অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
‘বাঁওড়’- শব্দের আভিধানিক অর্থ নদীর বাঁক। কোন স্রোতাস্বিনী নদীর স্রোতধারা দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অংশটি মূলস্রোত ধারা থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে ওই অংশকে বাঁওড় বলা হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী গুলির উৎস ভারতে। প্রবাহমান নদী পথ পরিক্রমায় শত-শত মাইল অতিক্রম করে। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন কারণে সকল প্রবাহমান নদীর অংশ বিশেষ অঞ্চল ভিত্তিতে মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁওড়ের জন্ম দেয়। এ কারণেই বাংলাদেশে অসংখ্য বাঁওড়ের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহমান নদীগুলি সারাদেশে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওই সকল নদীবাহিত পলি দ্বারা বাংলাদেশ গঠিত। তাই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ‘ব’ দ্বীপ। নদীবাহিত পলি দ্বারা ভূমি গঠন প্রক্রিয়া শেষ করে নদীর মরে যাওয়াই নদীর ধর্ম। হিমালয়ের সংস্পর্শে নদীগুলি সমগ্র বাংলার ভূমি গঠন প্রক্রিয়ার কাজ অবিরাম করে চলেছে। সমুদ্রের জোয়ার, পলি প্রক্ষেপণ ও ভূমিকম্প নদীর স্রোত-ধারার দিক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংযোগ খালের মাধ্যমে নদীর দিক পরিবর্তন করা যতে পারে। গঙ্গা নদী থেকে ভৈরব ও কপোতাক্ষের জন্ম। ভৈরব ও কপোতক্ষের সংস্পর্শে প্রায় ৩৯ টি ছোট-বড় বাঁওড়ের সৃষ্টি হয়েছে। ‘ঝাঁপার বাঁওড়’ তন্মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ঝাঁপা বাঁওড় থেকে দক্ষিণে মাত্র অর্ধ কিলোমিটার গেলেই অনুরূপ মশ্মিমনগর বাঁওড় চোখে পড়ে। যশোর শহর থেকে ২০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে মনিরামপুর উপজেলা। এখান থেকে প্রায় ১৫ কিঃ মিঃ পশ্চিমে রাজগঞ্জ বাজার ও ঝাঁপা বাঁওড়। মণিরামপুর উপজেলা ০৯ নং ইউনিয়ন ঝাঁপা।
অশ্বখুরাকৃতি ঝাঁপা বাঁওড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ১ কিলোমিটিার। বর্তমানে বাঁওড়ের আয়তন ৬৪০ একর। মূল জলাশয়ের গড় গভীরতা ১৫/১৬ ফুট। ঝাঁপা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিঃ বাঁওড়ে পরিকল্পিত মৎস্য চাষ করে থাকে। বার্ষিক মাছের উৎপাদন প্রায় ১৩০ টন। রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, মিনার কার্প, সিলভার কার্পসহ প্রাকৃতিক ভাবে প্রচুর বিলমাছ এখানে জন্মে। মৎস্যজীবি সমিতির সংগে এলাকার প্রায় ৩০০ মৎস্যজীবি পরিবার সংশ্লিষ্ট এই বাঁওড় থেকে বার্ষিক ৫২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা রাজস্ব হিসাবে সরকারী কোষাগারে জমা হয়। যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বার্ষিক বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বাঁওড়ের উত্তর-পূর্ব পাড়ে রাজগঞ্জ বাজার পড়ে উঠেছে। বাঁওড় সৃষ্টির পূর্বে কপোতাক্ষ নদের এই অংশে দেশ বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। মাড়োয়ারীরা নৌপথে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসত। মাড়োয়ারীরা ভুষিমাল ও তামাকের ব্যবসা করত। মাড়োয়ারীদের মধ্যে লক্ষীচাঁদ ক্যাছড় ও মুরারী ধর ক্যাছড়ের নাম এলাকার অনেকেই মনে করতে পারেন। ১৮০০ সালে এখানে রেজিষ্ট্রী অফিস ও পুলিশ ব্যারাক ছিল।
