বাংলা সাহিত্যের চর্চা সুদূর অতীতের চর্যাপদ থেকে অদ্যাবধি প্রায় হাজার বছর সময় পেরিয়ে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের কাননে পরিচর্যারত যত মনীষি মালীর অবির্ভাব ঘটেছে; মধুসূদন ছিলেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। সৌখিন মালী যেমন দেশ-বিদেশের অনিন্দ্য সুন্দর ও দুর্লভ পুষ্পরাজি চয়ন করে নিজের বাগানকে সমৃদ্ধ করে তোলে, ঠিক তেমনি মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩) পাশ্চাত্য সাহিত্যে কানন থেকে দুর্লভ সাহিত্য রীতি চয়ন করে বাংলা সাহিত্য কাননে যথাস্থানে স্থাপন করে কাননকে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে সত্যটি চোখে পড়ে তা হল, মধুসূদনের পূর্বে বাংলা সাহিত্য ছিল গতানুগতিক। বিধিবদ্ধ নিয়ম নীতির ভিতর ছিল এর অবস্থান। কবিদের পয়ারের বাইরে বিচরণ করার সুযোগ ছিল না। মধুসূদনই সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে বৈচিত্রের সমাবেশ ঘটালেন। তাঁর এই বৈচিত্রতা ছিল বহুমুখী। আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ছন্দ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনলেন তিনি। তাঁর হাতের ছোঁয়া পেয়ে কবিতা, নাটক, প্রহসন তথা সাহিত্যর সকল ক্ষেত্র যেন পরশমণির ছোঁয়া পেল। সকল সৃষ্টিকর্ম থেকে আলাদা সুবাস বইতে লাগল। এছাড়াও তিনি যে দুঃসাহসিক কর্মে হাত দিলেন তা হল মহাকাব্য রচনা । এই অদম্য শক্তি তিনি সঞ্চয় করেছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য নির্যাস থেকে। তিনি আকণ্ঠ পান করেছিলেন মহাকাব্যের সঞ্জীবণী সুধা। মহাকাব্য সাহিত্য সংসারে একটি রূপসৃষ্টি। যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কবি প্রতিভাকে আশ্রয় করে মহাকাব্যের বিচিত্র অভিব্যক্তি ঘটেছে।

সংস্কৃত-অলঙ্কার শাস্ত্রীরা যাকে ‘মহাকাব্য’ নামে আখ্যায়িত করেছেন, পাশ্চাত্য দেশে তাকে বলা হয় ‘EPIC’ । বহিরাঙ্গ লক্ষণের দিক দিয়ে মহাকাব্য ও এপিকের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা গেলেও এদের স্বরূপ লক্ষণ বিষয়ে ভারতীয় ও ইউরোপীয় অলঙ্কারিকদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায় না। মহাকাব্যের কাহিনীটি হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক। এর নায়ক হবে সদ্বংশজাত উচ্চকুল সম্ভূত মহৎগুন সম্পন্ন। এতে শৃঙ্গার, বীর অথবা শান্ত তিনটি রসের যে কোন একটির প্রাধান্য বিরাজ করবে, অন্য রসগুলি থাকবে সঞ্চারীরূপে। মহাকাব্যের সর্গগুলি নাতিদীর্ঘ কিংবা নাতিহ্রস্ব হবে না এবং সর্গসংখ্যা অষ্টাধিক হতে হবে।

