শরতের মেঘলা সকাল। শেষ রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। শিউলি ফুলগুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ভোর থেকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। আবহাওয়া বার্তায় নিম্নচাপের খবর দিয়েছে। কলেজ ছুটির দিন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বন্ধুকে কেশবপুর হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখে নিচে নেমে এলো প্রিন্সিপাল রুহান। জরুরি বিভাগের বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় পশ্চিম পার্শের একটি বেঞ্চে বোরখা পরা একটি মেয়েকে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে ভালভাবে দেখার চেষ্টা করে এবং সে মেয়েটিকে চিনতে পারে। কথা বলবে, কি বলবে না, হাত বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। এক সময় মেয়েটিকে সে ভালো ভাবেই চিনতো ও জানতো। মেয়েটিও তাকে চিনতো। পাশাপাশি গ্রামেই তাদের বাস। গ্রামের নাম পাঁজিয়া ও সারুটিয়া। দু’গ্রাম মিলেই এক দাড়িয়া বসতি। মেয়েটির পরিবার ও রুহানের পরিবারের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। দুই পরিবারই অর্থ-বিত্তে, মান-মর্যাদায় প্রায়ই সম পর্যায়। উভয় পরিবারই গ্রামের ধানী গৃহস্ত-পরিবার। তা ছাড়া মেয়েটির বাবা ও তার বাবা ছোটবেলা থেকে একই সংগে বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছে। গ্রামে এখন উভয়ই গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
সারুটিয়া গ্রামের পাঁচ বোনের ছোট বোন আইরিন। চেহারা চোখে পড়ার মতো। গাঁয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে সে আলাদা। এমন কি তার নিজের অন্যান্য বোনদের থেকেও সে আলাদা। পাশের গ্রামের মাদ্রাসার সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশুনায়ও বেশ ভাল। মাদ্রাসায় যাতায়াত ছাড়া বাড়ির বাইরে খুব একটা দেখা যায়না। পিতা গ্রামের মসজিদের ইমাম। সকলে তাকে সম্মান করে। সে কারনে বাড়ির অভিভাবকরাও সবকিছুতে খেয়াল রাখে। বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তার পাশে পুকুর, পর্দা করা শানবাঁধান ঘাট। রাস্তার লোকদের গমনাগমণ লক্ষ্য করে মেয়েরা পুকুরে যাতায়াত করে। বাহির বাড়ীর কাজ সাধারণতঃ কাজের লোকেরা করে। বাড়ির মহিলারা ভিতর বাড়িতেই কর্মব্যস্ত থাকে। বিশেষ প্রয়োজনে ছাড়া বাহির বাড়িতে মেয়েরা আসে না। আইরিনের অন্যান্য বোনদের বিয়ে হয়েছে মঙ্গলকোট, রোস্তমপুর ও খাটুয়াডাঙ্গা গ্রামে। সকলের ছোট হওয়ায় বোনরা তাকে খুবই ভালবাসে। বোনের মেয়েদের প্রায় সমবয়সি হওয়ায় আইরিনের সংগে তাদের সম্পর্ক খুবই ভাল। বিশেষকরে বড় বোনের মেয়ে বেবীর সংগে। সম্পর্কে বোনের মেয়ে হলেও বন্ধুর মতো আচারণ করে।
লাগোয়া গ্রাম হওয়ায় যাতায়াতের পথে মাঝে মধ্যে রুহানের সাথে আয়রিনের দেখা হয় বটে; কিন্তু কথা হয় না। এছাড়া রুহানের সমবয়সি ঐ বাড়িতে কোন ছেলে না থাকায় আইরিনদের বাড়িতে যাতায়াতের সুযোগ হয় না। রুহানের মনে দিনে দিনে আইরিনের জন্য ভাললাগা তৈরী হয়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আইরিনকে দেখার জন্য তাদের বাড়ির আশপাশে ঘুরাঘুরি করে। এস এস সি পাশ করার পর রুহান এইচ এস সি পড়ার জন্য কেশবপুর কলেজে ভর্তি হয়। গ্রামের বাড়িতে থেকে কেশবপুর কলেজে