অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বৃটিশ-ভারতের প্রথম জেলা যশোর। যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ী গ্রামে বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মেছিলেন। এই কেশবপুরের সন্তান প্রকৃতি প্রেমিক সু-সাহিত্যিক মনোজ বসু, অভিনেতা ও সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য, মনকুমারী বসু এই জনপদকে সাহিত্য-সংস্কৃতির তীর্থভূমিতে পরিণত করেছিলেন। সেই তীর্থভূমিতে বর্তমান প্রজন্মের অনেক কবি-লেখক পদচারণা করছেন। তাদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিক ও নাট্যকার মুহম্মদ শফি নিঃসন্দেহে সকলের শ্রেষ্ঠ। যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে পেশায় শিক্ষক হলেও ছাত্র জীবনে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসেবে তিনি গ্রাম-বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। প্রথম জীবন থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত সদালাপী, স্বল্প ও সুমিষ্টভাষী মিশুক মানুষ মুহম্মদ শফি। সাহিত্যের অনেক শাখায় তার স্বাচ্ছন্দ্য প্রদচারণা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষায় কাব্য রচনায় তিনিই সর্বপ্রথম ও সার্থক কবি। এই রাজ্যের তিনিই রাজাধিরাজ।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষর বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা কখনও ভাবেনি গ্রাম-বাংলার অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষা বই-এর পাতায় স্থান পাবে। মুহম্মদ শফি সেই মানুষ, যিনি অনুভব করেছিলেন গ্রাম-বাংলার মানুষের মুখের ভাষা সংরক্ষণ হওয়া দরকার। তার সেই ভাবনাকে তিনি বাস্তবে রূপ দেন। সৃষ্টি করেন যশোর আঞ্চলিকে, বৃহত্তর যশোর-খুলনার আঞ্চলিকে, বৃহত্তর ঢাকার আঞ্চলিকে, পুরোনো ঢাকার আঞ্চলিকে, বৃহত্তর নোয়াখালির আঞ্চলিকে, বৃহত্তর সিলেটের আঞ্চলিকে, নরসিংদী-কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিকে, উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিকে, চাকমাদের কথ্যভাষায় ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিকে অঞ্চলভিত্তিক কবিতা। অঞ্চল ভিত্তিক কবিতা রচনায় তিনি শতভাগ সফল হয়েছেন এমন কথা বলা না গেলেও তার অঞ্চল ভিত্তিক কবিতায় আঞ্চলিকতার সুর অনুরণিত হয়ে উঠেছে।
তিনি আঞ্চলিক ভাষায় শুধু কবিতাই রচনা করেননি। আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা রচনার পাশাপাশি রচিত কবিতার মান বাংলা, শব্দার্থ ও টিকা প্রদান করে পাঠকদের তার কবিতার মর্ম অনুধাবন করে কবিতায় সৃষ্ট রস আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি সৃষ্টি করলেন “যুদ্দু নাছিরন আর আমি, জীবনডারে কোন জীবনে থুই, পইদ্য মাস্তান প্রসঙ্গ ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার কবিতা। নির্বাচিত আঞ্চলিক ভাষার কবিতা, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার কবিতা, জোবরার পোঁয়া আঁর্রা ইউনূসে, জং পুড়া আমার নাঙলের ফাল প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষার কাব্যগ্রন্থ। তাঁন ক্ষিদের দিনকাল, বাঁচামুরা, পানি আইতাছেঃ আবার আমি বৈঠা ধরুম, তুই আমারে কনে থুয়ে গেলি, জং পুড়া আমার নাঙলের ফাল’- সহ অসংখ্য আঞ্চলিক কবিতায় গ্রামবাংলার বিশুদ্ধ ছবি ফুটে উঠেছে। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এখন আঞ্চলিক ভাষায় কাব্য চর্চ্চা ও রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কবিতায় মা-মাটি-মানুষের বিশুদ্ধ গন্ধ পাওয়া যায়। যা গ্রাম বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তিনি লিখলেন-
“ আমার বাপ-দাদা শুইয়্যে আছে এই মাটিতি
কান পাত্লিই শুন্তি পাই তাগ্যে কতাবাত্রা;
মাঝে-মাঝে য্যানো চোহির’ পরে ভাস্যে ওঠে
পূববো পুরুষগ্যে চলাফিরা”
এই চারটি পংতির মধ্যে কাদা-মাটির গন্ধ ও শেকড়ের টান অনুভূত হয়। যেটা গ্রাম-বাংলার প্রতিটি মানুষের আদি ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। তার আঞ্চলিক কবিতার ভেতর যে সব মানুষের মুখের কথা তিনি তুলে ধরেছেন; তাদের নিত্য দিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা সেই সব কবিতার পরতে পরতে। ১৯৭১’ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বপ্নভঙ্গ মানব-মানবীর আকুতি ফুটে উঠেছে তার “ যুদ্দু নছিরন আর আমি” কবিতায়।
“ যুদ্দুই যাবার সুমায় নছিরনরে
পাজা এ্যরে ধ্যরে কইয়্যে গিইলা
ফিরে আস্যে আমি ওরে ঘরে নেবো;
যুদ্দুর ফাঁহে ফাঁহে আমি ওরে দ্যাখ্তা
বুহির মদ্যি মাজে মাজে থুক্পুক এত্ত্যো
কিরাম এ্যাট্টা ওত্যো আমার-
… … … … …
শফি বাই,
কতি পারো
তুমি কতি পারো
আমার নছিরন এ্যাহোন কনে ? (!)”