১৯০০ সালে এখান থেকে রেজিষ্ট্রী অফিস উঠে যায়। ইংরেজ আমলে এই এলাকায় নীল কুঠি ছিল ও নীল চাষ হত। মানিকগঞ্জ ব্রীজ থেকে রাজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত পুরো এলাকাটি ছিল নীল কুঠি ও কুঠিয়ালদের বসবাসের স্থান। ব্যবসায়ী ও কুঠিয়ালদের বসবাসের ফলে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে উঠেছিল বাঈজী বাড়ী। এখানে যে সকল বাঈজী ছিল তাদের নাম গোলাপী, চারুবানু, হাসিরাণী প্রমুখ। গভীর রাত থেকে সারারাত এখানে নাচ-গান হত। আজও গোলাপীর বাড়ীর নাচ মহল ও তোরণ অক্ষত আছে। বর্তমানে গোলাপীর বাড়ীটি ঝাঁপা গ্রামের হাজী আঃ সাত্তার সাহেবের মালিকাধীন।
‘ঝাঁপা’ গ্রামটির প্রায় চারপার্শ্ব ঘিরে রেখেছে ঝাঁপা বাঁওড়। ১৭৪ নং ঝাঁপা মৌজাটি একটা উপ-‘ব’ দ্বীপ। গ্রামটির আয়তন ৩১৫১ একর। লোকসংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ৮,৭৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪,৩২৭ জন এবং নারী ৪,৪৬১ জন। বাঁওড়ের চতুপার্শ্বে গ্রামগুলি হল কমলপুর, হানুয়ার, মশ্মিমনগর, ডুমুরখালি, লক্ষ্মীকাপুর, মল্লিকপুর, রামপুর ও মোবারকপুর। এই গ্রামগুলির মধ্যে হানুয়ার একটি শিক্ষিত জনপদ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মশ্মিমনগর গ্রামের সুসন্তান নজরুল ইসলাম খাঁন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূখ্য সচিব। উল্লেখিত গ্রাম গুলিতে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের বাস। এই জনপদের প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাঁওড়ের সংগে সম্পৃক্ত। দৈনন্দিন প্রয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি মৎস্য, জলবায়ুতে বাঁওড়-এর সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাঁওড়ের পশ্চিম উত্তর কোণে ঝাঁপা বাজার যার পূর্বেকার নাম ছিল ফৈতিয়ার হাট। গ্রামের নামকরণ ঝাঁপা নিয়েও রয়েছে কয়েকটি জনশ্রুতি। এগুলো হলঃ
১) ঝাঁপা গ্রামের রায় বংশীয়রা এই গ্রামের প্রথম বসত স্থাপনকারী। তাদের পূর্ব পুরুষ বাঁসিরাম রায় (?) তিনি নদী পথে খড়ের গাঁদা ধরে (অজ্ঞাত) কোন এক এলাকা থেকে ভেসে এসে কপোতাক্ষ নদী ঝাঁপিয়ে জংগলাকীর্ণ ভূ-খন্ডে উঠেছিলেন বলে ঐ ভূ-খন্ডের নাম ঝাঁপা।
২) কপোতাক্ষের এই ঘুরপথ অংশের বহিরভাগে উপরোল্লেখিত গ্রামের লোকজনকে নদীর মধ্যভাগে ভূ-খন্ডে পৌঁছানোর জন্য ঝাঁপিয়ে নদী পার হতে হত। সে কারণে ঐ ভূ-খন্ডের নাম ঝাঁপা।
৩) বর্তমান ঝাঁপায় বসবাসকারী রায় বংশের পূর্ব পুরুষ ঝাঁপায় প্রথম বসতিস্থাপনকারী বাঁসিরাম রায় (?) তাদের জমিদারী অঞ্চলে কোন অজ্ঞাত কারণে ইংরেজদের বিরাগভাজন হন। সে জন্য তাকে ইংরেজরা বন্দী করে নৌযানে কপোতাক্ষ নদ দিয়ে কাসিমবাজার কুঠিতে নিয়ে যাচ্ছিল। বন্দী অবস্থায় সুযোগ বুঝে রাতের আঁধারে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে একটি খড়ের গাদা ধরে ভূ-ভাগে পৌছায়। জংগলাকীর্ণ এই ভূ-ভাগে কিছুদিন আত্মগোপন করে থেকে নিজ এলাকার মানুষের সংগে যোগাযোগ স্থাপন করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিয়ে গ্রাম গড়ে তোলেন। তার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে ঐ ভূ-খন্ডের নাম হয় ঝাঁপা।
৪) বখতিয়ার খলতির বঙ্গ বিজয়ের পর সিন্ধু অঞ্চল থেকে হাজ্জাজ-বিন ইউসুফের বংশধর কতিপয় অনুচরসহ নদী ঝাঁপিয়ে ঐ স্থলভাগে ওঠেছিল বলে এ ভূ-খন্ডের নাম ঝাঁপা হয়। স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় রেখে উল্লেখিত জনশ্রুতিগুলি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
১) প্রথম জনশ্রুতিটির বর্ণনাকারী ঝাঁপার রায় বংশের সুনিল কুমার রায়ের। তিনি তার পূর্ব পুরুষ ঝাঁপার প্রথম জনবসতি স্থাপনকারী কোথা থেকে এসেছিলেন তা বলতে পারেননি। পাশাপাশি কি কারণে খড়ের গাদা ধরে খরস্রোত কপোতাক্ষে ভেসে এসেছিলেন এবং ঝাঁপিয়ে ঐ ভূ-খন্ডে উঠেছিলেন ও একাকী তার পক্ষে জনবসতি গড়ে তোলা কতটুকু বাস্তবতা নির্ভর। এসব প্রশ্নের সদুত্তরে সুনীল রায় কিছুই বলতে পারেননি।