সাইকেলে যাতায়াত করে। উঠতি বয়সের ছেলেরা  আসা-যাওয়ার  পথে আইরিনকে দেখে। আইরিনের সুন্দর ও সুকোমল চেহারা রুহানের মনে রেখাপাত করে। দিনে দিনে আইরিনের প্রতি তার দুর্বলতা বাড়ে। প্রথমে পারস্পারিক দেখাদেখি, পরে ভাললাগা থেকে ভালবাসার সৃষ্টি । বিষয়টি ক্রমান্বয়ে উভয় পরিবারের অভিভাবকদের মধ্যে কিছুটা জানাজানি হতে থাকে। কিন্তু কোন পরিবার থেকে কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়না। উভয় পরিবার বিষয়টি সহজ ও স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও রুহানের পক্ষে যখন-তখন আইরিনদের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয় না ; কারন উভয় পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে সে নিজেকে সংযত রাখে।
আইরিনের মা অল্প হলেও লেখাপড়া জানা মানুষ। ওই সময় তার বয়সি মেয়েরা বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা প্রায় শতভাগ ছিল নিরক্ষর। তার চাল-চলন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই ছিল মার্জিত। পড়াশুনার প্রতি তার যথেষ্ঠ আগ্রহ ছিল। গল্প-উপন্যাস পড়া তার শখ। তারই কাছ থেকে গল্পশুনে তার মেয়েরা বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ঠ হয়েছে। আইরিনের বড় দুই বোন উপন্যাস পড়ার প্রতি খুবই আগ্রহী। তাদের সংস্পর্শে এসে আইরিনও মাঝে-মধ্যে দুই এক খানা পড়তো বৈকি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাস তার ভালমত আত্মস্থ। তাদের বই-এর যোগানদাতা ছিল আইরিনের বোনের জামাই মুহিবুল। যে সকল বইয়ের গল্প ওরা করতো সে গুলো হলো লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, দেবদাস, হাসান গঙ্গু বাহামণি, প্রেমের সমাধি, আনোয়ারা, মনোয়ারা প্রভৃতি।
মাঝে মধ্যে রুহানও ওদের কাছ থেকে দুই-একটা বই নিয়ে পড়তো। বই নেওয়ার মূখ্য উদ্দেশ্য বই পড়া নয় ;  উদ্দেশ্য বই লেন-দেনের মধ্যে দিয়ে ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হওয়া এবং আইরিনের কাছাকাছি আসা। খুবই মিশুক মানুষ আইরিনের ভগ্নিপতি মুহিবুল। কেরাম খেলায় পারদর্শী। রুহানদের পাড়ায় কেরাম বোর্ড ছিল। সে শ্বশুর বাড়ীতে বেড়াতে এলেই রুহানদের পাড়ায় আসতেন এবং কেরাম খেলতেন। কেরাম খেলার সূত্র ধরে মহিবুলের সংগে রুহানের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। রুহানও তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। সে ভাবে মুহিবুল একেই তো ভাল মানুষ; তারপর সে আইরিনের ভগ্নিপতি। অল্পদিনে তাদের ভিতর ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আইরিন তার নিকট আত্মীয়দের যাকে যা বলে সম্বোধন করতো, রুহানও ক্রমান্বয় তাদের সংগে সেভাবেই সম্বোধন করতো। সে কারণে আয়রিনের মা-বোনেদের সাথে রুহানের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি হয়।