এই কবিতার মধ্যে দিয়ে মুহম্মদ শফি মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেমের দিকটি ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন।
মুহম্মদ শফির রচিত গ্রন্থের সংখ্যা সত্তরটিরও অধিক। তার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত আটটি কবিতার বই-এ প্রায় দেড় শতাধিক কবিতার পরতে পরতে গ্রাম-বাংলার অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কঠোর পরিশ্রমি খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-চিত্র ফুটে উঠেছে। এটা শুধু বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের বা জনপদের জন্যই রচিত এমন নয় ; বরং তার এই প্রসারা পৃথিবীর অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কঠোর পরিশ্রমি কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়ও বটে। আঞ্চলিক কবিতার আটটি কাব্য গ্রন্থ ছাড়াও দুইটি ইসলামিক কাব্যগ্রন্থ সহ মোট তেইশটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। উপন্যাস তিনটি। প্রহসন সংখ্যা চারটি। নাটক উনিশটি।
মুহম্মদ শফি’র রচিত উনিশটি নাটকের মধ্যে ২০০৬ একুশের বইমেলায় প্রকাশিত “তিন মনীষী তিন নাটক” গ্রন্থটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করতে চাই।
“প্রসঙ্গক্রমে আমার লেখা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চায়। যে তিনজন মনীষী’র কথা আলোচনা করতে চাচ্ছি, এটা আমার ধৃষ্ঠতা। আমি নগণ্য মানুষ। তিনজনই দেশ ও জাতির গর্বের ধন। তাঁদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধেয় সালাম। এছাড়া যে নাট্যকার কর্তৃক রচিত এই গ্রন্থ, তিনি (মুহম্মদ শফি) এই প্রজন্মের পথিতযসা লেখক। তাঁর প্রতিও আমার সশ্রদ্ধেয় সালাম। আমার লেখায় কোন অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি চোখে পড়লে পাঠক যেন নিজগুনে আমায় ক্ষমা করেন। এবং আমাকে জানালে পরবর্তীতে আমি তা সংশোধনের চেষ্টা করবো”।
– অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
তিন মনীষী তিন নাটক গ্রন্থটি মুহম্মদ শফির অনন্য সৃষ্টি। এখানে যে তিনজন মনীষীর জীবন নিয়ে তিনি নাটক রচনা করেছেন তারা বাংলা ভাষা-ভাষী ও বাঙালি জাতি-সত্তার প্রতীক এবং বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ। এদের প্রথম জন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্বার্থক রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দ্বিতীয় জন বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী ও বুলবুল কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম এবং তৃতীয় জন হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা। গ্রন্থটির শক্ত কভার পেজের উপর উল্লেখিত তিনজন মনীষী’র মুখোবায়বের অস্পষ্ট ছবি গ্রন্থটির ভারত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তিন মনীষী তিন নাটক গ্রন্থটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী নাট্য সংকলন। একের ভিতর তিন। একই গ্রন্থের ভিতর তিনটি নাটক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনটি নাটকই পৃথক সত্তায় আবর্তিত। নাটকের বহ্নিক দিক দিয়ে একটির সংগে অন্যটির কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু অন্তর নিহিত তাৎপর্যে তিনটি নাটক একই সুতোয় বাঁধা। নাটক তিনটির উপস্থাপন তথা প্রদর্শণ দিকটি নাট্যকার বৈদ্যুতিক আলো মালায় সজ্জিত ইলেক্ট্রিক্যাল মাধ্যম বা থিয়েটারকে মাথায় রেখে রচনা করেছেন। এই নাটক ত্রয়ে নির্দেশনাও তার। তিন মনীষী তিন নাটক উন্মুক্ত মঞ্চে মঞ্চায়িত হওয়া অনেকটা অসম্ভবও বটে।
