পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা গ্রামটির নাম কৃষ্ণনগর। এক দাড়িয়া বসত। গ্রামের নাম কৃষ্ণনগর হলেও সরকারি কাগজপত্রে কৃষ্ণনগর-সারুটিয়া ও পাঁজিয়া মৌজা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এক দাড়িয়া বসতি হওয়ার কারণে পুরো গ্রামই কৃষ্ণনগর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে যথাক্রমে হাঁড়িয়াঘোপ ও চুয়াডাঙ্গা-হদ মৌজার সংগে সংযুক্ত হয়েছে। মৌজা অনুযায়ী কৃষ্ণনগর অংশে হিন্দু ও সারুটিয়া অংশে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের বাস। পাঁজিয়া অংশে কিছু মুসলমান এবং কিছু হিন্দু শ্রেণির বাস। সংখ্যায় স্বল্প হওয়ার কারণে পাঁজিয়া মৌজায় বসবাসকারীরা ৭ নংপাঁজিয়া ইউনিয়নের অন্তরভূক্ত না হয়ে ৮ নং সুফলাকাটি ইউনিয়নের আওতাভূক্ত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায় আবার দুই ভাগে বিভাক্ত। একটি হলো নমঃশুদ্র ; অপরটি ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। বাংলাদেশের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ৮নং সুফলাকাটী ইউনিয়নের একটি অবহেলিত গ্রাম এই কৃষ্ণনগর। সুদূর অতীত থেকে অদ্যাবধি এই গ্রামে বসবাসকারী মানুষেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রামের অনেক পরিবার হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। যুগ-যুগ ধরে এই মেল-বন্ধন দৃঢ়তার সাথে টিকে আছে। উৎসব-আনন্দে সবাই মিলেমিশে একাকার। এই গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সংযোগ স্থলেই আমার জন্মস্থান।
এই গ্রামটি বরাবরই অবহেলিত। গ্রামটির চারধারে বিল। স্থলপথে যোগাযোগের একমাত্র গ্রামের রাস্তাটি কাঁচা ও এবড়ো-থেবড়ো। গ্রামে কোন হাট-বাজার নেই। কোন ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই কোন ভাল চিকিৎসক। বসবাসের উপযুক্ত স্থান বলতে যা বুঝায় তার কিছুই নেই। মানুষ বসতি স্থাপনের পর থেকে চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি হয়নি। একমাত্র রাস্তাটিই ছিল এই গ্রামের মানুষদের স্থল পথে চলার একমাত্র অবলম্বন। বর্ষাকালের দুর্ভোগটা ছিল অবর্ণনীয়। এটুলে মাটিতে হাটু কাঁদা ভেঙ্গে চলাচল ছিল খুবই কষ্টসাধ্য।
গ্রামটি অবহেলিত হলেও গ্রামের শিক্ষার হার পার্শবর্তী অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বেশী। ইংরেজ শাসনামল থেকে এখানে বিদ্যা চর্চ্চার প্রচলন ছিল। কাজেম সরদার (কাজেম গুরু) কে এই গ্রামের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে ধরা হয়। কাজেম গুরুর পাঠশালার কথা সাহিত্যিক মনোজ বসুর “সেই গ্রাম, সেই সব মানুষ” গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এ ছাড়া পাঁজিয়ার তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষিত জনেরা অনেকেই তাঁর ছাত্র ছিলেন। যে কথা আমি আমার লেখা “পাঁজিয়া জনপদের ইতিকথা” লেখায় আলোচনা করেছি। পাকিস্তান আমলে এই গ্রামের হিন্দু অংশের প্রথম বি,এ পাশ ললিত কুমার বিশ্বাস, রনজিৎ কুমার মল্লিক এবং মুসলিম অংশে নুর আলি মোড়ল। এই সময় ৫ম শ্রেনীতে একমাত্র বৃত্তি পাওয়া ছাত্র হরমত আলি শেখ। পরে যারা বি, এ পাশ করেন তারা সবাই বাংলাদেশ আমলে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যারা বি, এ পাশ করেন তারা হলেন- ইসলাম উদ্দিন দফাদার, আব্দুল আজিজ সরদার, কাসেম আলি মোড়ল, সন্তোষ বিশ্বাস ও বদ্যিনাথ সরকার। এই গ্রামের প্রথম স্নাতকোত্তর ব্যক্তি সরকার বংশের অশোক কুমার সরকার। পরবর্তীতে মোশারাফ হোসেন সরদার এবং একই পাড়ার রুহুল আমিন হালদার (লেখক) ও হারিন্দ্র নাথ বিশ্বাস। গ্রামের প্রথম চেয়ারম্যান (প্রেন্সিডেন্ট) সমোস সরদার। সরদার বাড়ির হাবিবুল্যা সরদার একজন দীনদার-পরেজগার ব্যক্তি ছিলেন। এই গ্রামের পূর্বাংশের সংগে সংশ্লিষ্ট হাড়িয়াঘোপ অংশে কার্ত্তিক চন্দ্র মল্লিক ছিলেন বৃটিশ ভারতের ম্যাজিট্রেট। আমার জন্মস্থানটি গ্রামের প্রায় মধ্যভাগে হিন্দু-মুসলমান বসতির মিলনের স্থানে। আমার বসতবাড়ি পাঁজিয়া মৌজায় হলেও প্রশাসনিক এলাকা ৮নং সুফলাকাটি ইউনিয়নের আওতাধীন। আমার বসতবাড়িটি দুটি মৌজার মাঝ দিয়ে লম্বালম্বি সমানভাবে বিভক্ত করেছে। আমার জন্মস্থানের কারণে শৈশব থেকে আমি হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে প্রকৃতিগতভাবে অবগত হয়েছি।
