সাহিত্য ও সাংস্কৃতির তীর্থভূমি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা। বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি গ্রাম। মধুসূদনের স্মৃতিধন্য এই কেশবপুরকে আরও যারা সম্মানিত করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ডোঙ্গাঘাটা গ্রামের মনোজ বসু। গ্রাম ও মাটি-মানুষের মুখপাত্র এই সাহিত্যিকের রচনায় গ্রাম্য সমাজের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর চৌষট্টিটি রচনাবলির ভিতর তেত্রিশটি উপন্যাস, আটটি নাটক, চারটি ভ্রমণকাহিনি, তিনটি ছোটগল্প, পনেরটি গল্পগ্রন্থ ও একটি কবিতার বই। তার উপন্যাসের ভিতর “নিশিকুটুম্বু” একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস।

“নিশি কুটুম্বু” ‘নিশি’ অর্থ রাত আর ‘কুটুম্ব’ শব্দার্থ বিবাহজনিত লৌকিকতা বা আত্মীয়তা। লেখক এখানে মৃদু ব্যাঙ্গার্থে রূপক হিসেবে নামকরণ করেছেন। মনোজ সাহিত্যে গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল বিষয়গুলো দক্ষ মালির ন্যায় এক সুতায় গেঁথে সুদৃশ্য মালায় রূপ দিয়েছেন। উনবিংশ শতাব্দীতে গ্রাম বাংলায় এক সময় চোরের ব্যাপক উপদ্রব ছিল ; বিশেষকরে সিঁধেল চোরের। তাদের চৌর্যবৃত্তিকে তুলে ধরার মানসে লেখকের এই প্রায়াস।

১৯৬৭ সালে দিল্লীর সাহিত্য একাডেমিতে ‘নিশিকুটুম্ব’’ রচনা সম্পর্কে লেখক বলেন-“সমাজের আদিম পাপ দুইটি- চৌর্য আর গনিকাবৃত্তি। গনিকা নিয়ে পৃথিবীর নানা সাহিত্যে কালজয়ী সৃষ্টি রয়েছে, কিন্তু চৌর্য কর্মনিয়ে কোন বৃহৎ সৃষ্টি আমার নজরে পড়েনি। উপন্যাস লিখতে বসে কয়েকটি বৃদ্ধ চোরের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদরে অতীতের কথা শুনলাম। শুনে রোমাঞ্চ লাগে, ঘৃণ্য চৌর কর্মের মধ্যেও আশ্চর্য মানবিকতা মাঝে মাঝে তাদের জীবনে ঝলক দিয়ে গেছে। এত কালের অনাবিষ্কৃত এক আশ্চর্য জগৎ ‘নিশিকুটুম্ব’ বইয়ে সেই বিচিত্র জগতের পরিচয়। তাদের চলাচল নিশিরাতে (তাদের) অলিখিত আইন আছে, সেগুলি তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সুনিপুন কর্ম বিভাগ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা। চোরদের মত সাধু অতিশয় বিরল। সাধুতা দলের মধ্যে… কাঞ্চনলিপ্সু তারা, কিন্তু কামিনিতে অনীহা। লেখকের হাত নিসপিশ করে এমন জিনিস নিয়ে লিখতে”।

এটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়। বিশ্বসাহিত্যেও এই উপন্যাসখানি আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়েই সৃষ্ট। সকল সাহিত্যে চোর-ডাকাতের বর্ণনা দেখা যায়, তবে মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত। এটা লেখকের অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় বাস্তব চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক সমাজের নিন্দনীয় শ্রেণীপেশার মানুষের বাস্তব রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই উপন্যাসের কুশিলবরা সিঁধেল চোর, পতিতা, পকেটমার, থলিলদার এরা সবাই সমাজের চোখে নিন্দিত ও ঘৃনিত।