২) দ্বিতীয় জনশ্রুতিটি বর্ণনাকারী মল্লিকপুর গ্রামের বাঁওড়ের উত্তর পাড়ে বসবাসকারী এলাকার সচেতন ব্যক্তি ও পোষ্ট মাষ্টার ওমর আলীর (৭০)। তার মতে বাঁওড়ের বহির্ভাগের গ্রামের মানুষের নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খন্ডে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নদী ঝাঁপিয়ে পার হয়ে যেত এ কথাটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? সদূর অতীত থেকে মানুষ জলপথে চলাচলের জন্য সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি ভেলা ব্যবহার করত। নদী অঞ্চলের সকল মানুষের কাছে বিষয়টি অজানা নয়।
৩) তৃতীয় জনশ্রুতিটি বর্ণনাকারী হানুয়ার গ্রামের বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার আঃ সামাদ সাহেব তার এই বক্তব্য কিছুটা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়। সে সময় জমিদার বা প্রজাদের কেউ শাসকের বিরোধিতা করলে তাকে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে কঠিন সাজা দেওয়া হত এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য মুঘলদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করায় তাকে বন্দী করে আগ্রায় নেওয়ার পথে বারানসিতে তার মৃত্যু হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কোন শাসকের অধিভুক্ত অঞ্চলে কোন বিদ্রোহী বন্দী হলে তাকে বিচারের সম্মুখীন করার পূর্বেই তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হত। আর যদি বিচারের সম্মুখীন করাও হত তবে সে বিচার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রহসনের বিচারে পরিণত করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হত। সংগত কারণে বলা যেতে পারে উল্লেখিত বন্দী এমনটিই আশঙ্কা করে বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে নদীতে তার ঝাঁপ দিয়ে পড়া মোটেও অযৌক্তিক নয়। পরে সুযোগ বুঝে এলাকার মানুষের সংগে যোগাযোগ করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিয়ে গ্রাম গড়ে তোলাও সম্ভব।
৪) চতুর্থ বক্তব্যটি ঝাঁপা এলাকার মোবারকপুর গ্রামের বিশিষ্ট লেখক ও ঔপন্যাসিক আহুজা’র দেওয়া এই তথ্যাটি তিনি তার কপোতাক্ষী উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন ও কয়েক বছর পূর্বে একটি জাতীয় দৈনিকের রবিবার সংখ্যায় ‘ঐতিহাসিক ঝাঁপা’ শিরোনামে ছাপানো হয়েছে। উপন্যাসে বর্ণিত বক্তব্যে কারো কিছু বলার থাকতে পারেনা। ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের প্রয়োজনে তথা পাঠকের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য কাল্পনিক অনেক কাহিনীর অবতারণা করতে পারেন। লেখকের এ স্বাধীনতা আছে। এখানে ঐতিহাসিক সত্য রক্ষায় লেখকের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তবে ‘ঐতিহাসিক ঝাঁপা’ শিরোনামে লেখাটিতে ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষার দায়িত্ব লেখকের রয়েছে বলে আমি মনে করি। লেখক ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু রক্ষা করেছেন সেটা জানার প্রয়োজনে কিছুটা সময়ের জন্য আমাদের ইতিহাসের পাতায় ফিরে যেতে হবে।
