– অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
‘ঈদ’ আরবী শব্দ। ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ খুশি, আনন্দ, উচ্ছাস, উৎসব। ‘আযহা’ উযহিয়াহ শব্দের বহুবচন। ‘আযহা’ শব্দের অর্থ ‘চূড়ান্ত আত্মসমার্পণ।’ তাই ‘ঈদুল আযহা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘চূড়ান্ত আত্মসমর্পনের আনন্দ বা উৎসব। পারিভাষিক অর্থে ‘ঈদুল আযহা শব্দের অর্থ ১০ জিলহজ্জ্ব তারিখে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়ার পর পশু কুরবাণী করে মহান আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন। কুরবাণী আরবী শব্দ। এর অর্থ নৈকট্য লাভ। ফার্সী ভাষায় কুরবানী শব্দের আভিধানিক অর্থ-জবেহ, পারিভাষিক অর্থ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্ঠি লাভের উদ্দেশ্যে জবেহ করা।
আইয়ামে জাহেলী যুগে আরবদের মধ্যে দুটি অইসলামী উৎসব প্রচলিত ছিল। একটা হল নওরোজ উৎসব অন্যটি হল মিহিররোজ উৎসব (উকাবের মেলা)। সকল নারী-পুরুষ এই মেলায় অংশ গ্রহণ করত। তাদের মধ্যে অনেকে অশালীনভাবে এই উৎসবে মেতে উঠত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হিজরতের পর এই দুটি উৎসবের পরিবর্তে মুসলমানদের জন্য দু’টি উৎসবের প্রচলন করেন। তার একটি ‘ঈদুল ফিতর’ অন্যটি ‘ ঈদুল আযহা’। ঈদুল ফিতরটি হল দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ১লা শাওয়াল তারিখে। সিয়াম সাধনার পর ছদাকাতুল ফিতর-এর মাধ্যমে এই উৎসবের প্রচলন তাই এর নাম ‘ঈদুল ফিতর’। অন্যটি হলো ১০ জিলহজ্জ্ব পশু কুরবাণীর মাধ্যমে উৎযাপিত উৎসটি হল ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবাণীর ঈদ। উপমহাদেশে কুরবাণীর ঈদকে বকরাঈদ বলা হয়।
কুরবাণী ইতিহাস অতি প্রাচীন। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) তার পুত্রদের বিবাদ মিমাংসার কামনায় কুরবাণী করেছেন বলে জানা যায়। ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও কুরবাণী বা উৎসর্গের রীতি লক্ষ্য করা যায়। সেখানেও সন্তানসহ অন্যান্য পশু কুরবানীর রীতি প্রচলিত আছে। কুরবাণী এই শব্দটি হিব্রু ভাষায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। হিব্রু ভাষায় ‘নহর’ যার অর্থ রক্ত প্রবাহিত করা। কুরবাণী শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ Sacrifice। Sacrifice শব্দের অর্থ বলি, কুরবাণী, বিসর্জন, ত্যাগ স্বীকার। ইসলাম বাদে অন্যান্য ধর্মীয় কুরবানীতে উৎসর্গকৃত মানব বা পশুর কুরবানীর পর তার রক্ত আরাধ্য দেব/দেবীর অংগে লাগানো বা মাখানো হয়। ইসলাম ছাড়া আজও অনেক দেশে অনেক ধর্মশালায় বলি প্রথার প্রচলন আছে। পূর্বে ঐ সকল ধর্মে মানব সন্তানও বলি দেওয়া হত। বর্তমানে মানব সন্তানের পরিবর্তে প্রকাশে পশু বলিদান করা হয়। তবে এখনও মাঝে মধ্যে শোনা যায়, গুপ্তভাবে কোথাও-কোথাও মানব সন্তান বলিদানের রীতি প্রচলিত আছে। বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তথা মুসলমানগণ যে কুরবাণী পালন করে আসছে; তার দীর্ঘ একটা পটভূমি রয়েছে। তার সারসংক্ষেপ হল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। সন্তানসম্ভাবা স্ত্রী হাজেরাকে আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আঃ) অল্প কিছু খাদ্য ও পানীয় দিয়ে কাবাঘরের নিকটবর্তী নির্জন এলাকায় রেখে আসেন। আল্লাহর অসীম করুণায় এই নির্জন স্থানে ইসমাইলের জন্ম হয়। আল্লাহপাক বিবি হাজেরা ও শিশু ইসমাইলের যাবতীয় অসুবিধা থেকে হেফাজাত করেন। বৃদ্ধ বয়সে ইব্রাহিম (আঃ) শিশু পুত্রকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভাল বাসতেন। সাত বছর বয়সে মতান্তরে বার বছর বয়সে আল্লাহপাক পিতা ও পুত্রকে পরীক্ষার জন্য মনোনীত করেন। ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্ন দেখেন আল্লাহ তাকে কুরবানী করার কথা বলছেন। স্বপ্নের নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন ভোরে তিনি একশত উট কুরবানী করেন। পরের রাতে আবারও একই স্বপ্ন দেখেন এবং একই ভাবে একশত উট কুরবানী করেন। পরের রাতে আবারও স্বপ্ন দেখেন যে, আল্লাহ তাকে সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করতে বলছেন। এবার ইব্রাহিম (আঃ) ভাবতে থাকেন এই বৃদ্ধ বয়সে তার সবচেয়ে বেশী প্রিয় বস্তু কি! ভেবেচিন্তে তিনি বুঝতে পারেন তার শিশু পুত্র ইসমাইল (আঃ) তার সবচেয়ে প্রিয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সবচেয়ে প্রিয় ইসমাইলকে আল্লাহর-রাহে কুরবানী করবেন। সিদ্ধান্তমত হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার অভিপ্রায় ও আল্লাহর নির্দেশের কথা ইসমাইল (আঃ) কে জানালেন। যোগ্য পিতার উপযুক্ত সন্তানের মত ইসমাইল (আঃ) পিতাকে জানান, তার প্রতি আল্লাহপাকের যে নির্দেশ, সেরূপ যথাযথ ভাবে পালনের পরামর্শ দিলেন। তিনি পিতাকে আরও জানালেন, তার কুরবানী করার কাজে তাকে তিনি ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত দেখতে পাবেন।