পাশ্চাত্য এপিকেও উপরোল্লিখিত লক্ষণ সমূহের অনেকগুলি দেখতে পাওয়া যায়। বিরাট ঘটনাকে কেন্দ্র করে জীবনের গভীরতম উপলব্ধি হতেই মহৎ কাব্যের সৃষ্টি। এপিকের ঘটনা বস্তুর পটভূমিতে থাকবে জাতীয় ইতিহাস কিম্বা পৌরাণিক কাহিনী। মর্তমানবদের জীবন কথার সঙ্গে এতে স্থান পায় দেবদানবদের অতিলৌকিক লীলা। এপিকের নায়ক হবেন শক্তিধর জাতীয় বীর, তার থাকবে সমুচ্চ আদর্শ, তাঁর জীবনটি হবে মহিমাদীপ্ত। কাহিনীর অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা, সময়ের পারস্পর্শ ও কাহিনী বর্ণনায় নাটকীয়তা পাশ্চাত্য এপিকের বিশিষ্ট লক্ষণ। এতে চরিত্র সৃষ্টির প্রতিও কবির দৃষ্টি সজাগ রাখতে হয়। এপিক রচিত হয় একটি মাত্র ছন্দে, যার প্রবাহের মধ্যে স্পন্দিত হয়ে ওঠে উদাত্ত গম্ভীর সংগীত ধ্বনি। এপিকের আদি-মধ্য ও অন্তঃসমন্বিত কাহিনীর ছন্দিত রূপায়ন। এরিস্টটলের মতে, “As to that poetic imitation which is narrative in form and employs a single metre, the plot manifestly ought, as in a tragedy, to be constructed on dramatic principles. It should have for its subject a single action, whole and complete, with a beginning, a middle, and an end”.

মহাকাব্য ও এপিকের স্বরূপ প্রকৃতি হতে বোঝা যায়, শ্রোতা অথবা পাঠককে গল্প শোনানোই এদের প্রধান লক্ষ্য । মহাকাব্যের বিষয় বস্তুতে রূপভেদও আবার চোখে পড়ে।

* জাত মহাকাব্য: এই শ্রেণীর কাব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ঐগুলি কোন একজন কবির একলা সৃষ্টি নয়। এদের মধ্যে রয়েছে অজ্ঞাতনামা নানা কবি প্রতিভার মুদ্রাঙ্কন। বহুকবির রচিত বহু কাহিনী মূল বিষয়টির চতুর্দিকে শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ কবির সর্বগ্রাসী প্রতিভার স্পর্শে গল্পগুলি সন্নিবদ্ধ হয়ে সুসামঞ্জস্য শিল্প মূর্তিতে অপূর্ব বিরাটত্ব লাভ করেছে। এগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয় সমগ্র জাতির জীবনদর্শন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। হোমারের ইলিয়াড’ ও ‘অডিসি’, বাল্মীকির ‘রামায়ন’ ও ব্যাসের ‘মহাভারত’ এই শ্রেণীর মহাকাব্য, এগুলি একাধারে কাব্য ও ইতিহাস।

* সাহিত্যিক মহাকাব্য: এগুলির আকৃতি জাত মহাকাব্যের মত অতিকায় নয়। কিন্তু ঘটনাবস্তু সংহত ও সুসংবদ্ধ। এ কাব্যগুলি অনেক পরের সৃষ্টি-কিছুটা প্রাচীন ‘জাত’ মহাকাব্যের আদর্শের ছায়ায় এইগুলি রচিত। কবি বিশেষমানস প্রকৃতি, কবি যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই যুগের আশা-আকাঙ্ক্ষাই এগুলির মধ্যে রূপায়িত হয়। এই জাতের কাব্য কবির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। এগুলির শিল্প মূর্তির অন্তরালে প্রচ্ছন্ন থাকে কবির ব্যক্তিগত রুচি ও আদর্শের প্রভাব, পাতায় পাতায় কবির নিপুণ হাতের পরিচয় পাওয়া যায়। কালিদাসের ‘রঘুবংশ’, মিল্টনের ‘Paradise Lost’ মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ প্রভৃতি সাহিত্যিক মহাকাব্য। এখন দৃষ্টি দেয়া যাক মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের দিকে।

মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ট কবিকীর্তি হল ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য (১৮৬১)। এই কাব্যের মূল আখ্যায়িকা রামায়ন হতে গৃহীত। রামানুজ লক্ষণ কর্তৃক রাবণের পুত্র মেঘনাদ নিধনই এর বর্ণনীয় বিষয়। রামায়নের তুলনায় এই কাব্যের পরিধি অতিশয় সংকীর্ণ। সপ্তকাণ্ড রামায়নের একটি কাণ্ডের একটি খন্ডাংশ নিয়ে এটা রচিত। মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনা সংগঠিত হতে তিন-চার দিনের বেশী সময় লাগেনি। অষ্টাদশ পর্বব্যাপী মহাভারত তুলনায় এটা খুবই ক্ষুদ্র। এমনকি ভার্জিলের (খৃষ্টপূর্ব ৭০-১৯) ‘ইনিড’ দান্তের (১২৬৫-১৩২১) ‘ডিভাইনা কমেডিয়া’ এবং ট্যাসোর (১৫৪৪-১৫৯৫) ‘জেরুজালেম ডেলিভার্ড’ এটা অপেক্ষা অনেক বেশী বিস্তৃত পরিসর। কিন্তু প্রাচ্যের এই বিষয়বস্তু রচনায় বহু গ্রন্থপাঠী মধুসূদন পাশ্চাত্যের বহুকাব্য হতে নানা উপকরণ আহরণ করে বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের পত্তন করেন। হোমার (আনুঃ ৭০০ খৃঃ পূঃ), দান্তে, টাসো প্রভৃতি মহাকবিগণের কাব্যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাইকেল মধুসূদন মহাকাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। প্রাচ্যের সংস্কৃতি আলঙ্কারিকরা মহাকাব্যের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন মধুসূদন তা মানেননি। তাই তিনি পাশ্চাত্য আদর্শকে অনুসরণ করেছেন। ফলে তিন প্রকারে তার কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব পড়েছে। প্রথমতঃ ঘটনা বা কাহিনীতে, দ্বিতীয়তঃ ভাষা ও শব্দের ব্যবহার এবং তৃতীয়তঃ আদর্শ চেতনায়।

‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের কাহিনী বা কাঠামো রচনায় মধুসূদনের উপর গ্রীক মহাকাব্য রচনা রীতির প্রভাব দৃষ্ট হয়। কিন্তু তাই বলে তিনি গ্রীক কাহিনী গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন- “I shall not borrow Greek stories, but write rather try to write-as a Greek would have done”

হোমার তাঁর ‘ইলিয়াড’ কাব্যে ট্রয়যুদ্ধের শেষ কয়েক মাসের ঘটনা অবলম্বনে মহাকাব্য রচনা করেন। মধুসূদনও গ্রীক আদর্শে প্রভাবান্বিত হয়ে মেঘনাদ বধে লঙ্কা সমরের খন্ডাংশকেই তার কাব্যের উপজীব্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এছাড়া এই কাব্যে দ্বিতীয় স্বর্গে যেখানে ‘রক্ষকুল রাজলক্ষ্মী’ অন্যান্য দেবতাদের সহায়তায় রামের জয় এবং রাবণের পরাজয় কামনা করেছেন; সেই অংশের সাথে হোমারের ওডিসি কাব্যের যেখানে দেবী ‘এমেনে’ টেলিমেকাসের সহায়তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এই দু’টি অংশের মিল লক্ষণীয়। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের পঞ্চম সর্গে মায়াদেবী স্বপ্ন দেবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন ঘুমন্ত লক্ষণের কাছে যেতে, আর ইলিয়ার্ড গ্রন্থে ‘জিউস’ স্বপ্নকে নির্দেশ দিচ্ছেন ‘আগামেনের’ কাছে যেতে। অষ্টম সর্গে বিদেশী প্রভাব অনেকটা স্থুলরূপ পেয়েছে। এখানে একই সাথে দান্তে, হোমার এবং ভার্জিলের অনুকরণ দেখি। মধুসুদন নিজে অবশ্য ভার্জিলের “ঈনিদের কথাই লিখেছেন, কিন্তু হোমারের এডিসিম্বর প্রভাবই সমাধিক দেখা যায়। এখানে রাম নরকে যাচ্ছে তার পিতার আত্মার সংগে সাক্ষাত করতে, যেমন ঈনিদম্ব পাতালে গিয়েছিলেন তার পিতা ‘এ্যান কিসিসের’ সাথে সাক্ষাত করতে অথবা ‘ওডিসি’ তাঁর মাতার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন চির নিশাবৃত মৃত্যুর দেশে। এছাড়া কাব্যের প্রারম্ভে মধুসূদন যে দেব বন্দনা করেছেন তার ভার্জিলের ‘ঈনিদ’ কাব্যে বর্ণিত দেব বন্দনার মত। মধুসুদনের কাব্য সরস্বতী বা বাগ্দেবী এবং মিল্টনের (১৬৩৮-১৬৭৪) ‘MUSE’ অভিন্ন।

