(২৫ জুলাই মনোজ বসুর জন্মদিন স্মরণে)

কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। কিন্তু সৃষ্টি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গেলে অবাক হতে হয়। তাঁর চৌষট্টিটি সৃষ্টির মধ্যে তেত্রিশটি উপন্যাস আটটি নাটক, চারটি ভ্রমণ কাহিনী, তিনটি ছোটদের গল্প, গল্পগ্রন্থ পনেরটি ও পদ্যরচনা একটি। যে সাহিত্যিকের হাত দিয়ে এতগুলো সৃষ্টি বেরিয়ে আসে, তার সাহিত্য অংগনে স্থায়ী আসন পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় তিনি অবহেলিত। সংগত কারণে প্রশ্ন জাগে তবে কি তাঁর সৃষ্টি তাঁকে মর্যাদার আসনে বসাতে ব্যর্থ হয়েছে! তাঁর এই ব্যাপক সৃষ্টির মধ্যে প্রকৃতি কতটুকু এসেছে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তার আগে ব্যক্তি মনোজ বসু ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে একটু ফিরে দেখা যাক।

কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর জন্ম কবি সাহিত্যিকের তীর্থভূমি যশোরের কেশবপুরে। তীর্থভূমি এই অর্থে বলতে চাই, তার জন্মের প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে এই কেশবপুরে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কাব্যলক্ষ্মীর বরপুত্র, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যাঁর হাতের ছোঁয়ায় ভেঙ্গেছিল পয়ারের বেড়ি, সৃষ্টি হয়েছিল প্রবাহমান পয়ার, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, সনেট ও সাহিত্যের সার্থক ট্রাজেডি। গগণস্পর্শী প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন বলে বিশ্বসাহিত্য কানন থেকে তিল তিল করে মধু সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যে মধুচক্র রচনা করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে আধুনিক বাংলা সাহিত্য পঙ্গুত্ব থেকে হাঁটতে শুরু করেছিল। সেই মধুসূধনের জন্মভূমি এলাকায় তার জন্মের সাতাত্তর বছর পর কেশবপুরের নিভৃত পল্লী  ডোঙ্গাঘাটা গ্রামের বসু পরিবারে মনোজ মনোজ বসু জন্মগ্রহণ করেন।

একই এলাকার কথাসাহিত্যিক মনোজ বসুর তুলনামূলক প্রতিভা ছিল পূর্ণিমার রাতে শুকতারার মত। লেখালেখির স্বভাব তিনি পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে। পিতা রামলাল বসু ও ঠাকুর দাদা ঈশ্বরচন্দ্র বসুর লেখালেখির হাত ছিল। মনোজ বসুর নিজস্ব দ্যুতি যেটুকু চোখে পড়ে তার প্রায় অর্ধেকটাই প্রকৃতির বর্ণনার জন্য। গ্রামের মেঠো পথ, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, খাল বিল নদী-নালা, ডোবা-পুকুর, বন-বনানী সবই তাঁর চিরচেনা।

তার জন্মস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন- গাঁয়ের নাম ডোঙ্গাঘাটা! জেলা যশোর। আমি জন্মেছি সে গাঁয়ে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে। অজ পাড়া গাঁ বলতে যা বোঝায় ডোঙ্গাঘাটা ছিল অনেকটা তাই। বড় স্কুল ছিলনা। রাস্তা- ঘাট কাঁচা, রেল স্টেশন থেকে দূরে। আমরা চলাচল করতুম বেশী সময় খালি পায়ে খালি গায়ে। গর্ব করার মতো ব্যাপার নয় নিশ্চয়ই। আজকের ছেলেরা শুনলে লজ্জায় মাথা হেট করবে। বলবে গেঁয়ো মানুষ।”