ইব্রাহিম (আঃ) পুত্রকে দূরে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গেলেন এবং কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হলেন। ইসমাইল (আঃ) তার পিতাকে কুরবানী করার আগে নিজের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে নিতে বলেন, যেন কুরবানীতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। ইব্রাহিম (আঃ) তার পুত্রের কথামত ইসমাইলের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে কুরবানীর জন্য গলায় ধারাল ছুরি চালালেন; কিন্তু ছুরি ইসমাইলের গলায় বিঁধলো না। ছুরির ধার পরীক্ষা করে বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। এবার ইসমাইল তাঁর পিতাকে জানালেন তিনি যেন কাপড় দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে নেন। কারণ পুত্র বাৎসল্যের জন্য হয়ত তিনি ছুরি চালানোর সময় দূর্বল হয়ে পড়ছেন। তাই কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা থাকলে তিনি পুত্রের মুখ দেখতে পাবেন না, তাহলে তিনি কুরবানী করতে সক্ষম হবেন। ইব্রাহিম (আঃ) এবার পুত্রের পরামর্শ মত নিজের চোখ বেঁধে নিলেন এবং পুনরায় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে ছুরি চালালেন; সংগে সংগে কুরবানী হয়ে গেল। চোখ খুলে চেয়ে দেখেন একটি দোম্বা কুরবানী হয়েছে। পুত্র ইসমাইল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মহান আল্লাহর কুদরত ও মহিমায় কথা স্মরণ করে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলা’মীনের শানে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর ত্যাগের এই সুন্নাতটি আজ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য ওয়াজিব।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অনেক স্থানে কুরবানী সম্পর্কে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহপাক এরশাদ করেন, “কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না বরং তোমাদের খোদাভীতি ও আন্তরিক অবস্থায় পৌঁছে থাকে।” এছাড়া অন্য এক স্থানে আল্লাহ পাক বলেছেন, “আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানী করুন।” অন্যত্র বলা হয়েছে “নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কোরবানী, জীবন- মৃত্যু সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে।”
কুরবানীর গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদিস শরীফেও উল্লেখ আছে, “কুরবানীর দিন আল্লাহর নিকট কুরবানী করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কোন কিছু নেই।” অন্য আর এক স্থানে বলা হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “কুরবানীর পশুর গায়ে যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী লেখা হয়।” কুরবানীর প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “যে লোক কুরবানীর সময় সামর্থ থাকা সত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে”।
উল্লেখিত কুরআন ও হাদিসের আলোকে কুরবানীর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কুরবানী ত্যাগের প্রতীক। মহান আল্লাহর ত্যাগের পরীক্ষায় হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল (আঃ) উত্তীর্ণ। কুরবানী ত্যাগের শিক্ষা দেয়। কুরবানীর দিন কুরবানীর মাংস এক-তৃতীয়াংশ গরীব মিসকিনদের ভিতর বন্টন করা মুস্তাহাব। এছাড়া কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ গরীব-মিসকিনদের ভিতর বন্টন করা হয়। যাহা ধনী ও দরিদ্রের ভিতর ঈদের আনন্দ ভাগাভাগিতে সহায়তা করে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব কুরবানীর ঈদ। আজ সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রথম থেকে প্রবর্তনীয় এই ধর্মীয় উৎসব যথাযথভাবে পালন করে আসছে। বিশ্ব মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জমায়েত হজ্জ্বের সময় হাজীদেরও কুরবানী করতে হয়। হজ্জ্বের সংগে কুরবানীর সংশ্লিষ্ঠতার কারণে কুরবানী ইবাদতটি বিশ্বভাতৃত্ব বন্ধনের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ভবিষ্যতেও অনন্তকাল ধরে ঈদুল আযহা প্রতিটি মুসলমানের ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেবে ত্যাগের এই মহান বার্তা। সর্বশেষে নির্দ্বিধায় বলা যায়, “ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আযহা।”