শিক্ষার সংজ্ঞা কারকরা সকলেই সুশিক্ষাকে ‘শিক্ষা’ বলেছেন। এই উপন্যাসে মনোজ বসু চৌর্যবৃত্তি শিক্ষাকে ‘ শিক্ষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। আদিকাল থেকে আমাদের সমাজে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা”। সেই চুরিবিদ্যার নিশিকুটুম্ব উপন্যাসের নায়ক গনেশ ওরফে সাহেব। সাহেবের প্রশিক্ষিত হাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ‘গায়ের উপর মৃদু স্পর্শ। বাহুর উপর, বাহু থেকে গলায়, তারপর কোমরের দিকটায়, … চঞ্চল আঙ্গুলগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে সরীসৃপের মতন’। ঘুমন্ত যুবতী, নববধু আশালতার শরীর থেকে সুকৌশলে গহনা খুলে নিচ্ছে সাহেব চোর। গুরুর শিক্ষা কাজের সময় (চুরির সময়) যত সুন্দরী হোক না কেন , তার শ্লীলতাহানি করা যাবে না। গুরুর শিক্ষা এই ধর্মকে সাহেব বরাবর মেনে চলেছে। পঞ্চানন বাইটা (পচা বাইটা) সাহেবের চুরি বিদ্যার শ্রেষ্ঠ গুরু। তার আদেশ-নিষেধ সাহেবের কাছে অলঙ্ঘীয়। গুরুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা তার। গুরু নিন্দা তার কাছে অসহনীয়। তাই গুরুপুত্র মুকুন্দ যখন পিতার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে, সাহেব তার প্রতিবাদ করেছে। সাহেবের প্রথম গুরু স্ব-ঘোষিত পালক পিতা নফর কেষ্টা। কিন্তু চুরি বিদ্যা শিক্ষায় তার শ্রেষ্ঠ গুরু পঞ্চানন বাইটা(পচা বাইটা)।

চুরি বিদ্যায়ও কর্ম বিভাজন আছে। আছে সময়জ্ঞান, কাল প্রহর। কর্ম বিভাজন তিন স্তরে বিভক্ত। তিন স্তরে যথাযথভাবে কার্য সম্পাদন হলেই একটি সফল অভিযান সম্পন্ন হবে। এখানে কোন স্তরে ভুল হলে কাজতো সমাধান হবেই না; বরং সমূহ বিপদের সম্ভাবনা খুবই বেশী।

প্রথম স্তরঃ খুজিয়াল বা খোচড় যে বাড়িতে চুরির কাজটি সম্পাদন হবে তার যাবতীয় খোঁজ তাকে নিতে হবে। বাড়ির লোক সংখ্যা কতজন, কতজন পুরুষ, কতজন মহিলা, কয়টি বাচ্চা, বুড়ো মানুষ আছে কিনা, থাকলে কেমন অসুস্থ। রাতে কতবার ঘুম থেকে ওঠে, অন্ধকারে ভালো দেখতে পারে কি না ইত্যাদি।

দ্বিতীয় স্তরঃ ডেপুটি বা সহকারি – চুরির কাজটি যেখানে করা হবে তার আশপাশের রাস্তার খোঁজ, কোন পথ অধিক নিরাপদ, মালামাল কোন পথে সরাতে হবে, বিপদ বুঝলে কখন সংকেত পাঠাতে হবে, কোন জন্তু-জানোয়ারের ডাকে সংকেত পাঠাতে হবে ইত্যাদি।

তৃতীয় স্তরঃ কারিগর-চুরির মূল কাজটি যিনি সম্পন্ন করবেন তিনিই হলেন ‘কারিগর’। কারিগরকে অতি দক্ষতার সাথে কাজটি সম্পাদন করতে হবে। কাজটি করে ডেপুটির হাতে তুলে দিতে পারলেই তার দ্বায়িত্ব শেষ। তখন তিনি নিরাপদ জায়গায় চলে যাবেন।