এই অল্প কথার ভিতর দিয়ে তিনি তৎকালীন গ্রাম বাংলার যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তা শুধু তার নিজ গ্রামই নয়, এই জনপদের শাশ্বত রূপ। সাহিত্যের বিচারে তার মূল্য যায় থাকুক না কেন, সেটা একটা কাল বা সময়ের একটি জনপদের খাঁটি দলিল। সাহিত্য গ্রাম বাংলার বর্ণনা যেখানে আসুক না কেন, সবার আগে ফুটে ওঠে গ্রামের কাঁচা রাস্তা। শুষ্ক মৌসুমে ধূলায় পরিপূর্ণ ও বর্ষাকালে এক হাটু কাঁদার কথা সবার আগে আসে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘বিলাসী’ গল্পে গ্রামের রাস্তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন- “চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশী। বর্ষার দিনে মাথার উপর মেঘের জল ও পায়ের নীচে একহাঁটু কাদা এবং গ্রীম্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধূলার সাগর”। মনোজ বসু ‘ইস্কুলের গল্পে’ বলেছেন- “বর্ষাকালটা ছিল সত্যিকারের দুর্ভোগের সময়। রাস্তার জমত এক হাঁটু কাদা। পা ডুবে গেলে সহজে পারতুম না। এঁঁটেল মাটির এই এক দোষ। গাঁয়ের লোক তাই বলে ছড়া বানিয়েছিল- “চিন্তেখালির মাটি, দুই ট্যাং আর লাঠি”।

মনোজ বসুর চেতনায় এলাকার মাঠ-ঘাট-হাট-প্রান্তর প্রতিষ্ঠান এক কথায় এই জনপদের কিছুই বাদ যায়নি। কেশবপুরের গরুহাট, গড়ভাঙ্গা থেকে নাগরঘোপের কাঁচা রাস্তা, নাগরঘোপ থেকে কসবার কথা, বাড়ি বাড়ি খেঁজুরের গুড় ও চিনি তৈরীর কথা, মনিরামপুরের হাটে গুড়ের আমদানী ও কোষ্টার দর সবকিছু চিরচেনা পরিচিত জনপদের গ্রামগুলি তাকে হাতছানি দেয়। মির্জানগর, রাজগঞ্জ, ব্যালোকাটির ফকিরবাড়ী, আটঘরা, হাসাডাঙ্গা, কানাইডাঙ্গা, মনোহরনগর, কানাপুকুর, পূর্ববাড়ী, পাইকগাছা, রাজীবপুর (রোজিপুর) সাগরদত্তকাটী, ন’পাড়া, মাদারডাঙ্গা, কোনাখোলা, ঝিকরগাছা অন্নপুন্নার হোটেল, প্রহ্লাদ মাষ্টারের পাঠশালা, কাজেম গুরুর পাঠশালা, রায়-রায়ানের দেউল (ভর্তের দেউল) সবই তার আত্মার আত্মীয়। পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা তথা গ্রামের স্মৃতি তাকে সবসময় ঘিরে থাকত। তাই তিনি বলেছেন, গ্রামকে আগে চেনা দরকার। আমাদের দেশের মানুষ গ্রামে গ্রামে ছড়ানো। তাদের বাদ দিয়ে কোন কিছু কল্পনা করা যায় না, গ্রামোন্নয়নের প্রয়োজন বুঝেছি আমি অল্প বয়স থেকেই।”

কপোতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা এ অঞ্চলের জনপদ গঠিত। তিনি পথ চলি গ্রন্থে বলেছেন, “কত সমস্ত মানুষজন ঘরবাড়ী, কত রকম সুখ-দুঃখ, আশা-আশ্বাস, আলাপনে ও বিশ্রামে সময় বয়ে যায় পথ এগোয় না। চারদিকে উছলা ধরণী নব রূপ মেলে ধরেছে- কাকে ফেলে কাকে দেখি, তাড়াতাড়ি এগোবো কি করে।” গ্রামের পথ-ঘাট, খাল-বিল, বন-বনানীর সংগে মনোজ বসু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছেন, এরা সকলেই তার আত্মার আত্মীয়।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে মনোজ বসু নিজ দেশে প্রবাসী হয়ে গেলেন। গ্রামের সংগে যোগাযোগের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ল, ইচ্ছা মাফিক গ্রামে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে না পারার কষ্ট তাকে সব সময় পীড়া দিত। প্রকৃতির বুক থেকে শহরের ইট কাঠের মধ্যে আটকা পড়ে জলের মাছ ডাঙ্গায় পড়ে যেমন ছটফট করে তেমনি ছটফট করেছেন, তিনি বলেছেন- “সর্বদাই মনে হয় যে, এখানে আমি প্রবাসী, আমি একজন বহিরাগত …  …  … বাল্য ও কৈশোরকাল আবার যদি একটু নাগালে পাই, আঁকড়ে ধরি বুকের উপরে, ছেড়ে যেতে দেইনা। কত ভালোবাসার ধন, এবারে মর্মে মর্মে টের পাচ্ছি। শুধুমাত্র মানুষগুলি নয়, গাছপাল, গরু-বাছুর, খাল-বিল, সুখ-দুঃখ আশা উল্লাসে ভরা আমার সেকালের গ্রাম আর সমস্ত অঞ্চলটা। কোন গাছের ডালটা কোনদিকে তাও সঠিকভাবে বলে দিতে পারতাম। চোখ বুজে ভাবলে আজও বোধ হয় পারি।”