ভাব-ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে মধুসূদনের বিদেশী ক্লাসিক ভঙ্গিকে আয়ত্ত করে বাংলা কাব্যকে তার গতানুগতিক বিমর্ষ ক্ষেত্র হতে মুক্ত করেন এবং তাঁকে জীবন রসে পরিপূর্ণ করেন। বিশ্লেষণ ও উপমা প্রয়োগের মধ্যেই মধুসূদনের এই বিশেষত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হোমারের উদ্ভাবিত নাটকীয় গতিময় উপমা বা ‘Homeric Similee’ উপমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে মধুসূদন হোমারকেই অনুসরণ করেছেন। এর প্রমাণ ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে প্রচুর পরিমাণে সিংহ’ এবং ‘অগ্নির’ উপমা প্রয়োগ দেখা যায়। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের অলঙ্করণ রীতি পাশ্চাত্য কাব্যকলার অনুকরণে রচিত হয়েছে। এ কাব্যে পাশ্চাত্য কাব্যাদর্শের প্রবল প্রভাব পড়েছে। রাবণ চরিত্রের পরিকল্পনায় বলিষ্ঠ জীবনাদর্শ মূর্ত হয়েছে। মিলটনের প্যারাডাইজ লস্টের শয়তান যেমন দুর্জয় বাসনার প্রতীক, রাবণও তেমনি অশেষ আশা ও অফুরন্ত শক্তির প্রতীক। মধুসূদনেরর কাব্যে অদৃষ্টবাদের যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার আদর্শ কবি গ্রীক হতে নিয়েছিলেন এবং ট্রাজেডি কল্পনায় পাশ্চাত্য কবিদের নিকট ঋণী। মধুসূদনেরর নিকট ‘Milton is Divine: ছন্দ, ভাব রচনারীতি প্রভৃতি সকল বিষয়েই মধুসূদন মিল্টনকে অনুসরণ করেছেন।

‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের কবি প্রকৃতিতে বিদেশীর উপর দেশীয় ভাব জয়ী হয়েছে। ইউরোপীয় ভাব কল্পনার অনুসরণ ও অনুকরণ এই কাব্যে যতটুকু আছে তা শুধু আকৃতিগত। কেননা এটা ইউরোপীয় ছাঁচে ঢালাই করা হলেও দেশীয় মালমসলা এতে বিদ্যমান। তারপর এই কাব্যের প্রকৃতিতে যে প্রভাব আছে তা গ্রীক নয়, আধুনিক পাশ্চাত্য প্রভাব, যদিও মধুসূদন কল্পনা ভঙ্গিতে গ্রীক আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন এবং এটা ‘Three-fourth Greek’ বলে স্বীকার করেছেন।