তিন মনীষী তিন নাটক গ্রন্থটি নাট্যকার মুহম্মদ শফি উৎসর্গ করেছেন তার মরহুম পিতা আফসার আহমদ সিদ্দিকী’কে। এই গ্রন্থে গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষিত হয়েছে নাট্যকার মুহম্মদ শফি’র সুযোগ্য সহধর্মিনী রাশিদা শফি’র নামে। ৩২৬ পৃষ্ঠার অপসেটে কাগজে মুদ্রিত সুন্দর-শক্ত বাঁধাই বইটির মূল্যমান রাখা হয়েছে ২০০ টাকা বা পাঁচ ইউ,এস ডলার। প্রসঙ্গ কথার ভিতর নাট্যকার বলেছেনঃ “বিংশ শতাব্দীর ‘ক্রান্তিলগ্নে’ বাংলা নাটক যখন নিজস্ব রীতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে ‘পুরনো বোতলে নতুন মদ’ কিংবা ‘দেশীয় পাত্রে বিদেশী খাবার পরিবেশন’ কিংবা ‘কু-পাত্রে সুকন্যা দান’ এর মতো, প্রায় বিজাতীয় মোহগ্রস্ত এবং অনুবাদসর্বস্ব, ঠিক তখন আমি দেশ ও জাতির গর্বিত এই মানবদের জীবন ও অবদানকে আমার নাটকের উপজীব্য করেছি। আমি মনে করি, নিজস্ব ধারা ও ঐতিহ্যের সন্ধান ব্যতিরেক বাংলা নাটকের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।” নাট্যকারের এই বক্তব্যের সংগে আমি পুরোপুরি একমত না হলেও অনেকাংশে সহমত পোষণ করি।
সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ নাট্য সাহিত্যকে কাব্য সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাদের মতে কাব্য দুই প্রকারঃ ১) দৃশ্য কাব্য ও ২) শ্রব্য কাব্য। নাটক প্রধানতঃ দৃশ্য কাব্য। নাটক সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ। সংস্কৃতিতে আছে ‘কাব্যেষু নাটকং রম্যম’। নাটক দৃশ্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সন্মুখে মূর্ত হয়ে ওঠে। নাট্যকার তিন মনীষী তিন নাটক গ্রন্থে প্রচলিত রীতি মানেননি। অধিকাংশ নাটকই সাধারনতঃ পঞ্চম অঙ্কে বিভক্ত থাকে। যথাঃ- (১) প্রারম্ভ (২) প্রবাহ (৩) উৎকর্ষ (৪) গ্রন্থ-মোচন ও (৫) উপসংহার। পাঁচ অঙ্ককে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটকে শ্রোতা-দর্শক যে নাট্যরস আস্বাদন করে তৃপ্তি পেয়ে থাকে। এখানে তা অনুপস্থিত। কিছু কিছু নাটক পাঁচ কমও থাকতে পারে। যেমনঃ মুনির চৌধুরীর ‘ রক্তাত্ত প্রান্তর’। মাইকেল মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ইত্যাদি।
একই গ্রন্থে তিনটি নাটক তিনশত উনিশ পৃষ্টায় সমাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে মহাকবি মধুসূদন নাটকে নাট্যকার ২৪ টি চরিত্র এবং ৪৫টি অধ্যায়ে ও ৯৭ পৃষ্ঠায় পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আর বিদ্রোহী কবি নজরুল নাটকে প্রায় ১৯ টি চরিত্র এবং ৬৯টি অধ্যায়ে ১৪১ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নাটকে ২০টি চরিত্র এবং তিনটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে ৬৮ টি পৃষ্টায় পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম প্রস্তাবনা ৫৮ পৃষ্ঠা, দ্বিতীয় প্রস্তাবনা সাড়ে ৫ পৃষ্ঠা এবং তৃতীয় প্রস্তাবনা মাত্র দেড় পৃষ্ঠা যা গতানুগতিক নিয়মের সম্পূর্ণ ব্যত্যয়।
মহাকবি মধুসূদন
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ-পুরুষ, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক, বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রবর্তক, অমৃত্রাক্ষর ছন্দের কবি, সাহিত্যের ট্রাজেডির সার্থক রূপকার, মহাকাব্যের স্রষ্টা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই নাটকে নাট্যকার মোহাম্মাদ শফি মহাকবি মধুসূদনের জীবনের বিশেষ দিকগুলি তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছেন। যদিও নাট্যকার মহাকবি মধুসূদনের বাল্যস্মৃতি বিজড়িত সাগরদাঁড়ি ও জাহ্নবী দেবীর প্রসঙ্গ আনেননি, শুধুমাত্র ঘোষকের বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। মধুসূদনের কোলকাতা হিন্দু কলেজের শিক্ষাজীবন থেকে এই নাটকে শুরু। নাট্যকার এমনভাবে দৃশ্যগুলির অবতারণা করেছেন যা পাঠক ও দর্শকদের জন্য নাটকটি হৃদয়-গ্রাহী হয়ে উঠে।