এই জনপদের জনবসতি সম্পর্কে তেমন কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পূর্বপুরুষদের বর্ণনা ও এই অঞ্চলের ভূমির গঠন প্রক্রিয়া থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী এই অঞ্চরের ভূমি গঠন হয়েছে হরিহর ও ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা। এই অঞ্চল এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। এখনও এই গ্রামের যে কোন স্থানে ১৫ বা ২০ ফুট খনন করলে বড় বড় গাছের গুড়ি পাওয়া যায়। আর ওই সকল গাছের ছোট ছোট ডালপালা ও পাতালতা পচা জোব অংশ দেখা যায। ধারনা করা হয় ভদ্রা ও হরিহরের পলিতে এ অঞ্চল গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হরিহর নদীর অববাহিকার পলি দ্বারা পাঁজিয়া-মাদারডাঙ্গা-নারায়নপুর-আড়ুয়া অঞ্চলের ভূমি গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয়। হরিহর নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে এ অঞ্চলের ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ভদ্রা নদীর উন্মুক্ত জোয়ার-ভাটার দ্বারা ভূমি গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
বর্তমানে গ্রামের অবস্থান যে অঞ্চলে, সেই অঞ্চলটি পলি দ্বারা ভরাট হয়ে কিছুটা উঁচু ভূমিতে পরিণত হয়। প্রাকৃতিকভাবে গঠিত উচ্চভূমি জন মানুষের বসবাসের উপযোগি হলে এবং জমিদারদের খাজনার প্রয়োজনে তারা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের রায়াত হিসেবে লোকজন এনে বসতি প্রদান করতো। আগত লোকেরা সেই সময়ের জমিদার/গাতিদারদের নিকট থেকে জমির সহজ লভ্যতা, স্বল্প পরিশ্রমে ভাত-মাছের নিশ্চয়তার কারণে এখানে এসে বসবাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমি বসবাসের অধিকতর উপযোগী করার নিমিত্তে ও জন্তু-জানোয়ার, পোকামাকড় থেকে নিরাপদ জীবন-যাপনের জন্য পুকুর বা গর্ত করে সেই মাটি দ্বারা বসবাসের জন্য ঘর উঁচু করে তৈরী করতো। বর্তমানে বিলের যে খালগুলো রয়েছে, অতীতে সেগুলো নদীর অংশ ছিল। ওই নদীতে খরস্রোত জোয়ার-ভাটা ছিল। বিভিন্ন সময় খাল খননের কালে খালের মোহনায় নৌকার অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে। তখন ওই নদীতে বড় বড় সওদাগারী পদীনৌকা মালামাল ক্রয়-ক্রিয়ের জন্য আসা-যাওয়া করতো বলে বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে জানা গেছে।
৬০’ এর দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে ওয়াপদা নদী শাসন প্রক্রিয়া শুরু করে। ওয়াপদা’র এই কার্যক্রমে নদীর বিস্তৃর্ণ প্লাবনভূমি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে নদীর চারণ ভূমির গঠন প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ওয়াপদা’র কার্যক্রম শুরুর পূর্বে এলাকার জনগণ অষ্টমেসে বাঁধের মাধ্যমে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ করে জমিতে ফসল ফলাত। আট মাস বাঁধের মাধ্যমে জোয়ারের পানি আটকে রেখে অধিক পানি সহনশীল জাতের ধানের চাষ করে, ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা মুক্ত হলে বাঁধ কেঁটে জোয়ার-ভাঁটা চালুর মাধ্যমে বিলে পলি উত্তোলন করা হতো। জোয়ার-ভাটা চালুর মাধ্যমে বিলের তলদেশ উঁচু হওয়ার পাশাপাশি বিলে যেমন প্রচুর ধানের ফসল ফলতো তেমনি প্রচুর মাছও জন্মাত। এই বাঁধকে দশের বাঁধও বলা হতো। ওয়াপদা’র নদী শাসন প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে শুরু হয় নদী হত্যার সর্বনাশা কর্মকাণ্ড। জোয়ারের সময় নদীবাহিত পলি প্লাবন ভূমি বা চারণ ভূমিতে ঢুকতে না পারায় নদীর তলদেশে জমতে থাকে। মাত্র ২০ বছরে নদী হত্যার কাজ প্রায় ৭০% সম্পন্ন হয়।
বর্তমানে ভদ্রানদী ভরাট হয়ে বিলে জলাবদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। যতদূর জানা যায়, এই গ্রামে বসবাসকারি মানুষদের পূর্বপুরুষগণ মাছ ও ভাতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বসবাসের জন্য এই গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে। ধারণা করা হয় লর্ড কর্ণওয়ালিস আমলে এই অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠে। এ সময় জমিদাররা জমির স্থায়ী মালিকানা লাভ করায় দাখিলা মূলে প্রজাস্বত্ত স্বীকার করে লওয়া হতো। এ সময় জমিদারদের উত্তরসূরীরাও জমিদারীর অংশ প্রাপ্ত হয়ে প্রজাদের ভিতর খাজনা মূলে দাখিলা প্রদান করতো। পতিত জমি আবাদ ও খাজনা সংগ্রহের জন্য জমিদাররা বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এনে তাদের জমিদারিতে বসতি দিয়ে প্রজা পালন করতো। জমি প্রাপ্তি ও ভাত-মাছের সহজ লভ্যতার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে এখানে বসতি গড়ে তোলে। এভাবেই গ্রামের বসতি গড়ে উঠে। মুসলিম অংশে বসবাসকারী গোষ্ঠীগুলো হলঃ হালদার, শেখ, বিশ্বাস, মোল্যা, দফাদার, গাজী, মোড়ল এবং সরদার গোষ্ঠী। হিন্দু এলাকায় বসবাসকারী গোষ্ঠীগুলো হলঃ গাইন, রায়, মহালদার, বিশ্বাস, সরদার, মল্লিক, রায়, সরকার ও মন্ডল।