নবম হিজরীতে হযরত মুহম্মদ (সঃ) বিদায় হজ্বের ভাষণে তার লক্ষ-লক্ষ সাহাবীর উদ্দেশ্যে ইসলামের মহানবাণী যারা শুনতে ও জানতে পারেনি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। দশম হিজরীতে তাঁর তিরোধানের পর লক্ষ লক্ষ সাহাবী পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের মহানবাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করে। এই কর্মযজ্ঞে এসে কেউ আর তার নিজ গৃহে ফিরে যায়নি। তারা যেখানেই গেছে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও সফলতা না আসা পর্যন্ত প্রচার কার্য চালিয়েছেন। তাদের কর্মকাণ্ড চলমান অবস্থায় কারো মৃত্যু হলে তার অনুসারীরা সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। সে কারণে তাদের প্রচারের স্থানটিতে একটি ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে উঠেছে। তৈরী হয়েছে মসজিদ, হুজরা, মাজার, দরগা, খানকা, প্রভৃতি স্থাপনা বংশ পরস্পরা তাদের সেই কর্মকাণ্ডের সংগে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে অলৌকিক, কেরামতি বা কিংবদন্ত। যা এখনও বিভিন্ন এলাকার লোকের মুখে মুখে ফিরছে।
হযরত মুহম্মদ (সঃ) মৃত্যুর পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) সময় ইসলামের বিজয় রথ দুর্বার গতিতে চলতে থাকে। ইসলামের শাসনাধীনে আসে দুর্দমনীয় পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য। মুসলমানদের পারস্য অভিযানের সময় সিন্ধুরাজ দাহির আরবদের বিরুদ্ধে সৈন্য দিয়ে পারস্যকে সাহায্য করেছিল। সংগত কারণে সিন্ধুরাজ আরবদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। ৬৪০ খৃষ্টাব্দে খলিফা ওমর (রাঃ) এর মৃত্যু হলে বিজয় অভিযান স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের সময় মুসলিম খিলাফত আবার শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ সময় আরব সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় (ইরাকের) শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ-বিন- ইউসুফ। তিনি সুদক্ষ বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ৭১১ খৃষ্টাব্দে আরব বাণিজ্য জাহাজ সিংহল থেকে সিন্ধুর দেবল বন্দরে পৌঁছালে জলদস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। জাহাজে সিংহলে অবস্থানকারী মৃত আরব বণিকদের স্ত্রী ও এতিম সন্তানরা ছিল। এ সংবাদ হাজ্জাজের নিকট পৌঁছালে হাজ্জাজ সিন্ধুরাজ দাহিরকে একটি চরম পত্র পাঠান। ঐ পত্রে হাজ্জাজ অবিলম্বে লুণ্ঠিত জাহাজের ক্ষতিপূরণ ও জলদস্যুদের শাস্তি দানের দাবী জানান। সিন্ধুরাজ তার দাবী পূরণে অক্ষমতার কথা জানালে হাজ্জাজ খলিফার অনুমতিক্রমে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ-বিন কাসিমকে ৭২১ খৃষ্টাব্দে সিন্ধু অভিযানে পাঠান। মুহম্মদ বিন কাসিম প্রথমে সিন্ধুর দেবল অধিকার করেন। পরে সুলতান ও আলোর বিজিত হলে সিন্ধু অঞ্চল আরব সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কিন্তু এই বিজয় সিন্ধু অঞ্চলে আরবদের ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ খলিফা ওয়ালিদ ৭১৫ খৃষ্টাব্দে মারা গেল তার ভাই সোলাইমান খলিফা হন। সোলাইমানের বিদ্বেষবশতঃ মুহম্মদ-বিন-কাসিম বন্দী হন ও মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সিন্ধু অঞ্চলে আরব প্রাধান্য বিলুপ্ত হতে থাকে। এই প্রতিকুল প্ররিবেশে বিচক্ষণ ও দূর্দান্ত প্রভাবশালী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের বংশধর সিন্ধুতে এসে বসবাস করা কতটুকু যৌক্তিকতা থাকতে পারে।
