ মানুষের প্রতিচ্ছবি তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে। ‘আসমানি’ কবিতা তার উজ্জ্বল উদাহরণ। দরিদ্র অভাবী প্রতিনিধি আসমানির কথা বলতে গিয়ে কবি এভাবে বলেছেন তাঁর আসমানি কবিতায়

“পেটটি ভরে পায়না খেতে, বুকের ক-খানা হাঁড়
স্বাক্ষী দিছে অনাহারে, ক-দিন গেছে তার।” 

অভাবের স্বামী স্বরূপ বুকের হাঁড়কে তুলে ধরেছেন। এটাই ছিল পল্লিকবির উপস্থাপন। অভাবের যাঁতাকলে পিষে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সম্ভবনা মরে যায়, এই কবিতায় কবি তা এভাবে তুলে ধরেছেন।
  “ বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে, হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
 
জসীম উদ্‌দীন গ্রাম বাংলার মানুষের মন বুঝতেন। গ্রাম বাংলার মানুষ গরীব হলেও তারা রাজ কজড়ার গল্প শুনতে ভালবাসে। এর বড় প্রমাণ তাঁর ‘মধুমালা’ নাটক। যেদিন বেতারে “মধুমালা” নাটক প্রচারের দিন ঘোষিত হত, সেদিন গ্রামে এ নাটক শোনার ধুম পড়ে যেত। মধুমালা-মদন কুমার যেন তাদের আত্মার আত্মীয়। নাটকে গীতগুলো বাচ্চারা মাঠে ঘাটে গেঁয়ে বেড়াত বহুদিন যাবত। বেতারে সোজন বাদিয়ার ঘাটনকশী কাঁথার মাঠ যখন প্রচারিত হতো তখনও অনেক শ্রোতা ভীড় করতো। কবি জসীম উদ্‌দীন এর কাব্য গুলির মধ্যে নকশী কাঁথার মাঠ সর্বশ্রেষ্ট।
 
৩। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্য সোজন ও দুলির প্রেম ছিল অনবদ্য। চিরন্তন মানব-মানবীর প্রেমের সাথে সমাজ জীবনে যাযাবর বেদেদের যে বৈষম্য তা ফুটে উঠেছে। পরিণতিতে দুটি প্রাণের আত্মাহুতি পাঠক হৃদয়কে ব্যাথাতুর করে তুলেছে। নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের নায়ক নায়িকা রূপাই-সাজু জীবন্ত চরিত্র। সেখানেও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিবাদকে কাব্যের উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরে ভয়াবহ পরিনতির দিকটা কবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে চির বিচ্ছেদের পূর্বে প্রেমিক-প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে নিম্নোক্ত উক্তি করেছে –
“ মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল, আলসে হেলিয়া খোঁপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল।”
 
এই কাব্যটি ‘The Field of the Embroidered Quilt’ নামে এক ইংরেজ মহিলা কর্তৃক অনুদিত হয়। এই কাজ বাংলার পল্লী জীবনের এক চমৎকার আলেখ্য। এরপর কবির এক পয়সার বাঁশি কাব্যটিত বাঙালী পাঠক সমাজে সমাদর লাভ করে। এ ছাড়াও জসীম উদ্‌দীনের রাখালী, হাসু, বালুচর, ধানখেত, রঙ্গিলা নায়ের মাঝি প্রভৃতি কাব্যগুলি এবং ‘বেদের মেয়ে’ নাটকটি পল্লী জীবনের সুমধুর চিত্রের জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
 
পল্লী সঙ্গীত রচনাতেও কবির ছিল সিদ্ধহস্ত। পত্র পত্রিকায় সেটার নৈপূণ্য প্রদর্শিত হতো। ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় কবির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।
 
কবির মধ্যে আজীবন পল্লিপ্রেম গেঁথে ছিল। তাই মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মরদেহ তারই দাদীর কবরের পাশে সমাহিত  করার শেষ ইচ্ছা পোষণ করেন। স্কট টেনিসন কিপলিং হতে আরম্ভ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো জসীম উদ্‌দীনের স্বদেশ প্রেম ও সমাজ জীবনের একটি সুসংহত নিয়ম অনুসরণ করে বিকাশ লাভ করেছে। কাব্য বা সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রত্যক্ষ প্রকাশের জন্য যে ভালবাসা সাধারণত ব্যবহৃত হয়, জসীম উদ্‌দীন সেই ভাষায় কথা বলেনি। তবে তিনি তাঁর স্বদেশীতাকে প্রকাশ করেছেন খাঁটি প্রেমের ভাষায়। পরোক্ষভাবে তার কবিতায় সর্বত্র পূর্ব বাংলার কাঁদা-মাটির সোনালী গন্ধ ছড়িয়ে আছে। যিনি তাঁর কাছে গিয়েছেন তিনিই বিমোহিত হয়েছেন।  যুগ, দেশ, কাল ও সময়ের পটভূমিকায় জসীম উদ্‌দীন কাব্য সাধনা একটা ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেছে। কেননা তিনি আধুনিক যুগের কবি হয়েও যুগের আবহাওয়া ও আলোড়ন থেকে নিজেকে মুক্ত করে পূর্ব বাংলার প্রাণকেন্দ্র গ্রাম বাংলার মধ্যে নিজেকে স্থাপন করেছেন। শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “জসিম উদ্দীন যুগের কবি নন, সত্য কথা, কিন্তু তিনি জাতির কবি”।
 