মুসলমান পাড়াঃ
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী হাল্দার বংশের (মহাতাব উদ্দিন হালদার) লোকেদের আগমন ঘটে ডুমুরিয়া উপজেলার রানাই গ্রাম থেকে। এই বংশের সিকেন্দার হালদার (সামদার হাল্দার) একজন গাতীদার ছিলেন। তার গাতী ছিল পাইকগাছা উপজেলার লক্ষীখোলায়। পরবর্তীতে তার উত্তর পুরুষরাও এলাকায় যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। শেখ বংশ, (আহম্মাদ শেখ) এর পূর্বপুরুষ কাবিল শেখ দশকাউনিয়ার এরশাদ আলি শেখের বংশ থেকে আসে। শেখ বংশ (রহিম শেখ)পূর্বপুরুষ আসে দশকাউনিয়ার (শেখ রুহুল মাষ্টার) শাখা থেকে। সরদার বংশ (পাচু সরদার) পূর্বপুরুষ ভেরচি থেকে আসে। মোল্লা বংশ(আব্বাস মোল্লা) এরা কোথা থেকে আসে সে সম্পর্কে গ্রামের কেউকিছু বলতে পারে না। বিশ্বাস বংশ (এমান বিশ্বাস) পূর্বপুরুষ মণিরামপুর জেলার মনোহরপুর গ্রাম থেকে আসে। মোল্যা বংশ (ওয়াহেদালী মোল্যা/ফজর মোল্যা) পূর্বপুরুষ আসে ডুমুরিয়া উপজেলার দত্তগাতী গ্রাম থেকে। দফাদার বংশ (ইসলাম দফাদার) পূর্বপুরুষ আসে বুড়ুলিয়া গ্রাম থেকে। গাজী বংশ (ইনজেত গাজী) আসে তালা উপজেলার তেতুলিয়া গ্রাম থেকে। মোড়ল বংশ (দাবাড় মোড়ল) পূর্বপুরুষ আসে মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় গ্রাম থেকে। সরদার বংশ (কাজেম সরদার/কাজেম গুরুর) পূর্বপুরুষ আসে গড়ভাঙ্গা থেকে।
হিন্দু পাড়াঃ
নমঃশুদ্র সম্প্রদায়। নমঃশুদ্র সম্প্রদার আবার দুইভাগে বিভক্ত। (১) শিয়লি নমঃ ও (২) ধানী নমঃ। আমাদের গ্রামে বসবাসকারী নমঃশুদ্ররা সকলেই শিয়লি নমঃ।
ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ও দুই ভাগে বিভক্তঃ (১) পুন্ড্র ক্ষত্রিয় ও (২) কান্তাপুরি ক্ষত্রিয় । আমাদের গ্রামে বসবাসকারী ক্ষত্রিয়রা সকলেই পুন্ড্র ক্ষত্রিয়। একটি তথ্য থেকে জানা যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ গোষ্ঠীগুলোর পূর্বসুরীদের বাসস্থান ছিল খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এদের পদবী বর্তমানে যাই হোক না কেন প্রথম পর্যায়ে প্রায় সকলেরই পদবী ছিল ‘মন্ডল’। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় – গাইন গোষ্ঠী (সুবোল গাইন) পূর্বপুরুষ আসে ডুমুরিয়া উপজেলার লতাবুনিয়া (লষ্কার গাইন) গ্রাম থেকে। মন্ডল গোষ্টী (পঞ্চানন মন্ডল) পূর্বপুরুষ আসে বটিয়াঘাটা উপজেলার পার বটিয়াঘাটা/ জলমা বটিয়াঘাটা অঞ্চল থেকে। বিশ্বাস গোষ্ঠী (বিজয় পন্ডিত/হরিপদ) বিশ্বাস আসে পাতিবুনিয়া থেকে। পাতিবুনিয়ায় এদের পদবী ছিল দফাদার। এদের এক ভাই হৃদয় দফাদার মণিরামপুর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে বসবাস করে। বিশ্বাস গোষ্ঠী (ধীরেন/বলাই) রাড়ুলি-কাঠীপাড়া থেকে আসে। রায় গোষ্ঠী (লোলিত রায়) পূর্বপুরুষ আসে মণিরামপুর উপজেলার সমোসকাটী গ্রাম থেকে। সরদার গোষ্ঠীর (খাদু সরদার) পূর্বপুরুষ আসে মণিরামপুর উপজেলার সাগরা গ্রাম থেকে। মহালদার গোষ্ঠী (দুর্গাচরণ মহাল্দার) পূর্বপুরুষ আসে ডুমুরিয়া উপজেলার ধানীবুনিয়া গ্রাম থেকে। হরিচরণ মহাল্দার সেখানকার একজন বিশিষ্ঠ ব্যক্তি।
মল্লিক গোষ্ঠি (রনজিৎ মল্লিক), বিশ্বাস গোষ্ঠি (সন্তোষ বিশ্বাস) ও মন্ডল গোষ্ঠি (হাজারী মেম্বর) পূর্বপুরুষরা আসে পাইকগাছা উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকা থেকে। রায় গোষ্ঠি (যামিনী রায়) দাকোপ উপজেলার বটবুনিয়া/চালনা এলাকা থেকে। এদের পূর্বপুরুষদের পদবী ছিল মোড়ল। এরা ওই এলাকার হাড়ু মোড়লের বংশধর হিসেবে পরিচিত। অন্য রায় গোষ্ঠী (ডাঃ ননী গোপাল রায়) এরা মণিরামপুর উপজেলার বাটবিলা গ্রাম থেকে আসে। দক্ষিণ পাড়া (খাল কান্দা), (হাজরা/বাসিরাম) এরা আসে বটিয়াঘাটা উপজেলার তিলডাঙ্গা গ্রাম থেকে। সরকার গোষ্ঠি (শিশুবর সরকার) এদের পূর্বপুরুষ আসে সরল পাইকগাছা থেকে। এখানকার নগেন সরকার বিশিষ্ঠ ব্যক্তি। পশ্চিম পাড়ার মন্ডল গোষ্ঠি (জিতেন মন্ডল) এদের পূর্বপুরুষ আসে বটিয়াঘাটা উপজেলার আমতলা এলাকা থেকে।