চুরির মালের ভাগাভাগি সততার সংগে করা হয়। যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে বঞ্চিত করা হয় না। কেউ ধরা পড়লে দলের কারো নাম প্রকাশ করবে না। দলের লোকেরা সুযোগ বুঝে তাকে ছাড়িয়ে আনবে। নিজেদের ভিতর তাদের সততার কোন ঘাটতি নেই। তারা কাজে নামার সময় একাজের তাদের ঈষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে। চোরদের ঈষ্ট দেবতা হলো স্কন্দ তথা দেব সেনাপতি কাত্তিক। বাঙ্গালী চোররা তাদের কাজের শুভ কামনায় মা’কালীকে স্মরণ করে থাকে।

চুরি কাজে আবার সময় ও কাল বিচার আছে। যেমন – শীতকালে রাতের প্রথম ভাগে কাজ সমাধা করতে হয়। লেপের নিচে শোয়ার পর ওম হলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যায়। তখনই কাজ সমাধা করতে হবে। আবার গরম কালে ঠিক তার উল্টো- সারা রাত আই ঠাই করে শেষরাতে ঘুম আসে। ঠিক সেই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য্যহারা হলে কাজ সমাধা হবে না। সিঁধ কাটারও নিয়ম আছে – কোথা দিয়ে কাটতে হবে, কতটুকু পরিমান কাটতে হবে। সিঁধ কাটার পর নির্বিঘ্নে ঘরের ভিতর কিভাবে উঠতে হবে ইত্যাদি।

সাহেবের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, সুধামুখী দাসী আদি গঙ্গার তীরে পরিত্যক্ত নবজাতক সাহেবকে কুঁড়িয়ে পেয়ে ছিলেন। দেবশিশুর মতো এই পুত্র সন্তানটিকে পেয়ে তার ঘরে নিয়ে এসে সন্তান স্নেহে লালন-পালন করেন। পতিতা পল্লীর শত দুঃখ-কষ্ট ও গ্লানির মধ্যে সাহেবকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। সাহেবকে ঘিরেই তার আশা-আকাঙ্খার কুঁড়ি একদিন প্রস্ফুটিত হবে। সাহেবকে লেখাপড়া শিখিয়ে একদিন সে মানুষের মত মানুষ করবে। সাহেবকে নিয়ে এই নোংরা পল্লী থেকে দূরে কোন ভদ্র পল্লীতে গিয়ে সাহেবের মা হয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে। তাই সুধাময়ী এই পল্লীতে জন্মগ্রহণ করা ছোট বোনের মত পারুলের সুন্দরী মেয়ে রাণীর সংগে সাহেবের বিয়ের প্রস্তাবকে বার বার এড়িয়ে গেছে। সাহেব রাণীকে পছন্দ করা সত্ত্বেও সুধামূখী চায়নি রাণীর সংগে সাহেবের বিয়ে হোক। সুধামুখীর বিশ্বাস সাহেব কোন বড় ঘরের ছেলে। তাই তার ঘরে আসা রাজা বাহাদুরকে সুধামুখী সাহেবের বাবা বলে সম্ভোধন করেন; রাজা বাহাদুরও সুন্দর অবয়বের এই পুত্র সন্তানটিকে সন্তান পরিচয়ে আহাল্লাদিত হয়। তাই সুধামুখীর ঘরে আসার সময় সাহেবের জন্য কিছু না কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে বা যাবার সময় কিছু অর্থ সাহেবের হাতে দিয়ে যায়। সাহবেকে সন্তান পরিচয় দিতেও সুধামুখীর পুরাতন খরিদ্দার নফর কেষ্টা আগ্রহী। তাই সে সাহেবকে স্কুলে ভর্তির সময় পিতার নামের স্থানে তার নাম লিখিয়েছে। এতেই নফরকেষ্টা মহাখুশি । সুধামুখীও সাহেবের প্রয়োজনে নফর কেষ্টাকে দিয়ে এটা-ওটা করিয়ে নেয়। সাহেবও জানে নফরকেষ্টা তার বাবা নয়, তবে সে সাহেবকে খুব ভালবাসে।