একদিন মুহিবুল তার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে রুহানদের পাড়ায় কেরাম খেলতে আসেন। খেলতে খেলতে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যায়। রুহান মুহিবুলকে দুপুরে খাওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে আহবান করে। মহিবুল রুহানের কথায় আর একদিন যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। সে আলাদা রুহানকে ডেকে বলে তাকে তার সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। রুহান কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু মহিবুল প্রায় এক প্রকার জোর করে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। রুহানের আপত্তিতে মুহিবুল জানায় তাকে সংগে করে নিয়ে যেতে বলেছে আইরিনের মা। এবার রুহানের মনে লজ্জা-সংকোচ একসাথে ভর করে। তারপরও লজ্জা-সংকোচের গভীরে একটা সুপ্ত ভাললাগা তার মনে কাজ করে।  সে মুহিবুলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার সংগে আইরিনদের বাড়িতে যায়।
আইরিনদের বাড়িতে দু’জন একসাথে খেতে বসে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে দুধ দিয়ে খাওয়ার সময় কুলের আচার এনে দিলে মুহিবুল তেঁতুল দিয়ে খেতে চায়। আইরিনের মা জানায় আচার দেওয়া হয়েছে। তখন আইরিনের মেঝ বোন ঘর থেকেই তার মাকে বলে তার এক জামাই তেঁতুল খাবে আর একজামাই খাবে আচার। প্রকাশ্য দিবালোকে সকলের সামনে রুহানকে জামাই সম্বোধন করায় রুহান লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যায়। কিন্তু ওই সম্বোধন তার ভাল লাগে। এই ঘটনার পর রুহান ও আয়রিনদের বাড়ির প্রায় সকলের কাছে দুই পরিবারের আগামী দিনের সম্পর্কের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কিছুদিন পর মুহিবুলদের বাড়িতে রুহানের বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সময় আইরিন, তার মামাতো বোন তহমিনা, আর এক চাচাতো বোন রোকেয়া একসংগে মুহিবুলদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। সবাই মিলে অনেক আনন্দ-হই-হুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়া ও মজা করে সময় অতিবাহিত করে। মহিবুলের এক মেয়ে রুহানকে খালু সম্বেধন করে। তার কিছুদিন পর একই ভাবে মঙ্গলকোট গিয়ে আইরিনের বোনদের বাড়িতে গিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে সময় অতিবাহিত করেছে এই সকল ঘটনার পর দুই পরিবার এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সকলেই দুই পরিবারের বন্ধন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
এরই মধ্যে রুহান এইচএসসি ভালভাবে পাশ করে যশোরে সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজে বিএ ভর্তি হয়। কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে নগদ অর্থ বের করা কষ্টকর। ৬০ এর দশকে ওয়াপদা নদী শাসনের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার আওতায় সারুটিয়া ও পাঁজিয়া এলাকায় ব্যাপক ফসল ফলে। এ সময় গ্রাম লাগোয়া বিলে কলাই-মুসুরী, মসনে, মিষ্টি কুমড়া, কাকুড়-তরমুজসহ অনেক তরিতরকারি উৎপাদিত হতো। নদীর পানি খাল-বিলে প্রবেশ করতে না পারায় নদীবাহিত পলি নদীবক্ষে পড়ে নদী ভরাট হতে থাকে।  এমনই অবস্থা যখন চলমান তখন হটাৎ করে ১৯৮৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে ২/৩ দিনের অতি বর্ষণে সারা বিলে কচি ধানের চারা পানিতে ডুবে যায়। এলাকার গৃহস্থরা এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারা বরাবরের ন্যায় আসন্ন ভাদ্র মাসে আউশ ধান উঠবে এমন প্রত্যাশায় সংসারের প্রয়োজনীয় ধান রেখে বাড়তি ধান বিক্রি করে দিয়েছে। এই অনাকাঙ্খিত বন্যা ও জলাবদ্ধতায় শুধু আউশই নয়, আগামী আমন মৌসুমেও কৃষকের ঘরে ফসল উঠবেনা। গ্রামের গৃহস্ত কৃষকরা তাই সবাই দিশেহারা। একই অবস্থা আইরিন ও রুহানের পরিবারেও। এই বন্যা ও জলাবদ্ধতা সকল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করে।