হিন্দুদের ভিতর তথা নমঃশুদ্রদের মধ্যে বিশ্বাস (রাখাল বিশ্বাস) গোষ্ঠি যথেষ্ট নামকরা ছিল। কথিত আছে- ছিয়ানব্বই এলাকায় কোন গানের দল সৃষ্টি হলে এই গ্রামের রাখাল বিশ্বাসের বাড়িতে এসে প্রথমে গেয়ে যেত। পরবর্তীকালে এই বংশের হরিপদ বিশ্বাস (দলিল লেখক) তার সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলেন। তার সন্তানরা বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরি করছেন।
ষড়ঋতুর রঙ্গশালা এই বাংলাদেশ। কিন্তু শরৎ ও হেমন্ত’র প্রভাব চোখে পড়ে না। বিলের কারণে আমাদের গ্রামে ছয়টি ঋতুর প্রভাব কিছু না কিছু অনুভব করা যেত। ৬০ এর দশকে অপদা নদী শাসনের ফলে বিলে আউশ-আমনের পাশাপাশি গ্রাম লাগোয়া সরিষা-কলাই-মুসুরীসহ রবি ফসল ফলতো। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শুকনা বিলে নদীর পানিতে বিল ২০/২৫ দিন ভিজিয়ে যো (বীজ বপনের উপযোগী) বানিয়ে বিলে আউস ও আমন ধানের বীজ বপন করা হত। গ্রাম লাগোয়া বাদে নিচু জমিতে দো-মুঠো (আউস ও আমন মিশিয়ে) ধানের বীজ বপন করা হতো। শুকনা-ফাঁটা বিলে নদীর পানি দিয়ে ভিজানোর সময় বিভিন্ন জাতের বক, বাটাং, বালিহাঁস, সরাইল প্রভৃতি পাখি বিলে আসতো। বাচ্চা ছেলে থেকে শুরু করে সকল পাখি শিকারিরা শিকারের জন্য ফাঁদ, জাল ও বন্দুক ব্যবহার করতো। বীজ বপণের মাস খানেক পর যাওয়ালী (সবুজ ধানের চারা) দিগন্ত-বিস্তৃত সারা বিলে বাতাসে ঢেউ খেলানো এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি হতো। এ সময় হুগলা বনে প্রচুর বাবুই পাখি থাকতো। রাতে সেই পাখি ধরার জন্য জাল পাততে গিয়ে কেউ কেউ সাপের কামড়ে মারা গেছে। শুকনা বিলে অন্ধকার রাতে আলো জ্বলতে-নিভতে দেখা যেত। লোকে ‘হালের-আলো’ বলতো। সাহিত্যের ভাষায় যাকে ‘আলেয়ার আলো’ বলে।
চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহের পর বৈশাখের শেষার্ধে ধানের চারা যখন মরণাপন্ন, ঠিক তখনই কালবৈশাখী সাথে বর্ষণ শুরু হতো। মৃতপ্রায় ধানের চারাগুলো আবার ধীরে ধীরে সতেজ হয়ে ওঠে। এ সময় কৃষকরা তাদের জমিগুলিতে নিড়ানি দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কারণ অম্বাবচীতে হিন্দুরা মাটি খুঁড়তে হয় এমন কাজ কেউ করে না। তাই অম্বাবচীর পূর্বে সবাই জমি নিড়ানির কাজ শেষ করতো। এ সময় তারা মাছধরে, আত্মীয় বাড়ি বেড়িয়ে, গল্প-গুজব করে অলস সময় কাটাতো। অধিকাংশ শ্রমজীবিরা মাছ ধরার কাজে এসময় ব্যয় করতো। কোন কোন বছর অবিরাম বর্ষণে ধানের চারাগুলো প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন স্লইজ গেটের মাধ্যমে কিছু পানি নদীতে সরিয়ে দিলেই ধানের চারাগুলো আবার জেগে উঠতো। গোড়ায় অল্প পানি থাকায় ধানের চারা দ্রুত বেড়ে ওঠতো। সমস্ত বিলে পানি জমায় বিলের খাল, মাছের অভায়ারণ্য হোগলাবন ও ঝোপঝাড় থেকে মা মাছ বেরিয়ে ডিম ছেড়ে বংশ বিস্তার করতো। নদীতে মেদমাছ (রেনুপোনা) আসলে স্লইজ গেট দিয়ে ২/৩ গোন (জোয়ার) পানি উঠালেই অগনিত রেনু পোনা বিলে ছেয়ে যেত। ২/৩ মাসের মধ্যেই সেই রেনুপোনা খাওয়ার উপযোগি মাছে পরিনত হতো। বিলগুলিতে প্রচুর মাছ জন্মাত।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আউসের ক্ষেতগুলোয় পানি বেড়ে কোমর পর্যন্ত হতো এবং সেই ক্ষেতে কোড়া (পানকৌড়ি) টুব-টুব শব্দ করে ডেকে তার দোসর খোঁজার মধ্য দিয়ে বাসর (বাসা) বাঁধার কাজে বিলকে মাতিয়ে তুলতো। সেই সাথে ধানের জমিতে নিড়ানি বা পরিচর্যার কাজে নিয়জিত কিসানেরা ধূয়া গান গেয়ে বিলে অবস্থানকারী ও নৌকা-ডিঙ্গিতে চলাচলকারীদের মুগ্ধ করতো। তাদের গান গ্রাম থেকেও শোনা যেত। এই সময় বসা (সোলার কাঠীতে, সুতা-বড়শী বেঁধে, টোপ গেঁথে) পেতে বেলে, কৈ, শিং, টাকী, বাইন’সহ নানা রকমের মাছ ধরে কিশোরা-যুবকরা প্রচুর মজা পেত। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ী থেকে খালে-বিলে পাটা দিয়ে মুংলী-চারো-আন্নে (মাছ ধরার উপকরণ) পেতে চামড়ী-চাকা-হরিনা-গলদাসহ হরেক রকম সাদা মাছ ধরা হতো। কোন কোন সময় অসৎ লোকেরা চুরি করে মাছ ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। মাঝে মধ্যে চোর ধরাও পড়তো। গ্রামের ন্যায়-অন্যায় গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে বিচার হতো। গ্রামের মাতুববররা যে সালিশ করতো, গ্রামের সবাই তা মেনে নিত। সে সময় গ্রামে যারা সালিশ-বিচার করতেন, তারা হলেনঃ মহাতাব উদ্দিন হাল্দার, রহমাত আলি মোল্যা, ইসলাম উদ্দিন দফাদার, ইনজেৎ আলি গাজী, কেরামত আলি মোল্যা, ফজর আলি মোল্যা, দাবাড় মোড়ল, জোনাব আলি মোড়ল, নওশের সরদার, আনার আলি সরদার, সুবোল চন্দ্র গাইন, পঞ্চানন মন্ডল, ললিত রায়, দূর্গাচরণ মহাল্দার, রনজিৎ মল্লিক, সন্তোস বিশ্বাস, ভগিরত মোন্ডল, শিশুবর সরকার, বদ্যিনাথ সরকার, হাজারি লাল মন্ডল,ডাঃ ননী গোপাল রায়, পুটিরাম মল্লিক প্রমূখ। গ্রামে সামাজিক শাসন বিদ্যমান ছিল।
