অধ্যক্ষ রুহুল আমিন

বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা। নজরুল প্রতিভার ভেতর আমরা এক সাথে দু’টি প্রবাহের পাশাপাশি অবস্থান লক্ষ্য করি। একটি প্রবাহ হল প্রেম সৌন্দর্য ও অপরটি হল বলিষ্ট বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের পেছনে যে শক্তি কাজ করেছে তাও হল প্রেম-দেশপ্রেম। বাংলা সাহিত্য ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যেই প্রেম সৌন্দর্য ও বিদ্রোহের বাণী ঝংকৃত হতে শোনা যায়। কিন্তু একই কবি বা সাহিত্যিকের মধ্যে এই দুটো গুণের সমাবেশ যথেষ্ট বিরল। নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি বলে পরিচিত। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তার বিদ্রোহী সত্তার সাথে রোমান্টিক প্রেমানুভূতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।

নজরুল ইসামের বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও তৎকালীন শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। কবি সমাজের হীন স্বার্থান্বেষী শ্রেণীর হাতে দরিদ্র নিপীড়িত, অসহায় মানুষের নির্যাতিত হওয়ার চিত্র অতি কাছে থেকে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্রের স্বাধীনতাই যে যথার্থ স্বাধীনতা, তারই কণ্ঠে তা সরবে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এবং বিদ্রোহ করলেন-

“ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন,
বেলা বয়ে যায় খায়নিকো বাছা, কচিপেটে তার জ্বলে আগুন,
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়।
কেঁদে বলি ওগো ভগবান, তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে নাকো তাদের গালে, যারা খায় শিশুর খুন?”

নজরুল ইসলাম সকল সময় ভণ্ডামীকে ঘৃণা করতেন। মানুষ কবিতায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। ধর্মের নামে অর্ধম নজরুল ইসলামকে যথেষ্ট পীড়া দিত। তাই তিনি স্বার্থন্বেষী ধর্ম যাজকদের ধিক্কার দিলেন-

‘তব মসজিদ মন্দিরে, প্রভু, নাই মানুষের দাবী
মোল্লা-পুরুত লাগাইয়াছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’

নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। পরাধীন জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি যে অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছেন তা বর্তমান যুগের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রর চেয়েও কার্যকরী। তার সেই অস্ত্রের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কোন সাম্রাজ্যবাদের নেই। তার অগ্নিঝরা বাণী-

‘পরের মুলক লুট করে খায়
ডাকাত ওরা ডাকাত
তাই তাদের তবে বরাদ্দ ভাই
আঘাত  শুধু আঘাত।’ (অগ্নিবীণা)

কিংবা……..

‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ ।’

নজরুল ইসলাম কখনও অত্যাচারিত শাসক শ্রেণীর সংগে আপোস করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি বরং তিনি কখনও কখনও ইংরেজদের প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ প্রীতি আসলে আপোষবাদিতারই নামান্তর। নজরুল ইসলাম ‘ধুমকেতু’তে তীব্র ভাষায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীর পাশাপাশি প্রভুভক্ত আপোসবাদী ও মধ্যপন্থীদের ভৎসনা করে বললেন-

‘যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই
কবর সেথায় বিদ্রোহ।
ধামাধরা! জামাধরা!
মরণ-ভীতু চুপ র হো!
আমরা জানি, সোজা কথা
পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।’ (বিষের বাঁশী)

এহেন ইস্পাত কঠিন বলিষ্ঠ পুরুষদ্বীপ্ত মনের মানুষটির ভেতর যে প্রেম সৌন্দর্যের এক স্বচ্ছ ফল্গুধারা তর তর করে বয়ে গেছে তা তার কবিতা ও গান না পাঠ করলে বিশ্বাস করা যায় না। চর্যাপদের যুগ হতে শুরু করে আজ পর্যন্ত সাহিত্যে প্রেম একটা চিরন্তন বিষয়। কিন্তু নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবি হিসেবে অন্ধকার রাতে শুকতারার মত আজও জাজ্বল্যমান। তার প্রেমানুভুতির এ তীব্রতা বস্তুতপক্ষে তার পৌরুষের প্রতীক। বাংলা কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্যের চিত্রাবলী প্রায়শই লালিত মধুর, কিন্তু নজরুল যখন আহব্বান করেন-

‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল। ’

তখন এই প্রেম নিবেদনের পৌরুষ দীপ্তিতে কোন সংশয় থাকে না। সৌন্দার্যাভিসারের ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য নজরুল কবি মানসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রেমের মধ্যে তিনি বিরহকে যথার্থ বলে জেনেছেন। তিনি প্রেম বা বিরহকে সমগ্র প্রকৃতিতে পরিব্যাপ্ত ও প্রসারিত করে দিয়েছেন। ‘সিন্ধু হিল্লোল’-এর ‘মাধরী প্রলাপ’ কবিতায় দেহগত প্রেমের তীব্রতা ও প্রেমকে সার্থক করে তোলার জন্য দেহের তীব্র আকুলী দানা বেঁধে উঠেছে। দেহের রক্তে আগুন ধরে যাওয়ার নামই যৌবন। প্রকৃতির যৌবন যেন বসন্তকাল। তখন প্রকৃতি প্রেম চরিতার্থ করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে কবি বলেন-

‘আজ লালসা অলস মদে বিবশারতি
শুয়ে অপরাজিতার ধনী মরিছে
পতিতার বিধুবন উম্মন
ঠোঁটে কাঁপে যৌবন
বুকে পীন যৌবন
উঠেছে ফুঁড়ি
মুখে কাম কন্টক এল মহুয়া কুড়ি।’