সাহেব বড় হয়ে তার পরিচয় জানতে পেরেছে। তাই সে সুধামুখিকে মা মনে করে না। সুধামুখি তাকে গঙ্গার তীরে কুঁড়িয়ে পেয়েছিল। সে তাকে লালন-পালন করেছে। সে তার পালিত মা। পালিত মা হলেও তার কষ্টে সাহেব নিজেও কষ্ট পেত। তাই শিশু সাহেব মার অভাব দূর করার জন্য আড়তের পড়ে যাওয়া চাল কুড়িয়ে এনে মাকে দিয়ে মায়ের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছে। চুরি শেখার পর চোরাই মাল মাকে দিয়ে মায়ের অভাব দূর করার চেষ্টা করেছে। সত্যিকারের পিতা-মাতার প্রতি সাহেবের ঘৃণা ও অভিমান। সে ভাবে মা-বাবার অনাকাঙ্খিত হওয়ায় তারা তাকে ত্যাগ করেছে। কখনও ভেবেছে বাবা তার মাকে বাধ্য করেছে ত্যাগ করতে, তার দুখিনী মা হয়তো আজও তাকে খুঁজে বেড়ায়। কখনও ভেবেছে বাবা হয়তো তার কথা জানেই না। নিজের প্রতি সাহেবের ঘৃণা হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন বলতে যাদেরকে বুঝায় সেই বাবা-মা তাকে ত্যাগ করেছে। বর্তমানে যে জীবন সে পেয়েছে, তা তার কাম্য নয়। তাই সে মা’কালীর কাছে প্রার্থনা করেছে, “ আমাকে মন্দ করে দাও মা-জননী – একেবারে নিখুঁত নির্ভেজাল মন্দ”

সাহেবের ভিতর দ্বৈতসত্তার অপূর্ব মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। সাহেব চোর, কিন্তু পাষাণ্ড নয়। তার অনুভূতিশীল হৃদয় লক্ষ্য করা যায়। সে মেয়েদের কান্না, শিশুদের কষ্ট সইতে পারেনা। তাই নিজে যে বাড়ি চুরি করে তাদের সর্বস্ব হরণ করেছে, সেই বাড়ির জন্য তার অন্তরে মমত্ববোধ লক্ষ্য করা যায়। এই যন্ত্রণা প্রমাণ করে সৎ জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ। যেটা আমরা সুধামুখীর মধ্যে প্রবলভাবে দেখি। রাণীও স্বতী-সাধ্বী গৃৃহলক্ষ্মী হয়ে সাহেবের সংগে সংসার করতে চেয়েছিল কিন্তু অভিশাপ্ত পরিবেশ তাকে সে সুযোগ দেয়নি। বংশীর সাথে স্কুল ঘরে রামায়ন শুনতে গিয়ে রামের বনবাস শুনে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছে, তার দু’চোখ বয়ে নেমেছে অশ্রুধারা।

পাঠক মুকুন্দ বাইটাসহ প্রায় সকলেই দেখেছে সেই দৃশ্য। সাহেব রামের বনবাসের সংগে নিজেকে মিলাতে গিয়ে রামের চেয়ে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে করেছে। রামের বনবাসের মেয়াদও আছে। মেয়াদ শেষে তার ফেরার স্থানও নির্দিষ্ট আছে কিন্তু সাহেবের পরিচয় কি? তারতো নির্বাসন দুইযুগ হতে চলল, তার ফেরার জায়গাও নেই। রামের বনবাস হয়েছিল সাড়ম্বরে; দু’জন সংগী-সাথীও ছিল। কিন্তু সাহেবের তো কিছুই নেই। সে স্রোতে ভাসা শেওলার মতো ভেসেই চলেছে। কোথাও তার স্থায়ী ঠিকানা নেই।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি মনোজ বসু গ্রাম-বাংলার একেবারে নিম্নস্তরের ঘৃণিত মানুষ থেকে উঁচু তলার মানুষের প্রতিচ্ছবি তার লেখায় স্বার্থকভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণে সমাজের কাছে হেয় ও অবহেলিত পতিতা আর চোরের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না তুলে ধরতে সার্থক চিত্র শিল্পীর ন্যায় চিত্রকল্প রূপ দিয়েছেন। তাই “নিশিকুটুম্ব” মনোজ বসুর সার্থক সৃষ্টি।