গ্রাম লাগোয়া রোপা আমনের জমিতে সারির মাঝ দিয়ে হাতে বোনা কৈয়ে জাল ( কৈ মাছ ধরার জন্য তৈরী) পেতে কৈ-শিং-বাইন মাছ ধরতো। বুচনে পেতেও প্রচুর পুঁটি মাছ পেত। ছোট খালগুলোতে প্রচুর রং-বেরং এর শাপলা ফুটে ভোর বেলায় এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হতো। কেউ কেউ ওই শাপলা তুলে তরকারি হিসেবে রান্না করে খেত। বাচ্চারা শাপলা বনে ঢ্যাপ তুলে খেত। কেউ কেউ শখ করে ঢ্যাপের খঁই ভেজে খেত। কোন কোন সময় সেই খাল দিয়ে নববধুর নায়ের যাওয়ার সময় মেহেদী পরা হাতে শাপলা তোলার দৃশ্য বিলে কর্মরত কিসানদের বিমোহিত করতো। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কর্মহীন দরিদ্র কিসানেরা বিগত পৌষ-মাঘ মাসে সংগ্রহ করা হুগলা-মেলে দিয়ে জুংড়া ও মাদুর বুনে বিক্রি করে অতিকষ্টে অভাবের দিনগুলি অতিবাহিত করতো।
ভাদ্র মাসে আউশ ধানে পাঁক ধরতো। গ্রাম লাগোয়া জমিগুলিতে পাঁকা ধানের দোল খাওয়ার দৃশ্য ছিল অতি মনোরম। কৃষকরা তাদের পাঁকা ধান-বাউই, নাতুল, হাসা, হাসা-কালে, লতাভোগ, কটকতাঁরা নড়োইসহ অন্যান্য জাতের ধান কাটায় ব্যস্ত সময় কাটাতো। এ সময় মাঝে মধ্যে পূর্বে-সারের বৃষ্টি (নিম্ন চাপের সময় অবিরাম ঝরা বৃষ্টি) শুরু হতো। তখন ধান কাটা, মলা (মাড়াইকরা), ধান ও পল (খড়) শুকানোর কাজে কৃষকদের খাটুনি বহুগুনে বেড়ে যেতো। সমস্ত গৃহস্ত বাড়িতে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর থাকতো। কোন কোন বছর এক টানা ২/৩ দিন অবিরাম বৃষ্টিতে মানুষ গৃহবন্ধী হয়ে পড়তো। সে সময় গৃহস্ত বাড়িতে গৃহিনীদের চিড়া-মুড়ি, পিঠা-পুলি তৈরীতে আগ্রহী হতো। ভাদ্র মাসে গুমা (পচনের প্রাথমিক অবস্থা) ধান ও পলের গন্ধ গ্রামের সকল কৃষকের বাড়িতে পাওয়া যেত। এ সময় কর্মহীন দরিদ্র মহিলা-পুরুষরা বট (আউশ ধান কাটার পর সেই ধান গাছ থেকে নতুন কসমি বের হয়ে তাতে হওয়া ধান) খুঁটে সংসার চালাত। বট খোটার পাশাপাশি কেউ কেউ সুযোগ বুঝে ক্ষেতের ধানও চুরি করত। নিবিড় আউশের জমির ধান কাটার পর আমন ধান লাগানের জন্য বাউড়া (আমনের চারা) তুলে লাগাতো। পাশাপাশি বাউড়া বনে গরু ছেড়ে দিয়ে গরুকে খাওয়াত। ভাদ্র মাসে হিন্দু কিশোর-যুবকরা নষ্টচন্দ্র উপলক্ষে গৃহস্ত বাড়ির উৎপাদিত তরি-তরকারি চুরি করে রাতের আধারে প্রতি বাড়িতে বিলাত। আশ্বিনের শেষ দিনে সারান্দীতে শিশু-কিশোরা সন্ধ্যার পর বুড়ির ঘর পুড়াত ও কূলা পিটাতো। বাড়িতে মায়েরা চিতোই পিঠাসহ (কাঁচিপুড়া) বিভিন্ন পিঠা তৈরী ও অতিথিদের খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত সময় কাটাতো। কার্ত্তিকের প্রথম দিনের অতি-প্রত্যুষে ধান সাধ দেওয়ার সাথে সাথে “ আশ্বিন গেল, কার্ত্তিক এলো, মা-লক্ষ্মী গর্ভে এলো, ধান-সাধ খাওরে হৈ” ছড়া কাটার শব্দ গ্রামের অধিবাসীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো।
কার্ত্তিক মাসের শেষাংশ থেকে অগ্রহায়নের প্রথমাংশ পর্যন্ত দরিদ্র কিসানরা কর্মহীন হয়ে পড়তো। এ সময় তারা দারুন অভাবের মুখোমুখি হতো। গরীর মানুষরা খাল-বিলে দোন পেতে (লম্বা ও শক্ত সুতায় ৩/৪ হাত অন্তর বড়শী বেঁধে জীবন্ত তীতপুঁটি (ছাট প্রজাতির পুঁটি) টোপ হিসেবে গেঁথে) শোল-গজাল-রয়না-থুড়ে (কালকেশ) প্রভৃতি মাছ ধরে বিক্রি করে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করার চেষ্টা করতো। কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে দূর-দূরান্তে কাজের সন্ধানে চলে যেত। কাউকে কাউকে সারাদিন অনাহারে থাকতে হতো। এলাকার কিছু সুদখোর মহাজন এ সময় চড়া সুদে ঋণ দিত। দরিদ্র অসহায়রা বাধ্য হতো সেই ঋন গ্রহণ করতে। অভাবের সময় কেউ কেউ ঝরা ঝাড়ার (অ’আজ্জা ধান, এ ধানে পাক ধরলে শিষ থেকে আপনা-আপনি ধান ধরে যায়) পাশাপাশি পরের জমির ধানও সুযোগ বুঝে চুরি করতো। বছরের আষাঢ়-শ্রাবণ ও কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ মাস এই দুই মৌসুম অভাবের সময়। আমাদের জমিতে সর্বপ্রথম ধানে পাঁক ধরতো। কারণ গ্রাম লাগোয়া আমাদের কিছু উঁচু জমি ছিল। যেখানে মৌসুমের প্রথম দিকে ধান লাগানো হতো, ফলে আগে ভাগে ধানে পাঁক ধরতো। গ্রামের দরিদ্র ও অভাবি হিন্দু-মুসলিম নিজেরাই তাদের নিজ উদ্যোগে সেই জমির ধান কেটে, নিজেরাই মাড়াই করে ধার সরুপ সেই ধান তারা অভাবের দিনগুলি পার করার জন্য তারা ভাগাভাগি করে নিত।