নাটকে নাট্যকার মুহম্মদ শফি’র মহাকবি মধুসূদন ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের দৃশ্যগুলি এত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করেছেন যা নাটকের সৌন্দর্য বিঘ্নিত করেছে। এই নাটকদ্বয়ে নাট্যকার খুবই সাবধানতার সাথে সত্যতার দিকটি তুলে ধরার চেষ্ঠা করলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। নাটকের প্রয়োজনে কিছু কিছু স্থানে কোন কোন চরিত্র ও কোন কোন সংলাপের অবতারণা করেছেন যা বাস্তব সম্মত নহে; তবে তাতে নাটকের সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়নি। যেমন- মহাকবি মধুসূদন নাটকে নাট্যকার এগার অধ্যায়ের ৩৫ পৃষ্ঠায় রেবেকা ম্যাক্টাভিসের প্রসঙ্গ এসেছে। মধুসূদনের দাম্পত্য জীবনের প্রথম প্রেয়সী ছিলেন রেবেকা ম্যাকটাভিস। যার সংগে মধুসূদনের খৃষ্টান ধর্মীয় রীতি-নীতিতে বিয়ে হয়েছিল। রেবেকা ম্যাকটাভিস পিতা-মাতা-স্বজনদের মতামতকে উপেক্ষা করে মধুুসূদনকে বিয়ে করেছিলেন। রেবেকা ম্যাকঠাভিস অত্যন্ত জেদী ও দৃঢ়চেতা মহিলা ছিলেন। মদুসূদনের ভাষায় যিনি সাগর পাড়ের নীলনয়না। যার প্রশংসার কথা তিনি তার বন্ধুদের বার বার লিখে জানিয়েছেন। আত্মমর্যাদাশীল নারী হিসেবে সারাটা জীবন অতিকষ্টে তিনি অতিবাহিত করেছেন। তিনি মধুসূদনকে নিয়ে গর্ব অনুভব করতেন। সন্তানদেরও তাদের পিতা সম্পর্কে উচ্চ ধারনা দিতেন। তারই গর্ভে মধুসূদনের ৪টি সন্তান জন্মেছিল। মাইকেল তার বন্ধুদের বলতেন ‘তার একটি ভাল স্ত্রী ও চারটি সন্তান আছে।’ মাইকেল মধুসূদনের জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে নাট্যকার একটা পৃষ্ঠায় যেন-তেন ভাবে শেষ করেছেন।
মহাকবি মধুসূদন নাটকে পনের অধ্যায়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন যখন সাগরদাঁড়ীতে আসেন তখন বৃদ্ধ ভৃত্য রামলাল বাড়ীর অন্দরমহলে এসে জাহ্নবী দেবীকে খবর দিলে জাহ্নবীদেবী স্বামী রাজনারায়নকে আনন্দে-আতিশয্যে বলেছে-
জাহ্নবীঃ তুমি শুনছো আমার মধু এসেছে-মধু
রাজঃ মধু! হু ইজ মধু? কে মধু ? তাকে তো আমি চিনি না
জাহ্নবীঃ ওগো ওগো তুমি এখোনও আর অমোন
করে বলো না, আমার মধু এসেছে, তাকে আসতে দাও। তার কাছে আমাকে যেতে দাও, শুধু
একটি বার তাকে আমার দেখ্তে দাও [কাঁদতে থাকেন] রামলাল রামলাল তুই যা, তাকে
নিয়ে আয়।
রাজঃ রামলাল যাবে না। আমার আদেশ। রামলাল, আমি জমিদার রাজনারায়ন দত্ত বলছি, তুই যা, বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দে”।
এই চারটি সংলাপে মধুর প্রতি মাতা-পিতার গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, পাশাপাশি সেই ভালবাসা সন্তান হারানোর ভয়ে ভীতু হয়ে যে ক্ষোভের কাল বৈশেখী সৃষ্টি হয়েছে, পুত্র স্নেহের ধারায় তা ঝরে পড়েছে সহধারায়। মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ কথায় তা ফুটে ওঠে। আবার ষোল অধ্যায়ের শেষাংশে দর্শক-শ্রোতা দেখতে পায়ঃ
জাহ্নবীঃ মধু চলে যাবার পর আমি একটা দিনও স্বস্তিতে কাটাইনি- আমি তোমাকে শেষ অনুরোধ করে বলছি, মধুর জন্যে তুমি কিছু টাকা পাঠাবে – ?
রাজঃ তুমি – – তুমি বল্ছো জাহ্নবী -!