মানবিক প্রেমের সৌন্দর্য দেহকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে এবং সে প্রেমের বিচিত্র স্বাদ আস্বাদনের জন্য মন একান্ত ব্যাকুল হয়ে উঠে ‘অনামিকা কবিতায়’ নজরুল এ জীবন আস্বাদনের পরিচয় দিয়েছেন-

‘যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন
যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর
সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ অনুভব করিয়াছি।’

দোলনচাঁপায় কবি প্রেম সম্পর্কিত অস্থির মানসিকতা চিত্রিত করেছেন।  এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ কবিতা পূজারিণী কবির জীবন্ত মানস প্রতিমা। এ কবিতায় দেহ সচেতনতা সুস্পষ্ট। নিজ প্রিয়তমার সাথে কাল্পনিক মিলন বিরহ, অবিশ্বাস সংশয় তৃপ্তি-অতৃপ্তি প্রচণ্ড আলোড়নে তরাঙ্গিত দেহমুখী প্রেম-তরঙ্গের এক আশ্চর্য পরিচয় সংরক্ষিত হয়েছে নজরুলের এ কবিতায়-

‘ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়
যাচে বহুজন।’

দোলনচাঁপার মধ্যে নজরুলের যে প্রেম ভাবনা তারই অধিকতর পরিষ্ফুট রূপসমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়ানট’ কল্পনা মাধুর্য্যে নিসর্গ সম্ভোগে ও প্রেমের অন্তরঙ্গ আস্বাদনে পরিণত চিন্তা স্পষ্ট। এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা বিজয়িনীতে কাব্যের মূল সুরই নয়, নজরুলের মানবিক প্রেমমূলক কাব্যগুলোর মূল সুরও এতে ধ্বনিত।

‘হে মোর রাণী। তোমার কাছে
হারমানি আজ শেষে, আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার
চরণ তলে এসে।’

‘সিন্ধু হিল্লোল’-এর ‘সিন্ধু’ কবিতায় কবি সিন্ধুকে চির বিরহের প্রতীক ভেবেছেন। সমুদ্রকে কবি সমব্যথী মনে করেছেন-

‘এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি
কাঁদে মোর প্রিয়া।’

চক্রবাক নজরুলের শ্রেষ্ঠ প্রেমমূলক কাব্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এরও মূলসুর প্রেম-বিরহ। এখানে কবি প্রকৃতিকে আর তার প্রেমিকাকে এক করে দেখেছেন। বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, কর্ণফুলিল প্রভৃতি কবিতায় এ স্বাক্ষর বিদ্যমান-

‘তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আখিঁর কাজল রেখা
তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা।’ (গুবাক তরুর সারি)

অথবা

‘তুমি পদ্মা, হারানো গোমতী ভুলে যাওয়া ভগীরথী
তুমি কি আমার বুকের তলায় প্রেয়সী অশ্রুমতি(কর্ণফুলি)

নজরুলকে ঘরের বাঁধন কোনদিন বেঁধে রাখতে পারেনি। তাই বাঁধন হারা চির পথিক পৃথিবীর প্রেমে ধরা দিতে প্রলুব্ধ হয়েছিল বটে; কিন্তু কোন মর্ত্যবাসিনী বেশী দিন তাকে স্নেহাঞ্চলে বেঁধে রাখতে পারেনি। চির চঞ্চল কবি তাই বার বার বের হয়েছেন- কারণ

‘সে যে পথের চির পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?’

সুতরাং এই ‘পথ পাগল’ কবিকে কে বন্ধনে আবদ্ধ রাখবে? তাই কবি আবেগ ভরা কণ্ঠে ‘অভিশাপ’ কবিতায় বলেছেন-

‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারে সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।’

নজরুলের প্রেমানুভুতি ও সৌন্দর্যের মধ্যে কোন অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা ছিল না, সব সংস্কার মুক্ত খাঁটি মানবিক প্রেম ও সৌন্দর্যের সাধক ছিলেন তিনি। মানবিক রূপ দেখে তিনি আধ্যাত্ম বিলাসে মগ্ন হননি। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ঐশ্বর্যের মধ্যেও অনুভব করেছেন নিজের বাসনা, রঙ্গিন হৃদয়ানুভূতিরই ক্রন্দন ও উল্লাস। বাংলা সাহিত্যের আধ্যাত্ম প্রবণ প্রেমে নজরুল সংযোগ করেছেন মানবিক প্রেমের বিরহ মিলন।

তাই আমরা বলতে পারি, নজরুল ইসলাম বিদ্রোহে ছিলেন হিমালয়ের মত সুউচ্চ ও জীবন্ত আগ্নেগিরির মত দহন ক্ষমতা সম্পন্ন এবং প্রেমের ক্ষেত্রে ছিলেন স্রোতস্বিনী নদীর জোয়ারের মত। তার প্রেমের ফেনায়িত তরঙ্গ কুল ছাপিয়ে একাকার হয়ে গেছে। তার বিদ্রোহের পেছনেও ছিল খরস্রাত নদীর মত দেশপ্রেম। তার দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম দুটি ধারাই কোথাও কোথাও বানের পানির ন্যায় সব কিছুকে একাকার করে দিয়েছে। 

পরিশেষে আমার এক লেখক বন্ধুর কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, নজরুলের বক্ষটা (ভালবাসার হৃদয়টা) এতই প্রশস্ত ছিল যে, সমস্ত পৃথিবী তার বক্ষের ভেতর ঢুকে যাওয়ার পরও আরও জায়গা খালি ছিল।

মোঃ রুহুল আমিন

অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ

ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com

পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ 

মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।