অগ্রহায়নের মাঝামাঝি থেকে আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হতো। চলতো পৌষ ও মাঘ মাস পর্যন্ত। বিলে হরেক রকম নামের ধান উৎপাদন হতো। যেমনঃ বীরপালা, পলবিড়ে, আমনচালা, ঘি-পালা, হরিশঙ্কারা, ক্যাশাল প্রভৃতি। ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ার পূর্বেই গৃহস্ত কৃষকরা ৮/৯ জন মিলে গাতা (পালাক্রমে প্রত্যেকের ক্ষেতে সবাই কাজ করা) করতো। ধান কাটার প্রথম দিন গৃহস্ত বাড়িতে নতুন চাল দিয়ে নবান্ন পালনের জন্য পাড়ার শিশুদের গুড়ের ক্ষীরের সিরনী খাওয়ানো হতো। এছাড়া ধান কাটার শেষ দিন অর্থাৎ (পোচ উঠে গেলে) গাতার প্রত্যেককে পর্যায়ক্রমে উৎসবের আমেজে খেতে দেওয়ার প্রচলন ছিল। শীত মৌসুমে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে আগুন পোহানোর জন্য গোয়ালে বা আলাদা করে সাজাল (আগুন পোহানোর জন্য ধানের চিটা বা নাড়ায় আগুন ধরানো) দেওয়ার প্রচলন ছিল। তীব্র শীতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সাজালে আগুন পোহাতো। শিশু-কিশোররা সাজালের আগুনে মৌ- আলু পুড়িয়ে খেত। মলন মলার (ধান মাড়াই) জন্যও গাতা করা হতো। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে মেইকাঠ (মলন মলার জন্য সীমানা কাঠ) পোতা থাকতো। মেইকাঠে দাওয়নী (মাড়াই এর জন্য গরু জুড়ার দড়ি) পরায়ে গরু জুড়ে মলন মলা হতো। অনেক রাত পর্যন্ত মলন মলার কাজ চলতো। প্রত্যেক গৃহস্ত বাড়িতে প্রচুর কাজের সুযোগ হতো। কিসান ও কাজের লোকদের শ্রমের মুজুরিও দ্বিগুন-তিনগুন পেত। এ সময় গ্রামে অভাব লেশ মাত্র থাকতো না। দূরের বিলে ধানকাটার সময় নৌকা-ডিঙ্গিতে করে ধান খাল দিয়ে গ্রাম লাগোয়া ঘাটে এনে জালি করে রেখে, সেখান থেকে আবার মাথায় বা বাঁকে করে উঠান বা খোলেনে নিয়ে পুনরায় পালা করে রাখা হতো। পরে সুবিধা মত সময় মাড়াই করা, পল (খড়) শুকানো, ধানঝাড়া, ধান শুকানো, গোলা বা আউড়িতে (চাটাই দিয়ে ঘিরে অস্থায়ী ধান রাখার ব্যবস্থা) তোলা প্রভৃতি কাজে গৃহস্তরা ব্যস্ত সময় কাটাত।
গরীব বাড়ির শিশু-কিশোর বা মহিলারা ধান কাটার পর সেই জমিতে ধান কুড়াতো। ধান কুড়ানোর সময় তারা ধান ক্ষেতে ইঁদুরের গর্ত পেলে, সেই গর্ত খুঁড়ে অনেক ধান পেতো। খালপাড়ের কিছু কিছু জমিতে ভাটেল, বজ্রমুড়ি, হোগলাপাতা, কৈজুড়ি,পাটনাই প্রভৃতি ধানের চাষ হতো। এই সকল জমিতে শীতকালিন অতিথি পাখি আশ্রয় নিত। পাখি শিকারীরা সেখান থেকে পাখি শিকার করতো। উঁচু জমিতে চিকন রাজশাহী ধানের চাষ হতো। ধান কাটা শেষ হতে না হতে শুরু হতো নাড়া (বিলের বোনা ধান গাছের উপরের ধানসহ অংশ কাটার পর ধান গাছের গোড়ার অংশ) কাটার কাজ। নাড়া ঘরের ছাউনি ও জ্বালানি কাজে ব্যবহৃত হতো। বেশি শীত পড়লে বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই নাড়ার জ্বালিয়ে আগুন পোহাতো। বিলের শুকানো নাড়ার গল্লা (বাঁশের কঞ্চির ছোটা দিয়ে বড় ধরণের আঁটি) নৌকা বা বাঁকে (৪/৫ হাত লম্বা বাঁশের অর্ধাংশ ভারি বোঝা বহনের জন্য তৈরী) করে এনে গ্রাম লাগোয়া ঘাট বরাবর সারি দিয়ে পালা করে রাখা হতো। শিশু-কিশোররা সেই নাড়ার পালায় সকাল-বিকাল-সন্ধ্যায় লুকো-চুরি খেলায় মেতে উঠতো।
এ সময় প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে খেজুরের রস-গুড়ের কাজ থাকতো। টাটকা রসের জন্য ভাড় (রস ও গুড় রাখার পাত্র/ ঠিলে) ধোঁয়া, ভাড় পোড়ানো, গাছির গাছ কাটা, সন্ধ্যা রাতের টাটকা রস পেড়ে পান করা, হরেক রকম পিঠা-পায়েস-গুড়-পাাটালি খাওয়া ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। যে সব বাড়িতে বেশী রস হতো, পাড়ার অনেকেই জিড়েন রস (টাটকা রস) পান করার জন্য সে বাড়িতে আসতো। জিড়েন রস জালুয়ায় (রস জ্বালিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরীর পাত্র)জ্বালিয়ে গুড় তৈরীর শেষে ঝাঁঙ্গি (খেঁজুরের ডাটা কেটে তৈরী) ও ওড়ং(হুরকি) দিয়ে বীচ মারত। জালুয়া থেকে গুড় ঢেলে নিলে পাড়ার শিশুরা তালপাতার চাঁচ দিয়ে জালুয়ার গাঁয়ে লেগে থাকা দানাগুড় তুলে খেত। যে সব বাড়িতে রস-গুড় পরিমাণে বেশি হতো তারা নিজের বাড়ির সারা বছরের প্রয়োজনীয় গুড় রাখা, আত্মীয় বাড়িতে পাঠানোর পরও অতিরিক্ত থাকলে হাট-বাজারে বিক্রি করতো। বিকাল বেলার ওলার (ঘোলা) রস জ্বালিয়ে ঝোলা (পাতলা) গুড় তৈরী করতো।