জাহ্নবীঃ যদি তোমার দয়া হয় – –
রাজঃ তুমি – – তুমি বলো জাহ্নবী, তোমার মধুর
জন্যে কতো টাকা পাঠালে তুমি খুশি হবে – তুমি বলো, এক হাজার, দু হাজার,
পাঁচ হাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার, আমার যা আছে সব——-
[জাহ্নবীকে আগ্লে ধরে রাজনারায়ণ কেঁদে ফেলেন ]
এই চারটি সংলাপের মধ্যে পিতা- মাতার পুত্রের প্রতি অপরিসীম স্নেহ-ভালবাসার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই অংশে পুত্র স্নেহে অন্ধ, পুত্র হারানোর কষ্টে-ক্ষোভে রাজনারায়ণ দত্ত চৈত্রের দুপুরের ন্যায় শুষ্ক-কঠিন হৃদয়ও মধুর মাতা জাহ্নবীর আহবানে শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়েছে। এই দৃশ্যে দর্শক-শ্রোতা ও তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এখানেই নাট্যকারের সাফল্য।
মহাকবি মধুসূদন নাটকে আটত্রিশ, চুয়াল্লিশ ও পঁয়তাল্লিশ অধ্যায়ে মধুসূদন ও হেনরিয়েটার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তাদের অভাব-অনটনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে। এই অধ্যায়গুলি পাঠক-শ্রোতার মনকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। জমিদার রাজনারায়নের একমাত্র পুত্র যে কখনও টাকা গুনে দিত না, সেই মধু স্ত্রী-সন্তানাদিসহ দিনান্তে দু’মুঠো অন্নের অভাবে ঘরের ব্যবহার্য জিনিষপত্র বিক্রী করেছে। বহুদিন অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করেছে। অন্যের করুনার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। মধুসূদনের আর্থিক দৈন্যতা সমস্ত দর্শক-শ্রোতাকে ব্যথাতুর করে তোলে।
মধুসূদনের বিপদের দিনে বার বার যিনি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মধুসূদনের ভাষায় যিনি ‘হার্ড অব দা মাদার’। শেষ দৃশ্যে মধুসূদন, মনোমোহন, কৃষ্ণমোহন ও বিদ্যাসাগরের সংলাপে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকে আবেগ-আপ্লুত করে তোলে। এই দৃশ্যে বিদ্যাসাগরের কাছে মধুসূদনের শেষ জিঞ্জাসা “জীবন যুদ্ধে আমি কি সত্যি পরাজিত?” বিদ্যাসাগরের উত্তর, “ না, না তুমি পরাজিত নও! কবি হিসেবেও নও ব্যক্তি হিসেবেও নও! তুমি অমর-অক্ষয়! একজন মানুষ হিসেবে সমস্ত গুনের অধিকারী তুমি ছিলে -অনন্য ছিলো তোমার চরিত্র -তোমার চরিত্রগুণের সাথে আশ্চার্য কবিত্ব প্রতিভা মিশে তোমাকে মহিয়ান করে তুলেছিলো- সারা বঙ্গভাষাভাষী আজ তোমার মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তাই তো তোমাকে শেষ নমষ্কার জানিয়ে যাচ্ছে মহাকবি –।”
মহা কবির চির-বিদায়ের সন্ধিক্ষণে তার বিপদের দিনের তথা দুঃসময়ের সবচেয়ে বড় বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কবির প্রতি তার সারা জীবনের মূল্যায়নের উল্লেখিত সংলাপের মধ্যদিয়ে দারিদ্র-ক্লিষ্ট, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, মৃত্যু দুয়ারে দণ্ডায়মান কবি মধুসূদনকে, মানুষ মধুসূদনকে, বাঙ্গালী মধুসূদনের মনে যে প্রশান্তি এনে দেয়; তা সমস্ত দর্শক-শ্রোতার অন্তরেও শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। পরিশেষে বলতে চাই কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়া মহা কবি মধূসূদন নাটকটি রচনায় মুহম্মদ শফি মোটামুটি সফল।
বিদ্রোহী কবি নজরুল
বাংলা সাহিত্যের বুলবুল কবি, রাগ-রাগিনীর স্রষ্টা, সংগীত সাধক, দেশপ্রেম ও মানব প্রেমে উদীপ্ত, সাম্যবাদী ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের পথ প্রদর্শক তিনি। ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’ নাটকটি কবি নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য। এই নাটকে নাট্যকারকে মহাকবি মধুসূদন নাটকের চেয়ে আরও অনেক পরিশোধিত মনে হয়েছে। নাটকের উপজীব্য হতে পারে এমন সকল বিষয় নাটকের আওতায় আনার সার্থক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তবে এই নাটকেও মহাকবি মাইকেল নাটকের ন্যায় দুখু মিয়া তথা নজরুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোরের জীবন অনুপস্থিত। নাটকের শুরু ইংরেজদের অত্যাচার ও নারী লিপ্সার দৃশ্য দিয়ে। একই দৃশ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি উচ্চারিত হয়েছে। এই নাটকে নজরুলের প্রথম সংলাপ-