উল্লেখিত ঘটনার প্রায় ৫ শত বছর পর ১২০১ খৃষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি অতর্কিতে নদীয়া আক্রমণ করলে নদীবাসে অবস্থানকারী লক্ষণসেন পূর্ববঙ্গে পালিয়ে আসেন। তখন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। লক্ষণ সেনের জ্যেষ্ঠপুত্র মাধব সেন গৌড়ে শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন। লক্ষণ সেনের অপর দুই পুত্র কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন তখনও পূর্ববংগের বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করছিলেন। সে সময় যশোর-খুলনা অঞ্চলটি কেশব সেনের প্রাদেশিক রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল। অন্য এক বর্ণনায় দেখা যায় খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজি সেন রাজাদের নিকট থেকে গৌঢ় ও রাঢ় জয় করেন। তখন যশোর জেলাটি প্রাচীন সমতট জনপদের অংশ ছিল। অর্থাৎ যশোর জেলাটি বখতিয়ারের বিজিত অঞ্চলের ভিতর ছিল না।
এই সময় সিন্ধু অঞ্চল থেকে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের বংশধর ফকির ত্বকী নামক আউলিয়ার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ঘুরে অনুচরসহ ঝাঁপিয়ে কপোতাক্ষ নদী পার হয়ে এখানে এসে আস্তানা গাড়া সম্পর্কিত তথ্য কোন ইতিহাস গ্রন্থ বা বই পুস্তক থেকে সমর্থিত হয়নি। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আগত ইসলাম প্রচারকদের নামের তালিকায়ও এই নামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই নামের কোন ব্যক্তি ঝাঁপা অঞ্চলের জনপদে ইসলাম প্রচার করেছেন এমনও শোনা যায় না। কথিত দরবেশের আস্তানার আশে-পাশে মসজিদ, দরগা, মাজার, খানকা এমন কোন স্থাপনারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। শাসক শ্রেণীর সম্পৃক্ততায় যারা ইসলাম প্রচার করেছেন, তাদের নামের সংগে ‘শাহ’ ‘খান’ বা ‘খাঁ’ উপাধি জড়িয়ে আছে। যেমন সাইদ শাহ, শাহ কারারিয়া ফতে খাঁ, শাহ জালাল, খাকি শাহ। ফকির উপাধি তাদের ভিতর দেখা যায় না। তবে ঝাঁপার হাটের পূর্ব নাম ‘ফৈতিয়ার হাটকে কেন্দ্র করে হাজ্জাজ বংশীয় দরবেশের কথা যারা বলেছেন, তারা এ কাজটি করেছেন তাদের গল্পকে পাঠকের কাছে চটকদার করার মানুষিকতা নিয়ে। এটা একটা কল্পকাহিনী মাত্র। বিষয়টি সম্পর্কে এ কাহিনীর লেখকের (আহুজা) নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান তার স্কুল জীবনে একটি লিফলেট থেকে এ তথ্যটি তিনি পেয়েছেন। তিনি আরও জানান লিফলেটটি তার কাছে নেই, সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। বিষয়টি বিচার ও বিশ্লেষণের ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।
আমার মনে হয় এখনও গ্রামে-গঞ্জে, হাটে- বাজারে মাঝে মধ্যে কিছু অজানা- অচেনা অপ্রকৃতিস্থ লোক দেখতে পাওয়া যায়। এদের অধিকাংশ বিকৃত সুফি মতাদর্শের মানুষ। তাদের মত এ নামের কেউ কিছুদিনের জন্য ঝাঁপায় অবস্থান করতে পারেন। সে কারণে ‘ফকির তকীর হাট’ সংক্ষেপে ফৈতিয়ার হাট’ হতে পারে। তবে এ বিষয়টিও বিশ্লেষণের দাবী রাখে।
গালিব হরমুজ তার ‘ঐতিহাসিক যশোর’ গ্রন্থে ঝাঁপা বাঁওড় সম্পর্কে একটি জনশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। জলশ্রতিটি নিম্নরূপঃ
‘অনেকদিন আগে জনমানবহীন এলাকা অর্থাৎ বাঁওড়ের তীরে ছিল কোন এক গোয়ালার বাড়ি। তার ছিল অনেকগুলো গরু। ওইসব গরুর দুধ দোহন করে রেখে দিত বড় ধরণের পাত্রে বা চৌবাচ্চায়। পরবর্তীতে কোন লোক এসে দুধ চাইলে ওখান থেকে বালতিতে তুলে দুধ বিতরণ করত। সেদিন এক ব্যক্তি দুধ চাইলে তাকে দেয়নি। না দেবার কোন কারণ ছিল। লোকটার গতিবিধি সন্দেহ বিবেচনার দুধ না দিয়ে বঞ্চিত করে।