পৌষ মাসে বিভিন্ন ধরণের মানুষ, বিভিন্ন কারণে গৃহস্ত বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করতো। যেমন- সন্ধ্যা রাতে হিন্দু বাড়িতে সুবরে(ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে পালা গান) দলের গান গেয়ে ধান আদায়ের মৌসুম ছিল পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত। এছাড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান, দায়-বে-দিন বলেও কত জনে ধান সংগ্রহ করতো। তেমনি মুসলিম এলাকায় নওয়াপাড়ার পীর সাহেব তার সাগরেদের নিয়ে দ্বীনি শিক্ষার জন্য সকল বাড়ি থেকে ধান-চাল, ডিম-মুগরী, তরি-তরকারি গ্রহণ করতেন। তার কিছু কিছু সাগরেদ তাবিজ-মাদুলি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতো। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দায়-বে-দিন বলেও ধান সংগ্রহ করতো। পৌষ-মাঘ মাসে ধান কাটা মলা শেষ হলে হিন্দু কমিউনিটিতে কিছু সাংস্কৃতিমনা মানুষ যাত্রাপালার রিহাসহাল শুরু করতো ফকিরের মেলাকে সামনে রেখে।
পৌষ-মাঘ মাসে গ্রাম লাগোয়া তেওড়ে (খেসাড়ি) কলাই ক্ষেতে মা-বোনেরা বিকাল হলে কোরোচ ভরে
কলাই শাক তুলতো নোনা ইলিশ দিয়ে শাক খাওয়ার জন্য। এই সময় গরীবেরা কেউ কেউ
বিলের শালুক তুলে কাদা-মাটিসহ জমা করে রাখতো। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে প্রচণ্ড
অভাবের সময় তারা রান্না করে খেত। সরিষা-কলাই ফসল উঠার পর এড়াকাল (গরু-ছাগল
উন্মুক্ত করা) শুরু হতো। এ সময় গ্রমের ছেলেরা মাঠ অভাবে শুকনা বিলে ফুটবল,
ভলিবল ও দাঁড়িয়া-বান্দা, গোল্লাছুট খেলায় মেতে উঠতো। বিলের ভিতর কূয়ার পাড়
উঁচু করে সেখানে কৃষকরা কেউ কেউ তরি-তরকারীর চাষ করতো।
বিলের জোলা (সরু খাল) দিয়ে পানি নামার পূর্বে খালের মুখে পাটা দিয়ে আন্নে-চারো
পেতে অনেক ছোট-বড় মাছ পাওয়া যেত। গৃহস্ত বাড়িতে সন্ধ্যার পর গৃহিণীরা অন্য
কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত সেই সব মাছ কুটতো। জমি থেকে পানি নেমে
যাওয়ায় বিলের মাছ সব খালে এসে জমা হতো। খালপাড়ের জমির মালিকরা খাল সংলগ্ন
জমিতে শুকনার সময় কুয়া কেটে রাখতো। আশ্বিন-কার্ত্তিক মাসে তারা সেই কুয়াতে
ডাল-পালা দিয়ে মাছের আশ্রয়স্থল তৈরী করতো। মাঘ মাসের শেষ দিকে কুয়ার মুখ
আটকিয়ে জালদিয়ে মাছ ধরা হতো। ধরা মাছ তখন জিয়ানায় ও ডুঙ্গায় (ডিঙ্গিতে)
জিয়িয়ে রাখা হতো। কুয়া থেকে যে সমস্ত মাছ ধরা হতো; তা হলো- রয়না-পুটি,
সরপুঁটি, কৈ, শিং, মাগুর, শোল, গজাল হরেক রকমের প্রচুর মাছ। গ্রামের প্রায়
প্রত্যেক বাড়ির কোন না কোন লোক মাছ ধরায় কাজে নিয়োজিত থাকতো। কেউ কেউ খালের
ভিতর ডুঙ্গায় চড়ে কল (বাঁশের
পাঁকা আগায় লোহার কালা বাঁধা) টেনে পাঁকে থাকা শিং-মাগুর-বাইন মাছ মারতো।
খালের পানি বেশী কমে গেলে কয়েকজন পানিতে নেমে সারিবদ্ধ ভাবে কল টেনে মাছ
ধরতে ধরতে সামনের দিকে এগুতো। চৈত্র মাসে গ্রামের যুবকরা খালে চাবি-পোলো
দিয়ে টাকি, শোল, গজাল, আইড়, রুই, মৃগেল, বোয়াল প্রভৃতি মাছ ধরতো। কেউ বড়
মাছ পেলে দাম ধরে সবাই মিলে ভাগ করে নিত। চৈত্র মাসে উদ্যমী যুবকরা অগভীর
খাল ছ্যাওটের(সেওতি)মাধ্যমে সেচে মাছ ধরতো।
গ্রামে বেশকিছু শিক্ষিত লোক থাকলেও অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮০ জন। তাই কুসংষ্কারে মানুষ ছিল আসটে-পিষ্ঠে বাঁধা। ভূত-প্রেত, জিন-পরী, দৈত্য-দানবে মানুষ বিশ্বাস করতো। বক্কার শেখের স্ত্রী’র ভূতের আছর আছে ভেবে মাঝে মাঝে গুনিন দিয়ে ভূত ছাড়ানোর মহড়া চলতো। ঝাড়-ফুকে মানুষ বিশ্বাস করতো। খালে-বিলে, শ্মশানে-কবরে, বিলের বড় গাছ, ভেড়িবাঁধ প্রভৃতি নিয়ে বিশেষ বিশেষ কিংবদন্তী ছিল। বিশেষ করে মাছধরা নিয়ে লোমহর্ষক গল্প প্রচলিত ছিল। এর পাশাপাশি মানব-মানবীর চিরন্তন ভাললাগা-ভালবাসার রোমাঞ্চ কাহিনীও প্রচলিত আছে। ভালবাসার প্রতি অনুরক্ত হয়ে গরীব প্রেমিক, প্রমিকাকে দেখার শর্তে মজুরি কম নিয়েও প্রেমিকার বাড়ির আশে-পাশে মজুরের কাজ করতো। আবার কোন প্রেমিককে প্রেমিকার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে সমাজের চোখে হেয় হয়ে জেল-জুলুম পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে। কেউ কেউ সফল হয়েছে, আবার কেউ বিফলও হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বিভিন্ন গ্রামে আগুন লাগতে দেখা যেত। কোন কোন সময় সেটা ভয়াবহ রূপে দেখা যেত। পশ্চিম পাড়ার মল্লিক বাড়ির আগুন লাগার দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। বিভিন্ন পালা-পার্বন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে-সাদি, আনন্দানুষ্ঠান, শোকানুষ্ঠান সবাই মিলে গ্রামে পালন করতো। গ্রামের ভিতর দলাদলিও ছিল। ঈদ, মিলাদ, পূজাপার্বন, খানার মেজবান, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, বেগার, যাত্রাপালা, মেলা, সাপখেলা প্রভৃতি অনুষ্ঠান ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদায় যথাযোগ্য ভাবে পালিত হতো।
বর্তমানে গ্রামের পরিবেশ তথা ভৌগলিক পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বিল কেন্দ্রিক যে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ছিল, তার সংগে বর্তমান সময়ের শতকরা ৮০ ভাগ পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্বের পালাপার্বন অনুষ্ঠানাদি এখন আর নেই বললেই চলে। মানুষে মানুষে যে সম্পৃতির বাঁধন ছিল তা অনেকটা আলগা হয়েছে। পূর্বের সেই বিল আর নেই। সমগ্র বিলে এখন ছোট-বড় অনেক মাছের ঘের তৈরী হয়েছে। প্রত্যেক ঘেরে বসত বাড়ির মত টোংঘর তৈরী হয়েছে। মৎস্য ঘেরের ভেড়ীর(বাঁধের) উপর অসংখ্য ফলজ ও বনজ গাছ বিলের অস্তিত্ব বিলিন করে দিয়েছে। কোন ঘের সমবায় ভিত্তিক আবার কোন ঘের লীজ মালিকানা ভিত্তিক। লীজ মালিকরা বিঘা প্রতি একটি টাকা নির্ধারণ করে। কাটা জমি ও সমতল জমি আলাদা ভাবে হারি নির্ধারণ করা হয়। কাটা জমির হারি সমতল জমির প্রায় দ্বিগুন। গ্রামে বসবাসকারী জমির মালিকরা ফসলের পরিবর্তে যে পরিমান অর্থ পায়, তাতে বিনা পরিশ্রমে ফসল না পাওয়ার ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যায়। মাছের ঘের থেকে আয়ই এখন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। বিলে এখন আউশ-আমন, কলাই-মুসুরী উৎপাদিত হয় না। বছরে একটি মাত্র ফসল উৎপাদিত হয়। ইরি-বোরো মৌসুমে সারা বিলে ইরি ফসল লাগানো হয়। এরপরই মাছ ছাড়ার মৌসুম শুরু হয়। ভূমিহীন বা অভাবী মানুষদের প্রায় সারা বছর কর্মসস্থান হয়ে থাকে। সরকারের অবহেলিত এলাকার উন্নয়নের নীতিমালার আলোকে রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। সেই সূত্রে ২০১৭ সালে সরকার বাহাদুরের শুভদৃষ্টির ফলে গ্রামের রাস্তাটি পাঁকাকরণ করা হয়েছে। দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আকাশ সংষ্কৃতির প্রভাবে প্রায় প্রতিবাড়িতে টেলিভিশন এসেছে। সেই সব টেলিভিশনে ডিস লাইনের সংযোগ রয়েছে। সারা দেশে ব্যাপক সংখ্যায় স্কুল-কলেজ তৈরীর প্রেক্ষিতে গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে বি,এ/এম,এ পাশ লোক রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি রয়ে গেছে। দেশে বর্তমানে যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতির সাথে সাথে ভৌগলিক পরিবেশে নষ্ট হয়েছে।
অন্তরে গভীরে ছাপমারা চেনা-ভাললাগা-ভালবাসার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। অন্তরে আঁকা সেই চিরচেনা রূপ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে খান খান হয়েছে। এতদাসত্ত্বেও সৈয়দ মুজতবা আলির প্রবাস বন্ধু প্রবন্ধে তাকে দেখভাল করার জন্য নিযুক্ত পানশিরের আব্দুর রহমানের বর্ণনায় তার দেশের শীতকালের আত্মতৃপ্তির প্রকৃতির বর্ণনার পর লেখকের বিস্ময় ভরা চোখের দিকে চেয়ে আব্দুর রহমানের জন্মভূমির প্রতি যে ভালবাসার সুর ছিল, তার বলার সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই “ ইনহাসতু ওয়াতানাম বা এই আমার জন্মভূমি ”।
[বিঃ দ্রঃ এই প্রবন্ধে যত তথ্য সংযোজিত তা বয়োবৃদ্ধ ও বিশিষ্ঠজনদের কাছ থেকে জানা-শুনা এবং আমার দেখা। তথ্য বিভ্রাটের কারণে কারো মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে বা সঠিক তথ্য থাকলে আমাকে জানালে আমি তা সাদরে গ্রহণ করবো। প্রয়োজনে তা সংশোধন করবো। – লেখক]
মোঃ রুহুল আমিন
অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ
ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ ruhulamin0655@gmail.com
পত্র প্রাপ্তির ঠিকানাঃ
মোঃ রুহুল আমিন (অধ্যক্ষ), গ্রাম- আলতাপোল (অফিস পাড়া), উপজেলা রোড, উপজেলা মসজিদ সংলগ্ন, ডাকঘর- কেশবপুর, জেলা- যশোর।