এরপর আর মনোজ বসুকে চিনতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। শুধু উপন্যাস আর প্রবন্ধ নয়, তার কবিতার ভিতর দিয়ে প্রকৃতি প্রেম ফুটে উঠেছে। তার “পাট ক্ষেতের মায়া” এর উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতায় তিনি গ্রাম বাংলার কৃষকদের মাতৃতুল্য গাভী বিক্রি করার পর হৃদয়ের ক্রন্দনকে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন-

“গেল বছর চৈত মাসেতে তিনটে বেচলাম গাই
গোয়াল কাঁদে ডাক ছাইড়ারে
তিনটে দিন আর গোয়াল পানে নজর তুলি নাই।

গোয়ালের কান্না অর্থাৎ কৃষকের হৃদয়ের আহাজারি। কবিতায় তিনি আরও উল্লেখ করেছেন-

“বার বেঁকির খাল চেন ভাই? শামুক পোতার চর
সেই খানে মোর সোনার ক্ষেতে ঐ গড়ই গাঙের পর
আর পারেতে তালের সারি দীঘল গাছের দেমাগ ভারি
মাথর উপর মেঘের বোঝা, পায়ের গোড়ায় ধান
ধানের গোছা দেইখ্যা যে প্রাণ করবে আনচান।”

নদী-খাল বিল, ফসলের ক্ষেত এ যেন গ্রামের শাশ্বত রূপ। এছাড়া তার প্রথম কবিতা “গোপন কথায়” বলেছেন-

সই কিরা কর কারেও কবি না-কহিব তব সে কথা।

*          *            *           *
বিল কিনারায় উড়ে চলেছিল সাদা সাদা বক গুলি
মেঘের গলায় সাতনরী হার যায় যেন দুলি দুলি।
তুলসি তলায় সন্ধার দীপ বাতাসে কাঁপিয়ে মরে।
এত বড় বাড়ি- কেউ কোথা নাই, দু’জনে একেলা ঘরে।
দূরে বিয়াবাড়ি কত কোলাহল বাঁজিতেছে ঢোল কাঁশি
ও কহে তখন সেই পুরাতন-ভালোবাসি-ভালোবাসি-

 এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানব-মানবীর চিরাচরিত অব্যক্ত মনের গোপন কথা ফুটে উঠেছে।

গ্রামের মাটি মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, আচার অনুষ্ঠান কুসংষ্কার সবকিছুর সংগে তিনি মিশে আছেন। তিনি বলেছেন- “পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বাড়ীর সামনে বিল, ছেলে বয়স থেকে ঋতুতে ঋতুতে বিলের রূপ বদলানো দেখেছি। চৈত্র-বৈশাখে ক্রোশের পর ক্রোশ ধূ ধূ করে। রাত্রি বেলা বাইরের উঠানে দাঁড়িয়ে দেখতাম দূরে আগুন জ্বলে জ্বলে উঠছে। আলেয়া নাকি ঐগুলো। কল্পনা করতাম কালো কালো ভয়াল অতিকায় জীব বিলের অন্ধকারে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শিকার ধরার আশায়। হাঁ করছে আর আগুন বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে … … … আতঙ্কে চেতনা বিলুপ্ত হয়। আলেয়ার দল তখন চারিদিক থেকে ঘিরে এসে ধরে।”

মনোজ বসুর দীর্ঘ সৃষ্টির ভিতর চারটি গ্রন্থ ও দুই-একটি কবিতায় ব্যাপক ভাবে প্রকৃতির বর্ণনার সমাবেশ ঘটেছে। এর মধ্যে “জলজঙ্গল”“বন কেটে বসত” গ্রন্থ দু’টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সমুদ্র উপকূল ও সুন্দরবন তথা বাদা অঞ্চলের কথা নিয়ে লেখা। “ছবি আর ছবি” ও “সেই গ্রাম সেই সব মানুষ” লেখকের স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থ। কবিতার ভেতর ‘পাট ক্ষেতের মায়’‘গোপন কথায়’ গ্রাম বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে। চারটি গ্রন্থ ও কবিতা গুলির ঘটনা বর্ণনা লেখকের দেখা-শুনা-বুঝা ও অনুভবের বাস্তব প্রতিফলন।

