অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম) কর্তৃপক্ষের আহবানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩ জন মহিলা অধ্যক্ষসহ ২৯ জন অধ্যক্ষ ২৮ তম শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সজ্ঞীবনী প্রশিক্ষণ কোর্সে গত ২৮/১১/২০১৭ থেকে ১১/১২/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকাতে অংশগ্রহণ করি। এই কোর্সের অংশ হিসেবে ১ দিন শিক্ষা সফর ধার্য ছিল। কর্তৃপক্ষের সংগে আলোচনান্তে সিদ্ধান্ত হয় আমাদের শিক্ষা সফরের স্থান ‘রাঙ্গামাটি’।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক নায়েমের তত্ত্বাবধানে গত ৬ ডিসেম্বর বুধবার রাত ১০.০০ টায় আমরা রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমাদের বহনকারী বাসটি হাতির ঝিল, শাহাবাগ, হাইকোর্ট, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ফ্লালওভার হয়ে কাঁচপুর ব্রিজ অতিক্রম করে। রাত ১.০০ টায় কুমিল্লার কোটবাড়ি ‘আইরিশ হিল’ রেষ্টুরেণ্টে আমরা চা বিরতি করি। হালকা শীতে চাঁদনি রাতে ভ্রমণটি বেশ উপভোগ্য ছিল। চা বিরতির পর আমরা পুনঃরায় যাত্রা শুরু করি। চট্টগ্রাম পেরিয়ে রাঙ্গামাটির পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পায়নি। হটাৎ বড় একটা ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে চেয়ে দেখি আমাদের গাড়িটি উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। অল্প কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়িটি রাঙ্গামাটির দোয়েল চত্বরে এসে থামল। পাশেই আমদের থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত ভাড়াকরা সুরম্য তিন-তলা লেকবেষ্টিত হোটেল প্রিন্স। আমরা হোটেলের রুমে নামাজ, প্রাতঃরাস, গোসল ও নাস্তা সেরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।
পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল ৯.০০ টায় আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে বোর্ড বাজার লঞ্চঘাটে গিয়ে একটি ইঞ্জিন চালিত লঞ্চ ভাড়ায় নিয়ে রওনা হই। লঞ্চের ছাঁদে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি। পাহাড় কন্যা এই রাঙ্গামাটির আয়াতন ৬১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এই বাঁধের ফলে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় এক লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাবতে থাকি ১৮৬ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্য এবং ১৬ কিঃ মিঃ প্রস্থ এই নয়নাভিরাম লেকটির স্বচ্ছজল লক্ষাধিক মানুষের নয়নাশ্রু। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৮০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে আজও রাঙ্গামাটির চাকমা উপজাতীয়রা এই প্রকল্পকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেনি।
প্রায় ৩০ মিনিট চলার পর আমাদের লঞ্চটি রাজবন বিহার বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন ঘাটে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছে আমরা অনেক বানর দেখলাম, যেমনটা দেখেছিলাম মথুরা-বৃন্দাবনে। মন্দিরের আশ-পাশ ঘুরে দেখলেও মূল বিহারের ভিতর প্রবেশে আমরা বাঁধার সম্মুখীন হই। এ সময় আমাদের সাথে গাইডের দায়িত্ব পালন করছিলেন রাঙ্গামাটি টি,টি,সি’র ইন্সপেক্টর জনাব. সহেল আহম্মেদ (কুদ্দুস)। তিনি আমাদের জন্য বিহারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সংগে মোবাইল ফোনে কথা বলে শর্তসাপেক্ষে বিহার পরিদর্শনের সুযোগ করে দেন। শর্ত ছিল, ছবি না তোলা ও মাথা খোলা রাখা। বিহারের ভিতর আমরা একে একে নতুন-পুরাতন সকল মন্দির ও স্থাপনা দর্শন করি। সব শেষে আমরা যায় সাধনানন্দ মহাস্থিবির বনভন্তের মৃতদেহ মমিকৃত মন্দিরে। সেখানে মমি দর্শনের পর আমরা বিহার থেকে বেরিয়ে আসি।
রাজবন বিহার দর্শনের পর আমরা চাকমা রাজার বাড়ি দেখতে যায়। সেখানে গিয়ে রাজার আবক্ষ মূর্তি, মুঘল আমলের কামান, কাছারি ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা দর্শন করি । জানতে পারি বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায়ের পিতা প্রদীপ রায়ের সময়ে এই রাজবাড়ি অনেকটা জাকজমক ছিল। বর্তমান রাজা দেবাশীষ রায় এখানে থাকেন না। তাই রাজ বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত বাড়ি হিসেবে পড়ে আছে। এই বাড়ির কাছারির বিপরীত পাশে চাকমা মেয়েরা তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রয় করে থাকে। ঘুরে দেখে ও ছবি তুলে সকলে কিছু টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে আমরা ৩০ মিনিট পর সকলে লঞ্চে ফিরে এলাম।