রুহান যশোর সরকারী কলেজে ভর্তি হলেও শহরে মেসে বা হোষ্টেলে থেকে পড়াশুনা করা সম্ভব হলো না। তাই বাধ্য শহর থেকে ৩ মাইল দূরে গ্রামে একটা লজিং খুঁজে নেয়। সেখানে ৪ টি ছেলেকে পড়িয়ে নিজের পড়া করতে হয়। এরপরও পড়ার খরচের টাকা রোজগার করার জন্য বিকাল বেলায় দুইটা টিউশনি যোগাড় করতে হয়েছে। মান সম্মাত পোশাক-আশাক যোগাড় করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতি কষ্টে রুহান নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যায়। এই সময় আইরিন দশম শ্রেনীর ছাত্রী। সামনে দাখিল পরীক্ষা। সেও পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী। রুহানের কলেজ বন্ধ থাকলেও টিউশনির জন্য বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। ৩/৪ মাস পর পর ২/৩ দিনের জন্য বাড়ি আসতে পারে। বাড়িতে এসে কখনও আইরিনের সংগে দেখা হয়, কখনও দেখা হয় না। পারিবারিক অনটনের জন্য বন্ধু-বান্ধবদের সংগে যোগাযোগ কমিয়ে দেয় রুহান। আর্থিক সংকট আইরিনের পরিবারেও। গ্রামের সকল কৃষিভিত্তিক পরিবার দারিদ্রের সংগে যুদ্ধ করছে। ইতিমধ্যে প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সামনে রুহানের বিএ পরীক্ষা।
পরীক্ষার আগে বাড়িতে আসে রুহান। বাবা-মা ও আইরিনদের পরীক্ষার কথা জানাবে। বাড়িতে এসেই সে জানতে পারে আইরিনের বিয়ে হয়ে গেছে। খবরটা শেনার সংগে সংগে রুহানের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। শরীরে জ্বর অনুভূত হয়। কথাটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। বার বার ঘুরে-ফিরে একটা কথা তার মনে হয়, তাকে একটি বার কেউ জানাল না কেন? তাদের পরিবারের সবাইতো তার ও আইরিনের কথা কিছু না কিছু জানতো। সবাই বাদ গেলেও মুহিবুল সবই জেনেও কেন চুপ করে থাকলো? আবার কখনও ভাবে, কাউকে- না কাউকে দিয়ে আইরিনও তাকে জানাতে পারতো। রুহান আয়রিনদের বাড়ির আশ-পাশ থেকে যতটুকু জেনেছে, তা কতটুকু সত্য কে জানে! কেউ কেউ বলেছে হুজুর ছেলে, জমি-জমা অনেক, তা ছাড়া মেয়ের বাবা-মার মরণ কালে ও মরণের পরেও তাদের জন্য দোয়া-খায়ের করতে পারবে এমনটি ভেবে এবং জানাজানি করলে বিয়ে ভেঙ্গে যেতে পারে, এই আশংকা থেকেই জানাজানি করেনি। কেউ বলেছে লেখাপড়া জানলেও রুহান একেতো বেকার, তার উপর রুহানের পৈতৃক জমি-জমা পানির নিচে, তাই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তারা রুহানকে না জানিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনেক মনঃকষ্ট নিয়ে দু’দিন পর রুহান বাড়ি থেকে যশোরে ফিরে আসে। বিষন্নতা তাকে ঘিরে থাকে সবসময়।  ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তার ভাবান্তর লক্ষ্য করে কারণ জানতে চাইলে সে কৌশলে এড়িয়ে যায়। দিন-সপ্তাহ-মাস যায়, রুহান আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এক সময় সে নিজেকে বুঝাতে সক্ষম হয়- সত্যিই তো আইরিনকে পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই, সার্টিফিকেট থাকলেও বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ালে পেটের ক্ষুধা মিঠে না। তাই তারা যেটা করেছে, ঠিকই করেছে। তার পরও মনটা মাঝে মাঝে জানতে চায় প্রকৃত ঘটনাটা কি ছিল ? আইরিনের সংগে কাটান স্মৃতিগুলি তাকে সব সময় যেন তাড়িয়ে বেড়ায়।