নজরুলঃ পরাধীন ভারতবাসীর কাছে এখন একটাই কামনা-, আমাদের স্বাধীনতা। আর তার জন্যে চাই রক্ত! একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবই পারে আমদেরকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। আমি মনে করি, ইংরেজদের আসন টলে উঠেছে। তাই ভারতবাসীর এই প্রতিরোধ সংগ্রামে ভীতু হয়ে তারা দমন নীতি চালাচ্ছে। ওরা কয়জনকে বন্দী করবে? সারা ভারতই তো এখন একটি অখন্ড কারাগার! আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার এই আন্দোলন সফল হবেই হবে। এই পরাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে একদিন স্বাধীনতার লাল পতাকা পত্ পত্ করে উড়বে, সে দিন খুব বেশী দূরে নয়। খোদা চাহে তো এই কাজী নজরুল ইসলামের শেষ-শয্যা স্বাধীন দেশের মাটিতেই রচিত হবে। জয় ভারত। ভারত মাতার জয়। ‘বন্দে মাতরম’।
মহাকবি মধুসূদন নাটকে মধুসূদনের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকা রেবেকা ম্যাকটাভিস যেমন অনেকটা উপেক্ষিত হয়েছে; বিদ্রোহী কবি নজরুল নাটকে নজরুলের জীবনের সাথে স্বল্প সময়ের সম্পর্কিত সৈয়েদা নার্গিসের সম্পর্কটা নাট্যকার যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এই নাটকে ‘ঊনষাট’ অধ্যায়টি সম্পূর্ণ সৈয়েদা নার্গিস আর কবি নজরুলের সংলাপেই সীমাবদ্ধ। এই একটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে নাট্যকার বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মনে কবি নজরুল ও সৈয়েদা নার্গিসকে নিয়ে যে ধূম্রজাল ছিল, তার সমাধান সার্থকভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। সৈয়েদা নার্গিস ও কবি নজরুলের সম্পর্ক ছিল আত্মীক। নাট্যকার এমন ভাবে সংলাপ সংযোজনা করেছেন যা দর্শক-শ্রোতার মনের কুজ্ঝটিকা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। ২৩৩ পৃষ্ঠায় সৈয়েদা নার্গিস বলেছে-
সৈয়েদাঃ ‘………………..জানো কবি, ক’দিন
যাবৎ তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো- হঠাৎ একদিন রাতে তোমাকে স্বপ্ন
দেখলামঃ তুমি আমাকে নিয়ে গান গাইছো-! আমি শিউলি তলায় শিউলি কুড়াচ্ছি আর
তোমার সেই গান শুনছি- সৈয়েদা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন।’
… … … … … … ….
নজরুলঃ ‘হ্যাঁ, আমার তো হারাবার পালা-! প্রথম জীবনে তোমাকে পেয়েছিলাম-! জানি না কোন দৈবে হারালাম-! তারপর বুলবুল-ছেলেটা বুকে এসে কিযে মায়া বাড়ালো-! শেষে একদিন সব কিছু নীরব করে দিয়ে চলে গেল-! জানি না- আমি জানি না, আবার কাকে হারাতে হবে-!’
এই দুইটি সংলাপের মধ্যে দিয়ে দুইটি হৃদয়ের যে আহাকার ফুটে উঠেছে- তা দর্শক-শ্রোতাদের মনকে ব্যথিত করে এবং চরিত্র দুটিকে তাদের হৃদয়ে আপন করে নেয়। এগুলো নাট্যকারের রসবোধের পরিচয় বহন করে।
আমাদের সমাজে এখনও এক শ্রেণীর লোক দেখা যায়, যারা কবি নজরুলকে তার মানবতা, সাম্য, কুসংস্কারমুক্ত মনসিকতা, সর্বপরি তার শ্যামা সংগীত রচনার জন্য তাকে কাফের বলে আখ্যায়িত করে থাকে। কিছু মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ধর্মের গণ্ডির বন্ধনে বেঁধে সমাজের ভিতর বিষবাষ্প ছড়িয়ে বেড়ায়। বিদ্রোহী কবি নজরুলের সংগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে আত্মিক-বন্ধন ছিল, নাট্যকার মোহাম্মদ শফি তার বিদ্রোহী কবি নজরুল নাটকের দশম অধ্যায়ে দুলির সংগে কথোপকথনের মাধ্যমে সুন্দরভাবে তা ফুটিয়ে তুলেছেন-
“নজরুলঃ গুরুদেবের অনেক গান আছে, যা আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে! বাংলা সংগীতে ঈম্বরপ্রীতি তাঁর মতো আর কাউকে দেখিনি!
দুলিঃ কিন্তু আপনি তো বিদ্রোহী কবি
নজরুলঃ কেন – কেন, বিদ্রোহী কবির বুঝি ঈশ্বরভক্তি থাকতে নেই ? শোনো, ছোটবেলায় এই ঈশ্বর প্রীতির জন্যেই মানুষ আমাকে ‘তারা ক্ষ্যাপা’ ও ‘নজর আলী’ বলে ডাকতো। আর নজরুলের এই বিদ্রোহ তো শান্তির জন্যেই, পিস ফর স্ট্রাগল! আমার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পড়োনি? “ আমি ইন্দ্রাণি-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য, মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তূর্য !”
দুলিঃ কিন্তু কাজী দা-
নজরুলঃ কোন কিন্তু নয়, আমি সংগ্রাম চাই – বিপ্লব চাই – বিদ্রোহ চাই, আর তার মধ্যে দিয়েই চাই- ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা! আমার ধূমকেতু’র পাতায় আমি তো সেই কথাই বলতে চেয়েছি -”
আমরা সকল বঙ্গবাসি জানি নজরুল ইসলামের আরেক নাম ‘দুখু মিঞা’। সারা জীবন দুঃখের সাথে তার বসবাস। দুঃখকে বরণ করেই তার পথ চলা। কবি নজরুলের বিয়ের পরের ঘটনা। ‘সাতাশ অধ্যায়ে’ নজরুল ইসলামের হুগলীর বাসায় শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবীর সংগে কবির কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে সেই চিরচেনা সংসারের অভাবের রূপটি নাট্যকার ফুটিয়ে তুলেছেন-
“ গিরিঃ বলছিলাম কি বাপু, আগে তো তুমি একা ছিলে, এখোন সংসার করেছো, আয়, রোজগারের দিকে এবার একটু মন দাও
…. … … … … … … …
নজরুলঃ যুদ্ধে যাবার পুরস্কার স্বরূপ ইংরেজ সরকার আমাকে সাব-রেজিষ্ট্রারের চাক্রি দিয়েছিল মাসিমা, কিন্তু আমি তা করিনি
গিরিঃ করলে ভাল করতে বাপু।
… … … … … … … …
গিরিঃ দ্যাখো নূরু, খান বাহাদুর
মাজাহারুল আনোয়ার চৌধুরীর কন্যা বলে মিসেস এম, রহমান গাঁটের থেকে আজ তোমাকে
সাহায্যে করছেন, কিন্তু তিনিও তো ঘরের বউ ভবিষ্যতে এভাবে তিনি আর কতো
করবেন? শোনো, তোমার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে, এই বলে গেলাম।
… … … … … … …
নজরুলঃ
‘হে দারিদ্র্য, তুমি মরে করেছ মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক -মুকুট-শোভা। – দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস ;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি ; বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!”
বিদ্রোহী কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যে প্রথম এবং সার্থক ইসলামী সংগীতের প্রবর্তক। আব্বাস উদ্দীন ও কে, মল্লিকের (কাসেম মল্লিক) অনুপ্রেরণায় তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ইসলামী সংগীত ভিন্ন মেজাজে শ্রোতাদের বিশেষ করে মুসলিম শ্রোতাদের আন্দলিত করলো। মুসলিম শ্রোতাদের অন্তরে যে সুর সুধার জন্য বুবূক্ষ-ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মরুভূমি ছিল; তা কবি নজরুলের হাতের ছোঁয়া পেয়ে শীতল জলে সরস হয়ে উঠলো। রচিত হলো তার কালজয়ী অসংখ্য ইসলামী সংগীত-
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এল খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানী তাগিদ।”
প্রিয়পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর পাগল-প্রায় কবি নজরুল হারান পুত্রকে আর একবার দেখার জন্য বরদা মজুমদারের পরামর্শ মতে কবি নজরুল যোগসাধনা করেছেন। যোগসাধনায় সফল হয়ে একবার তিনি বুলবুলকে দেখেছেন। উনপঞ্চাশ অধ্যায়ে কবি নজরুল ও নলীনীর কথোপকথনের মাধ্যমে জানা যায়।
“ নজরুলঃ … দেখলাম, বুলবুল এগিয়ে এসে তার আলমারিটা খুললো। সেই আলমারীর মধ্যে রাখা ছিল তারই স্মৃতিঃ খেলনা, ঘুড়ি, লাটাই, বাঁশি, জামা-কাপড়, মোজা, জুতো আরও কতো কি-! বুলবুল অনেকক্ষণ যাবৎ এ সব নেড়েচেড়ে দেখলো-! তারপর এক সময় আস্তে করে আলমারীটা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে এসে সেই আগের মতো প্রাণকাড়া হাসি হেসে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো -”
উনসত্তর অধ্যায়ে কবি নজরুল স্বাধীন দেশের মাটিতে মরবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এই অধ্যায়ে নজরুল বাকরুদ্ধ হওয়ার পূর্বে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তারপর তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেছেন-
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু,
আর আমি জাগিব না।
কোলাহল করি’ সারা দিনমান
কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকি
গন্ধ বিধুর ধূপ।”
শেষ
দৃশ্যের শেষাংশে নাট্যকার কবি নজরুলের সংগীত দিয়েই এই নাটকের সমাপ্তি
টেনেছেন। বিষয়ের সাথে করুন রসের যে সংমিশ্রণ তা দর্শক-শ্রোতাদের বিমোহিত
করেছে। এটা নাট্যকারের রস-বোধের পরিচয় বহন করে।
“ নজরুলঃ খেলা শেষ হল, শেষ হয় নাই বেলা।
কাঁদিও না, কাঁদিও না –