গ্রামকেন্দ্রিক নদীমাতৃক পূর্ব বাংলার বিচিত্র রূপ সেখানকার মানুষের মনে যে প্রভাব ফেলে, কবি তা মনে প্রাণে উপলব্ধি করেই সেই রঙ তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এদেশের লোকশিল্প, লোকসংগীত ও লোক সাহিত্যের যে রূপ দেখা যায় পূর্ববঙ্গ ও ময়মনসিংহ গীতিকায়; এসবের একটা পরিশোভিত ও পরিমার্জিত রূপ জসীম উদ্‌দীনের কাব্যে বিকশিত হয়েছে যুগের প্রয়োজন অনুসারে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও যে গ্রাম বাংলার রূপ, রস- গন্ধ তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত ছিল, তার প্রভাব তিনি গুলিয়ে ফেলেননি বরং পরিবেশন করেছেন এখানকার মানুষের জন্য অমৃতের  মত।
 
পল্লী জীবনের অকৃত্রিম ভাবধারা জসীম উদ্‌দীনের কবি প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পল্লীর সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাঁর কাব্যে এক অপূর্ব রস-মাধুর্য লয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। নগর জীবনের কৃত্রিম সভ্যতা ও যান্ত্রিকতার কাছে এটা হয়তো হাস্যাস্পদ হতে পারে, তবে অশিক্ষিত গ্রাম্য জীবনের মধ্যে যে একটা প্রকৃত প্রাণস্পর্শ করেছে, তথাকথিত নগর জীবনে তা একেবারেই অজ্ঞাত। পল্লীগ্রামে যে অনাদৃত ও অবহেলিত সমাজ জীবনকে ঘিরে বিরাজ করছে একটা অকৃত্রিম সারল্য ও সহৃদয় আন্তরিকতা, জসীম উদ্‌দীনের লেখনী সেই অকৃত্রিম গ্রাম্যজীবনের শিল্পচিত্র।
 
জসীম উদ্‌দীনের কবি প্রতিভার অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির তাৎপর্য। কবি তাঁর কাব্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, গ্রাম্যজীবনের ভাবধারা প্রকাশের পক্ষে তা বিশেষভাবে উপযোগী। গ্রামের চলিত ভাষার মাধ্যমে গ্রাম্য জীবনের ভাবধারা প্রকাশিত হয়েছে। ‘ভাষা যে ভাবের বাহন’ জসীম উদ্‌দীনের কাব্যে তা শিল্প সম্মত রূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। প্রকাশ ভঙ্গির তাৎপর্য তাঁর কাব্যগুলিকে অপরূপ মাধুর্য দান করেছে। কবি কোন প্রকার পরিপাঠ্যের আয়োজন না করেই গ্রাম্যজীবনের নিরাধরণ ও নিরাভরণ রূপটি চোখের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। ছন্দ বৈচিত্র, অলঙ্কার বাহুল্য বা কোনরূপ পাণ্ডিত্য তিনি প্রকাশ করতে চাননি। এজন্য তাঁর কাব্যগুলিতে সুস্পটরূপে দেখা গেছে বিষয়বস্তু ভাব ও ভাষার একটা পূর্ণ সমাজকোষ। সত্যিই তাঁর গ্রন্থগুলি গ্রামীণ জীবনের এক একটি Encyclopedia.
 
অনুভূতির গভীরতা জসীম উদ্‌দীনের কবি প্রতিভার অপর একটি বৈশিষ্ট্য। কবি তাঁর হৃদয়ের সবটুকু দরদ দিয়ে দেখিয়েছেন চির নির্যাতিত চাষীদের জীবনকে। যারা চিরদিন অনাদৃত, অবহেলিত ও লাঞ্চিত হয়ে এসেছে। কবি সেই সব চাষীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। কবির কাছে গ্রামের সহিষ্ণু চাষী জীবনের দুঃখের কাহিনী রসশ্রী মন্ডিত হয়ে উঠেছে। প্রাচীন গাঁথাকাব্যের জীর্ণখাতে পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের কাব্য সাধনা অপূর্ব রসব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। বর্তমান কালের মননশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত পরিবেশের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানুষের শাশ্বত জীবনবোধকে। মানুষের অনাদিকালের সেই সহজাত প্রেম-প্রীতি স্রোতস্বতীর স্বাভাবিক ধারার মতই আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর কাব্যে। কবি জসীম উদ্‌দীনের কবি প্রতিভা বর্তমান বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কবির কাব্যিক আবেদন নিরাভারণ পল্লী বাংলাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত হলেও স্বভাব সুন্দর শব্দচয়ন ও সুললিত বাণী সংযোজন প্রচেষ্টাকে অনাবিল সৌন্দর্য ও মাধুর্য দান করেছে। তাই পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষের হৃদয় কুঠিরে চিরকাল অমর হয়ে রইবেন।
 
 
লেখক পরিচিতিঃ

 

মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ,
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০,
ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com
 
 

Leave a Comment