‘মেঘনাদ বধ’ মধুসূদনের একমাত্র কাব্যকীর্তি- যা শুধু তার কবি প্রতিভার নয়, তাঁর কবি জীবনের বা অন্তরস্থ সেই কবি পুরুষেরও পরিচয় বহন করছে। দেব-দেবীগণের চরিত্র পরিকল্পনায় হোমারের মহাকাব্যের ভাবাদর্শ অনুসৃত হয়েছে, এই রীতি কাব্যের অন্যত্র লক্ষ্য করা যায় না। কবি তার বন্ধুকে এই সম্পর্কে লিখেছেন, “Homer is nothing but battles”। এই কাব্যের অদৃষ্টবাদ মূলতঃ প্রাচ্য সংস্কার ও হিন্দু মনোভাবের ফল, অদৃষ্টবাদে পাপতত্ত্ব বা আদি গ্রীক চিন্তার অহেতুক দৈব স্বেচ্ছাচার এই দুই এর কোনটাই নেই। এই অদৃষ্টবাদ শেষ পর্যন্ত হিন্দু কর্মবাদে পৌঁছেছে। এখানে প্রাচ্যের হিন্দু সংস্কারই জয়ী হয়েছে। ভাষার লালিত্য ও ছন্দ মাধুর্য বিষয়ে তিনি ল্যাটিন কবি ভার্জিলের আদর্শ গ্রহণ করেছেন, কিন্তু বাক্য গঠনে খাঁটি বাংলা ইডিয়ম ও সংস্কৃত শব্দ যোজনা রীতি রক্ষা করছেন। যেমন- বারীন্দ্র, জলনাথ, জলদলপতি, কেশববাসনা, বাঘবাঞ্ছা, ঠাট, খেদইনু, জাঙাল, গুননীধি প্রভৃতি। সত্যই তিনি ইউরোপীয় আদর্শকে বরণ ও যোজনা করেছেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে বাঙালী জীবন ও বাঙালী সংস্কারের মমতা ত্যাগ করতে পারেননি। সীতা চরিত্রের প্রেরণামূলক হিন্দু সংস্কারই জয়ী হয়েছে বীরাঙ্গনা প্রমীলা ও বাঙালী গৃহবধুর স্নিগ্ধ শোভায় সমুজ্জ্বল, রাবণের সকল দুঃখ, সকল পরাজয়ের মূলে তার স্নেহশীলতা; রাম ভ্রাতৃস্নেহের অত্যাধিক প্রবলো পৌরুষের শেষ লক্ষণ টুকুও হারিয়েছে। এমনকি রাজ্যেলোভী গৃহশত্রু বিভীষণ-যে স্বার্থ ও পরমার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে নিজের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়েছেন; যার চক্রান্ত ও সহায়তায় মেঘনাদ হত হয়েছে- সেও মৃত্যুশয্যশায়ী ভ্রাতৃষ্পুত্রের মুখপানে চেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। ধর্ম বিশ্বাস ও স্বার্থনিষ্ঠা তাকে কঠোর করতে পারেনি। কাব্যটির আদি ও অন্তে বিলাপের সুর অনুরণিত হয়েছে।

শ্রদ্ধেয় আব্দুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) মধুসূদনের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে তাঁর জীবনোপলব্ধির কারণ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ “এই কাব্যে আমরা মানব জীবনের বিশিষ্ট কোন একটি দিকের পরিচর্যা পাইনা, কিন্তু মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বকে কর্মচঞ্চল অবস্থায় দেখি। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হইতেছে কবির জীবনোপলব্ধির পরিপূর্ণতা, …………..’মেঘনাদ বধ’ কাব্যে আমরা জীবনের প্রকাশ দেখি দ্বন্ধের মধ্যে, সর্বনাশের মধ্যে এবং কোলাহল ও আবর্তকে অবলম্বন করিয়া সর্বশেষ বিলয়ের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীর উৎকণ্ঠা এবং অপরিমেয় আশা রাম-রাবণের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। এ কথা বলা চলে যে, মধুসূদন সে যুগে জাতির পূর্ণ সচেতন মুহূর্তে তিনি রূপ দিয়েছেন। যে মুহূর্তে জাতির মানস বিকাশ ঘটে, সে মুহূর্তেকে তিনি রূপ দিয়েছেন। মানব অভিজ্ঞতার উপাদানগুলি যে কোন যুগে অতি অল্প সংখ্যক লোকের কাছেই ধরা পড়ে; মধুসূদন সেই অল্প সংখ্যকদেরই একজন।”

কবি ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের সূচনায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বীররস প্রধান মহাকাব্য রচনার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনার সূচনাতেই মনে পড়ে কবি তার এক বন্ধুর কাছে লেখা পত্রের কথা। যেখানে তিনি বন্ধুকে লিখেছেন: “You must not judge of the work as a regular Heroic poem. I never meant it such. It is a story a tale, rather heroically told”. অতএব দেখা যাচ্ছে কাব্য রচনায় অগ্রসর হয়ে কবি একে আর বীর রসাত্মক করে তোলার ব্যাপারে উৎসাহ পোষণ করেননি। কাব্যের নায়ক মহাতেজস্বী পরাক্রান্ত রাবণকে কবি উপস্থাপন করেছেন শোকাহত মূর্তিতে। পুত্র, আত্মীয় পরিজনের মৃত্যুতে রাবণের আক্ষেপোক্তিগুলি সংযমের বাঁধ ভেঙ্গেছে। বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদে শোকাভিভূত রাবণের অন্তরের কথা-