তব তরে রেখে গেনু প্রেম- আনন্দ মেলা।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মহাকাব্যের মহানায়ক। তিনি ‘নেশান অব দি ফাদার’। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। এই নাটকটি মহাকবি মধুসূদন ও বিদ্রোহী কবি নজরুল নাটক থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত। এখানে প্রস্তাবকের পরই ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ভাষণ দিয়েই নাটকের শুরু এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের মধ্যে দিয়েই নাটকের পরিসমাপ্তি। ১৯৭২ সালের ১০জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণও এই নাটকের সংলাপ হিসাবে নাট্যকার উপস্থাপন করেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমা এখানে প্রায় অনুপস্থিত। এছাড়া ৭ই মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসও অতি ক্ষুদ্রাবর্তে আবর্তিত। প্রচলিত নাটকে এত দীর্ঘ সংলাপ দেখা যায়না। এমন সংলাপ পাঠক-দর্শক-শ্রোতার ধর্যচ্যুতি ঘটায়। গতানুগতিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে সংশ্লিদের সংলাপও অনেকটা গতানুগতিক।
নাট্যকার এই নাটক রচনায় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের হদয়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাশে স্বাধীন হয়। তার ৭ই মার্চের ভাষণে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ জীবন বাজী রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনঃগঠনের চেষ্ঠাকালীন সময়ে দেশী-বিদেশী চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট তাকে নিজ বাসভবণে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ধানমণ্ডি ৩২নং আক্রান্তের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দলীয় নেতাকর্মী, নিকটজন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসারদের সাহায্যের কথা জানানোর চেষ্টা করে একমাত্র ব্রিগেডিয়ার জামিল ছাড়া সকল চেষ্টা তার বিফল হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে নাট্যকার মোস্তাকের জবানীতে জিয়াউর রহমান এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির জবানিতে সোভিয়েত দূতাবাশের উদ্ধৃতিতে সি,আই,এর জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রায় সাইত্রিশ/আটত্রিশ বছর পর ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে ; কিন্তু আজও সকল অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় এনে দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। বিষয়টি আজও দগদগে ঘায়ের মতো রয়েছে। বিশ্বের পরাশক্তি ও দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের একটির প্রতিষ্ঠাতাকে এ নাটকে দায়ী করা হয়েছে। একজন নাট্যকারের জন্য এটা একটি সাহসিকতার পরিচয় বলে আমি মনে করি।
প্রচলিত নাটকে চরিত্রে আধিক্য দেখা যায়না। চরিত্র আধিক্য হওয়ার কারণে এই জাতীয় নাটক মঞ্চায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। প্রচলিত নাটকে ১৫ থেকে ২০টি দৃশ্যের ভিতর নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে। যা শ্রোতা-দর্শকদের জন্য নাটকের বিষয়বস্তু হৃদয়াঙ্গাম সহজসাধ্য হয় এবং শ্রোতা- দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় না।
নাট্যকার মহাকবি মধুসূদন ও বিদ্রোহী কবি নজরুল নাটক যথাক্রমে ৪৫ ও ৬৮টি দৃশ্যের অবতারণা করে ঘন ঘন দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। যা দর্শক-শ্রোতার মন-সংযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। যদিও দৃশ্যগুলিতে সময় ক্ষেপণ কম হয়েছে, তবুও দর্শক-শ্রোতা ক্লান্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নাটকে তিনটি প্রস্তাবনা যথাক্রমে ৫৯, সাড়ে ৫ ও দেড় পৃষ্ঠায় সমাপ্ত হয়েছে। তিনটি প্রস্তাবনার ভিতর সামাঞ্জস্যতার অভাব লক্ষ্য করা যায়।
পরিশেষে বলা যায় কাজ করলে ত্রুটি ধরা পড়ে। কাজ না করলে ত্রুটি নেই। নাট্যকার মুহম্মদ শফি ‘তিন মনীষী তিন নাটক’ গ্রন্থটি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। মহাকবি মাইকেল যশোর তথা কেশবপুরের অহংকার, কবি নজরুল আমাদের জাতীয় কবি এবং বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। তাই নাট্যকার মুহম্মদ শফি তার ‘তিন মনীষী তিন নাটক’ গ্রন্থে এই মহান ব্যক্তিদের নাটক হিসেবে তুলে ধরে যশোরবাসি তথা কেশবপুরের মানুষদের নিঃসন্দেহে সম্মানিত করেছেন। ইতিপূর্বে এই জাতীয় নাটক রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে তিনি যে তিনজন মহামানবকে তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছেন এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। এটাই নাট্যকারের সফলতা। এটাই আমাদের অহংকার।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ ruhulamin0655@gmail.com