এক সময় রুহান নিজেকে শক্তকরে। সে ভাবে তার তো আর পিছুটান রইল না। নিজেকে বি,এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে। বি,এ পরীক্ষা ভালভাবে শেষ করে লজিং ছেড়ে বাড়িতে ফিরে আসে। সংসারের দায়িত্ব অনেকটা নিজের কাঁধে তুলে নেয়। ওই সময় ঢাকাতে পশুপালন ও প্রাথমিক চিকিৎসার উপর একটি প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে রুহান ৩ মাসের জন্য ঢাকাতে চলে যায়। যথা সময় বি,এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে ভাল রেজাল্ট হওয়ায় এম,এ পড়ায় আগ্রহী হয়ে খুলনার বিএল কলেজে ভর্তি হয়। পাশাপাশি খুলনার আইন কলেজে ‘ ল ’ ক্লাসেও ভর্তি হয়। এবারও অর্থাভাবে ‘ল’ পড়া স্থগিত রেখে দৌলতপুরের পাশে একটি গ্রামে লজিং থেকে পড়াশুনা করে এম,এ পাশ করে একটি এনজিও তে চাকুরি নিলে সংসারের অর্থকষ্ট অনেকটা লাঘব হয়। পাশাপাশি তার পছন্দের পেশা শিক্ষকতার সুযোগ খুঁজতে থাকে। দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইণ্টারভিউ দিয়ে নির্বাচিত হন ; কিন্তু এখানেও  বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। একটি প্রতিষ্ঠানের (মাদ্রাসা)পরীক্ষায়  প্রথম হওয়া সত্ত্বেও ডোনেশানের জন্য টাকা দাবী করায় সে চাকুরী করা হয় না। অন্য প্রতিষ্ঠানটি (কলেজ) নিয়োগ পত্র দিয়ে পরোক্ষভাবে কিছু অর্থের দাবী করলে দ্বিধা-দ্বন্দে দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে। প্রায় একই সময় বর্তমান কর্মরত প্রতিষ্ঠানটি (কলেজ) শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়। স্বীয় যোগ্যতায় জন্য প্রতিষ্ঠানটি তাকে প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদে নিয়োগ করে। সেই থেকে আজও রুহান তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করে আসছে।
আর্থিক দূরাবস্থা রুহানের আজ আর নেই। অনেক শুভাকাঙ্খী আজ তার হয়েছে। প্রায় সারা দিনই নিজেকে  প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত রাখে। কলেজের উন্নয়ন তার এখন একমাত্র লক্ষ্য। খোদার কৃপায় কলেজই তাকে স্বচ্ছলতা, যশ-সম্মান-মর্যাদা সবই দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সেবায় সে নিজেকে নিবেদিত করেছে। যে আর্থিক দৈন্যতার জন্য কাছের মানুষ দূরে সরে গেছে; তাদের অনেকে আজ তার কাছে ফিরে এসেছে। এত কিছুর পরও অবসর সময় রুহানের মনের গভীরে থাকা, ফেলে আসা দিনের সুখের স্মৃতিগুলি মনের পাতায় ভিড় করে। সুখের সেই স্মৃতিগুলি আজ দুঃখের সুরে অনুরণিত হয়ে উঠে।
যাকে ঘিরে এই সুখ-দুঃখের স্মৃতি সেই মানুষটা এখন তার থেকে মাত্র হাত বিশেক দূরে। সে একবার ভাবলো কিছু না বলেই চলে যাবে, পরক্ষণে ভাবলো আর যদি কখনও দেখা না হয়, কথা না হয়। মনের গভীরে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো তাকে ঠেলে নিয়ে যায় সেই মানবীর দিকে।