এবার আমরা সুভলং প্রাকৃতিক ঝরনা দেখতে অগ্রসর হলাম। আমাদের লঞ্চটি কাপ্তাই হৃদের নিটল স্বচ্ছ নীল জলরাশির বুক চিরে এগিয়ে চলছে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়, সবুজ আর সবুজ বন-বনানী। মনে হচ্ছিল চারিদিক দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের চাদরে মোড়া। মাঝে মাধ্যে কোথাও পাহাড়ের চূড়ায়, কোথাও পাহাড়ের ঢালে বসতবাড়ি দেখা যাচ্ছিল। লেকের দু’পাশে পাহাড়ের পাথরগুলি এমনভাবে বিন্যস্ত করা, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোন অভিজ্ঞ শিল্পী তার সুনিপুন হাতের ছোঁয়ায় পাথরগুলি সাজিয়েছে। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়লো পাহাড়িদের কৃষিকাজ। কোথাও জুমচাষ, কোথাও কলাবাগান, কোথাওবা আনারসের বাগান। হৃদের পানিতে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। আমাদের লঞ্চের চালকরা জানাল এই লেকে ১০/১২ কেজি ওজনের মাছও পাওয়া যায়। লেকের মাছ খেতেও খুব সুস্বাদু। যেতে যেতে আমরা বরকল উপজেলার সুভলং ঝর্ণার কাছে পৌঁছে যায়। শুষ্ক মৌসুম হওয়ার কারণে ঝর্ণার পানির ধারা কম ছিল। তারপরও প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে পতিত পানি দূর থেকে সাদা চাদরের ন্যায় দেখাচ্ছিল। ঝরনার পানিতে আমরা অনেকেই ছবি তুললাম, নামাজিরা ওজু করে জোহরের নামাজ পড়লাম। এখানে লেকের ধারে পাহাড়ের ঢালে পেদাটিংটিং জুম বাংলার হোটেলে সবজি, কাঁচকি ফ্রাই, চাপিলা ভর্তা, বাম্বু চিকেন ও ডাল দিয়ে ভাত খেলাম। যা মনে রাখার মতো।
ইতোমধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। আমাদের লঞ্চটি রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত ব্রীজের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। আমরা কয়েকজন অধ্যক্ষ লঞ্চের ছাঁদে আসরের নামাজ পড়ে নিলাম। সূর্য অস্তে যাওয়ার পূর্বে ঝুলান্ত ব্রীজে পৌঁছে গেলাম। আমরা সকলে লঞ্চ থেকে নেমে ব্রীজের উপর চলাফেরা করে অস্তমিত সূর্যের সংগে প্রকৃতির মহোনীয় অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। ব্রীজের নিচে ছোট নৌকায় পাহাড়ীরা সুমিষ্ট ছোট আনারস(জলডোগ) বিক্রি করছিল। আমরা সকলেই সেই টাটকা আনারসের স্বাদ গ্রহণ করতে ভুল করলাম না। সন্ধ্যা সমাগত, সকলে আমাদের লঞ্চে ফিরে এলাম। নামাজি অধ্যক্ষগণ মিলে লঞ্চের ছাঁদে জামাত করে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। আমাদের বহনকারী লঞ্চটি আমাদের রাঙামাটির অস্থায়ী ঠিকানা হোটেল প্রিন্সের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ডিসি’র বাংলোর পাশ দিয়ে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চললো। কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ, পাহাড়ি সবুজ বনানি, নীল আকাশ, স্বচ্ছ জলরাশি, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ ও স্প্রীট বোটের নীল জল-রাশির বুক চিরে ছুটে চলা সব মিলিয়ে আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। ঘাটে উঠে আমরা কিছুটা ক্লান্ত শরীরে নিয়ে হোটেলে যে যার রুমে চলে যায়।
পরদিন দুপুর ২.০০ টায় খাওয়ার পর আমরা বাসযোগে ঢাকা ফিরব এমন সিদ্ধান্ত ছিল। সেজন্য সকালের নাস্তার পর যে যার মত আশপাশ ঘুরে দেখা ও কেনাকাটা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমিও আমাদের প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী জনাব আব্দুল মান্নান স্যার আমাদের হোটেল থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে তবল ছড়ি বাজারে যায়। যেতে যেতে আলাপকালে জানতে পারি আমাদের উভয়ের একটি করে মেয়ে আছে। স্যারের মেয়ের বয়স ১২ বছর এবং আমার মেয়ের বয়স ১০ বছর। ওই বাজারের প্রায় সকল দোকানের মালিক উপজাতীয়রা। দোকানের মালিক ও সেলসম্যান সুন্দরী মহিলারা। দুই-একটি দোকানে বাঙালীরা তাদের কর্মচারি হিসেবে কাজ করছে। তাদের কাছে উপজাতীয়দের সংগে তাদের সম্পর্ক কেমন জিঞ্জাসা করায় তারা জানাল, উপ-জাতীয়দের সংগে তাদের সম্পর্ক যথেষ্ঠ ভাল। তবল ছড়ি বাজার থেকে আমি ও স্যার উপ-জাতীয়দের তৈরী দু’টি চাদর কিনে গেলাম আর একটি উপ-জাতীয়দের বাজার কাঁঠাল তলীতে। এখানেও আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একটি দোকান থেকে স্যার ও আমি আমাদের মেয়েদের জন্য দু’টি ফ্রগ কিনলাম। ওই দোকানের সেল্সম্যান সদা হাস্যজ্জ্বল পুটি চাকমা নামে একটি অপরুপ সুন্দরী উপ-জাতীয় মেয়েকে দেখলাম। তার সাথে আমার কথা হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে তার সুমিষ্ট হাঁসি যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করবে। তাকে দেখেই মনে পড়লো আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানের কথা, “তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়- সেকি মোর অপরাধ”। আরও অনেকগুলো দোকান ঘুরে-ফিরে দেখে, টুকি-টাকি কেনাকাটার পর আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
দুপুর বেলা ১.০০ টার সময় আমরা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। বেলা ২.০০ টার দিকে আমাদের বহনকারী বাসটি হোটেল প্রিন্স-এর সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসি। যথাসময়ে আমাদের বহনকারী গাড়ীটি আমাদের নিয়ে উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে চলতে থাকে। পাহাড়-লেক-সবুজ বনানীর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে রাঙ্গামাটিকে বিদায় জানালাম, বিদায় জানালাম পুটি চাকমাকে।
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ ruhulamin0655@gmail.com
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।