“হৃদয় বৃত্তে ফুটে যে কুসুম,
তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়
ডোবে শোক সাগরে…………….”।

রাবণের শোকের পরিণতি উৎসাহে, কারুণ্য মিশে যায় উদ্দীপনায়। এই চরিত্র অঙ্কনে কবি অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে মানব জীবনের বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন। ফলে চরিত্রটি কাব্যরসের অবিমিশ্রতার গৌরব হতে বঞ্চিত হয়েছে। মানব ভাগ্যের অহেতুক লাঞ্ছনার মর্মান্তিক জ্বালা অনুভব করেছে এবং মেঘনাদ বধ কাব্যটি বীররসাত্মক অথবা অবিমিশ্র করুণ রসের সুনাম অর্জনে বাধা প্রদান করেছে। কাব্যের সূচনায় “গাইব, মা বীররসে ভাসি, মহাগীত,” যে উক্তিটি কবি করেছেন তা আক্ষরিক অর্থে চরিতার্থ হয়নি। উক্তিটিকে কবি কল্পনায় নিয়ামক রূপে গ্রহণ করারও কোন সঙ্গত কারণ নেই। বরং আখ্যান ধারার চরিত্রগুলি যে বাস্তব রুপ পরিগ্রহ করে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে, সমস্ত সংস্কার বর্জন করে আস্বাদনই কাম্য। তাতেই এই কাব্যে প্রকৃত রসের স্বাদ পাওয়া যাবে। সে রস শুদ্ধ বীররস বা করুণরস নাও হতে পারে। কিন্তু তাতে সুস্থ জীবনরসের আস্বাদ মেলে। তাতেই এই কাব্যের গৌরব। ‘মেঘনাদ বধে’র প্রথম আলোচক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করে সে সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তার মধ্যে, বাক্যের জটিলতা, উপর্যুপরি রাশি রাশি উপমা একত্রিত করা, প্রথা বহির্ভূত নিয়মে ক্রিয়াপদ নিষ্পাদন ও ব্যবহার, বিরাম যতি সংস্থাপনের দোষে স্থানে স্থানে শ্রুতিদৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এইরূপ দোষাশ্রিত হইয়াও কাব্যখানি এত উৎকৃষ্ট হইয়াছে যে, বঙ্গ ভাষায় ইহার তুল্য দ্বিতীয় কাব্য দৃষ্টিগোচর হয় না।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) ‘মেঘনাদ বধ’ সম্পর্কে যে অভিমত তুলে ধরেছেন তা অত্যন্ত সুচিন্তিত; “ইংরেজী ভাষায় ও সাহিত্যে মাইকেলের অধিকার ছিল প্রশস্ত, অনুরাগও ছিল সুগভীর। সেই সংগে গ্রীক, ল্যাটিন আয়ত্ত করে য়ুরোপীয় সাহিত্যের অমরাবতীতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন ও তৃপ্ত হয়েছেন সেখানকার অমৃত-রস ভোগে ………… মাতৃভাষায় তিনি এমন একটি কাব্যের আবাহন করলেন যে কাব্যে স্খলিতগতি প্রথম-পদচারণার ভীরু সতর্কতা নেই। এই কাব্যে বাহিরের গঠন আছে বিদেশী-আদর্শ, অন্তরে আছে কৃত্তিবাসী বাঙালীর কল্পনার সাহায্যে মিলটন হোমার প্রতিভার অতিথিসৎকার। এ আতিথ্যে অগৌরব নেই।”

কাব্যের দোষত্রুটি সম্পর্কে কবি নিজেই সচেতন ছিলেন, তাই কবির কথা দিয়েই শেষ করতে চাই। কবি নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন: “I find that here many matrical blemishes in the earlier books of Meghnads. I am sure the poem has many faults. What human production has not”?

লেখক পরিচিতি

অধ্যক্ষ মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ

ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com

পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ 

মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।