মনের অজান্তেই রুহান তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশ তখন ঘন মেঘে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে। আস্তে করে বলে, কেমন আছ ? অনেক আগের পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে আইরিন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রুহানের দিকে। কি যেন ভাবতে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বলে ‘ভাল’। আইরিন রুহানকে হাসপাতালে আসার কারণ জানতে চায়। রুহান তার আহত বন্ধুকে দেখতে আসার কথা জানায়। সেও আয়রিনের নিকট তার আসার কারণ জানতে চাইলে আইরিন জানায় তার এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে এসেছে । আবারও নীরবতা! নীরবতা ভেঙ্গে রুহান জানতে চায় সংগে কে এসেছে ?  আইরিন জানায় তার বোনের ছেলের সংগে এসেছে। সে ঔষধ আনতে বাজারে গেছে। আইরিনের মনে ভেসে উঠে ফেলে আসা দিনের কথা। বাইরে তখন ঝড়ের গতি আরও বেড়েছে। ঝড়-বৃষ্টির সাথে মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।  কত কথা, কত স্মৃতি বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় তার স্মৃতির পাতায় আছড়ে পড়ছে। কিন্তু বাহ্যিক দিকে আইরিনের দৃঢ়তা অবিচল থাকে। তারও যেন কিছু জানার আছে।
 রুহান আস্তে করে বলে, একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করে।
-কি কথা ? বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে থাকে আয়রিন !
তোমার বিয়ের কথা কেউ আমাকে জানাল না কেন ?
এবার আয়রিন আরও কঠিন ভাবে উত্তর দেয়
-‘জানিয়েছিলাম, তুমিই-তো উত্তর দাওনি’।
রুহান অবাক বিস্ময়ে বলে, ‘জানিয়েছিলে ! কিভাবে ?’
আয়রিন দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেয়
– ‘তহমিনার মাকে দিয়ে। সে তোমাকে কিছু বলেনি ?’
রুহান আরও অবাক চোখে বলে ‘না’!
রুহান জানায় সে তার বিয়ের কথা বিয়ের কথা জেনেছিল, বিয়ের পর। আইরিন এবার বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে আছে। তার চোখে-মুখে আগের সেই দৃঢ়তা আর নেই। সে জানে রুহান মিথ্যা বলে না। তার পাঠান সংবাদ রুহানের কাছে পৌঁছায়নি। তহমিনার মা তার কাছে যা বলেছে, তা মিথ্যা।
আয়রিনের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। তার মনের মধ্যেও প্রবল তোলপাড় শুরু হয়। তার এতদিনের ভ্রান্ত ধারণা  মুহুর্তে ধূলোয় মিশে গেল। রুহানকে সে ভুল বুঝেছিল। তাকে এখন সে কি বলবে ? তার এতদিনের অবিচলতা বিগলিত হয়ে ব্যথার মেঘে রুপান্তরিত হলো। মুহুর্তে সে মেঘ শ্রাবণের ধারার ন্যায় তার দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়লো। বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টির মাতামাতি।
রুহান আইরিনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। সে বলে- ‘এটা আমারই দুর্ভাগ্য, যতদিন বেঁচে থাকব, তোমাকে হয়তো ভুলতে পারব না’। কিছুক্ষণ পর আয়রিনও নিজেকে সামলে নিয়ে অপরাধমাখা চোখে রুহানের দিকে চায়।
ঝড়-বৃষ্টিটা কমলেও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরছে। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বড়ায় আইরিন। যাওয়ার আগে কম্পিত ঠোঁটে রুহানের দিকে চেয়ে বলে,
– পারলে আমাকে ভুলে যেও।
আকাশ থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি যেন আইরিনের ব্যথার মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে। কিছুদূর গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকায়, তারপর বোনের ছেলের সংগে হাসপাতালের তোরণ পেরিয়ে যায়। আয়রিনের যাওয়ার পথের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে তাকে রুহান। মনের অজান্তেই কম্পিত স্বরে বলে, তুমি ভুলতে বলছো বটে ; তবুও তোমাকে……….।