লেখক তার জলজঙ্গল বন কেটে বসত সম্বন্ধে বলেছেন- শিশুরা শুনতে চাইত বাঘের গল্প। ভাল করে যদি বলতে পারি বয়স্ক শিশুরাই বা কেন সে জিনিষ পছন্দ করবে না? গ্রাম আমার সুন্দরবন অঞ্চল থেকে দূরবর্তী নয়। কাঠ কাটতে, মধু ভাঙ্গতে জীবিকার শতাধিক প্রয়োজনে লোকে বনে যায় বাঘ-কুমির-সাপের কবলে পড়ে। তার মধ্যে কত জনে আর ফেরে না। জনালয় থেকে বিচ্ছিন্ন, বনবিবি ও বাঘের সওয়ার গাজী-কালুর রাজ্য রহস্যময় সুন্দরবন ছোট বেলা থেকে আমায় আকর্ষণ করত। সুন্দরবনের বেশীর ভাগ এখন পাকিস্তানে। দেশ বিভাগের আগে সমগ্র সুন্দরবন আমি ঘুরেছি। পরে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনেও গেছি কয়েকবার। ঠিক বাঘের গল্প নয়-কিন্তু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা সুন্দরবন নিয়ে দুটো উপন্যাস (জলজঙ্গল ও বন কেটে বসত) ও কতকগুলো গল্প লিখেছি আমি। কোন কোন অংশে একেবারে বনের ভিতরে খালের উপর নৌকায় বসে লেখা।”

গ্রাম ও বাদাবনের কুসংস্কারও তিনি সযতনে বুকের মধ্যে লালন করে প্রকৃতির সংগে এক করে দেখেছেন। সুন্দরবনকে ঘিরে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের অন্যতম অবলম্বন। এখানে আছে, সুন্দরী, বান, পশুর, ধোন্দল, কেওড়া, গরান, গেয়ো, গর্জন, হেঁতাল, সিঙড়, কাঁকড়া, খলসি, ভাঁড়ার, করঞ্জ প্রভৃতি গাছ। কাঠ, গোলপাতা, মধু, মাছ আহরণ, নৌকা বাওয়া বেড়ীবাঁধ জীবন জীবিকার অবলম্বন হওয়ায় সুদূর অতীত থেকে রহস্যময় সুন্দরবনকে ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তী। বনবিবি, দক্ষিণারাও, ছাওয়াল পীর, গাজী-কালু-চম্পাবতী ইত্যাদি লোকজ কাহিনী ঐ অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির সাথে মিশে আছে। তাদের সংগে সুন্দরবনের বগ মামা (বাঘ), গুণিন, বাওয়ালী, কুমির, সাপ, বনমোরগ, বনর, হরিণসহ কত অশরীরি আত্মা ও কত রকম কিংবদন্তী। এর সবাই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

‘জলজঙ্গল’ উপন্যাস স্বপ্নাদিষ্ট্য গুণিন দক্ষিনা রাওয়ের সন্তুষ্টি লাভের আশায়, বহরের সাথী দলের মধ্যে অকর্মন্য, অনাথ, সহজ-সরল নির্বোধ ফেলনাকে বাঘরূপী দক্ষিণা রাওয়ের মুখে উৎসর্গ করেছে বহরের সাথীরা, শুধুমাত্র তিন ক্ষেপের পরিমাণ মধু এক ক্ষেপে পাওয়ার আশায়। এটা সহজ-সরল গ্রাম্য মানুষের স্বার্থপরতা ও কুটিলতার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর পাশাপাশি তিনি অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ করেছেন। বাঘের মুখে উৎসর্গীকৃত ফেলনার কাতর আর্তনাদ সাথীদের লোভকে টলাতে পারেনি। তখন নিরুপায় ফেলনা বাঁচার শেষ আশ্রয়স্থল বনবিবিকে স্মরণ করেছে। বিপদসংকুল বাদার মাতৃস্বরূপা জ্যোতির্ময়ী রমনী বনবিবি তাকে হিংস্র বাঘের মুখ থেকে উদ্ধার করেছে এবং পরে সুন্দরবনের কুমিরের পিঠে করে তিন জোয়ারের উজানে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

এমন অসংখ্য অতিপ্রাকৃত ঘটনা বাদাবন তথা সুন্দরবনকে ঘিরে রয়েছে। এছাড়া লোনা পানির প্রভাব থেকে বেড়ীবাঁধ তৈরী, নদীর চরে বসবাস তাদের আচার-বিচার-ব্যাভিচার প্রেম, লোভ, মোহ, প্রতিহিংসা, দয়া-দৌরাত্ম, উপকার-উপদ্রব প্রভৃতি প্রবণতা লক্ষণীয়। মধুসূদন, দূর্লভ, কেতুচরন, এলোকেশী, গগন, অনন্ত, ভবনাথ, দেবনাথ, উমাসুন্দরী, তরঙ্গিনী প্রকৃতির অংশ হয়ে বিরাজ করছে। এরা সকলে প্রকৃতির মাঝে জন্মগ্রহণ করে প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে উঠেছে। প্রকৃতিকে নির্ভর করে সৃষ্টি হয়েছে শাস্ত্রসম্মত নয় এমন অনেক পূজা পার্বণএগুলো হলো বুড়ি ঠাকুরুণ, রণচন্ডী, রণগাজী, বনবিবি, দক্ষিণা রায়, গাজী-কালু, ছাওয়াল পীর প্রভৃতি।

মনোজ বসুর প্রকৃতি কেন্দ্রিক রচিত জলজঙ্গল ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থে উপন্যাসের ধারা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। পারতেও চাননি বলে মনে হয়। সৃষ্টির আপন গতিতে বেরিয়ে এসেছে বন কেটে বসত, সেই গ্রাম সেই সব মানুষ। ছবি আর ছবিতে লেখক অনন্তের জবানীতে অপরিমাণদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের ভুলসিদ্ধান্তে দেশবিভাগের বেড়াজালে পারিবারিক পীড়নের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। ভবনাথ, দেবনাথ, উমাসুন্দরী, তরঙ্গিনীর মধ্য দিয়ে তার চিরচেনা একান্নভূক্ত পরিবারের মায়াময় বন্ধনের চিত্র দেখা যায়।

মনোজ সাহিত্যে প্রকৃতির যে রূপবৈচিত্র্য ধরা পড়েছে তা প্রতিটা পাঠককে আন্দোলিত করবে। তাঁর বাদাবনের কাহিনী সম্পর্কে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত বলেছেন “কল্লোল যে রোমান্টিসিজম খুঁজে পেয়েছে শহরের ইট, কাঠ, লোহা-লক্কড়র মধ্যে, মনোজ তাই খুঁজে বনে বাদায়, খালে-বিলে পতিতে আবাদে।”

তার সেই গ্রাম সেই সব মানুষ সম্পর্কে ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন “এটি মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ রচনা।” ডঃ অমলেন্দু বসু গ্রন্থটিকে মহাকাব্যোচিত বলেছেন। ডঃ অসিত কুমার গ্রন্থটি সম্পর্কে আরও বলেছেন- “এই উপন্যাস, আমার দৃঢ়বিশ্বাস একালের বাংলা কথাসাহিত্যে একক মহিমায় বিরাজ করবে এবং অল্পকালের মধ্যেই এটি চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা পাবে।”

গত ২০০৫ সালে কেশবপুরের সাবেক ইউএনও মোঃ খলিলুর রহমান সাহেবের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে মনোজ বসু ও তার সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। এছাড়া পশ্চিম বাংলায়ও কাজ চলছে। পশ্চিম বাংলায় ডঃ মৃত্যুঞ্জয় দাশ ও ডঃ দীপক চন্দ্র মনোজ বসুকে নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন। মনোজ সাহিত্য অচিরেই যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাহিত্যের চুলচেরা বিচারে মনোজ সাহিত্য কতটুকু মর্যাদার আসন পাবে আমি নিশ্চিত জানিনা, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রকৃতির নির্ভেজাল চিত্র তুলে ধরার জন্য যশোর- খুলনার মানুষের কাছে তাঁর সৃষ্টি চির অম্লান, চির অক্ষয় হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। আর মনোজ বসু যদি বাংলা সাহিত্যের ভুবনে স্থায়ী আসন পান- তবে তাঁর ভিতে থাকবে তার প্রকৃতির বর্ণনা।

পরিশেষে আমি ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যেপাধ্যায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, কথা সাহিত্যে মনোজ বসু একদিন একক মহিমায় বিরাজ করবে এবং অল্পকালের মধ্যেই এটি চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা পাবে।

লেখক পরিচিতিঃ

মোঃ রুহুল আমিন

অধ্যক্ষ
পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com