দুধ না পেয়ে ফকির ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গোয়ালার গরুগুলো ঝাঁপ দেয় বাঁওড়ের অথৈ পানিতে। এরপর আর কোন দিন গরুগুলো উঠে আসেনি। কয়েকদিন পরে গোয়ালাও অদৃশ্য হয়। লোকেরা অনেক অনুসন্ধান করে পারেনি তার হদিস বের করতে। তখন থেকে বাঁওড়ের নামকরণ হয় ঝাঁপা। যুগ-যুগ অতিক্রান্ত হলেও নামের কোন পরিবর্তন হয়নি। উল্লেখিত এই জনশ্রুতিটি শ্রেষ্ঠ কল্পকাহিনী আরব্য রজনীকে হার মানিয়েছে। তাই এর আলোচনা আবশ্যকতা মনে করি না।
একটি অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা যায় ঝাঁপার বাঁওড় সৃষ্টিতে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংশ্লিষ্টতা আছে। সূত্রটি জানায় ঐ বাঁওড় তৈরীতে ইংরেজদের তথা কুটিয়ালদের হাত রয়েছে। ঝিকরগাছা কনসার্ন এর যাবতীয় যোগাযোগের মাধ্যম ছিল কপোতাক্ষ নদ। এই নদের ঘুর পথের অংশটি প্রায় ১২ কিলোমিটার। এই ঘুরপথটি অতিক্রম করতে ইংরেজদের জোয়ার বা ভাঁটার প্রায় অর্ধেক সময় চলে যেত। তারা নৌপথ সংক্ষিপ্ত করে সময় বাঁচানোর জন্য সংযোগ খালের মাধ্যমে নদীর গতি পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করে। কপোতাক্ষের খরস্রোত তাদের এ কাজে উৎসাহিত করে। নদীর গতি পরিবর্তনের জন্য তারা বর্তমান ঝাঁপার হাটের (ফৈতিয়ার হাট) পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে ৮০০/৯০০ ফুট কেটে দিয়ে নদীর সংগে সংযোগ দেয়। ফলে কপোতাক্ষের মূল স্রোত খাড়াভাবে ভাটিতে মূলনদীর সংগে মিলিত হয়। ধীরে ধীরে বাঁকের জোয়ার ও ভাটার উৎস মুখে পলি জমে পুরো বাঁকটি বাঁওড়ে পরিণত হয়।
পারিপার্শ্বিক বিচারে ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে মনে হয় ঝাঁপা গ্রামের বসতি স্থাপনকারী বাঁসিরাম রায় চাঁচড়ার জমিদার রায়ের বংশীয় মনোহর রায়ের অধস্তান পুরুষ। সম্ভবতঃ কুঠিয়ালদের সংগে বিরোধে জড়িয়ে পড়া তার বন্দীত্বের কারণ। কথিত আছে ঝাঁপার রায়েরা বলত,“ ঝাঁপা বাঁওড়ের পানি শুকিয়ে যেতে পারে; কিন্তু রায়দের টাকা ফুরাবে না।” এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পাঠান শাসক দাউদ খাঁর সংগে মুঘল বিরোধের কথা। দাউদ ছিলেন গৌড় অধিপতি ও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। তার রাজসভার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যশোর চাঁচড়ার জমিদার শ্রীহরি ওরফে বিক্রমাদিত্য এবং খাজাঞ্চি খানার দায়িত্বে ছিলেন জানকী বল্ভব ওরফে বসন্ত রায়। দুই ভাই দাউদের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তারা দুই ভাই দাউদ খাঁর কাছ থেকে যশোর অঞ্চল ও চাঁদনি চকের জমিদারী প্রাপ্ত হন। দাউদ খাঁ মুঘলদের সংগে যুদ্ধে পরাজিত হলে তার সমস্ত ধন-রত্ন, টাকা পয়সা বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়ের হস্তগত হয় এবং তারা এ সম্পদ যশোরে নিয়ে আসে। সে কারণে উল্লেখিত বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। তাছাড়া ঝাঁপা অঞ্চলটি তখন যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অপর একটি সূত্র জানায় ঝাঁপায় বর্তমান বসবাসকারী সুব্রত কুমার রায় পিতা সুনিল কুমার রায় ঝাঁপার প্রথম বসতি স্থাপনকারী রায় বংশীয় নয়। তারা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। প্রথম বসতি স্থাপনকারী কথিত বাঁসিরাম রায় এদের অর্থাৎ সুনীল রায় গং এনে বসতি দিয়েছিলেন। অপর একটি সূত্র জানায় ঐ রায়েরা অর্থাৎ সুনীল রায় মূল গাতীদারের সরাসরি বংশীয় নয়। এরা গাতীদারের জ্ঞাতী গোষ্ঠী। গাতীদারদের শেষ গাতীদারের নাম হাজারীলাল রায়। তার পুত্র পঞ্চানন রায় যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার মাদারডাঙ্গা (পাঁজিয়া) গ্রামে বসবাস করে। উনিই এই বংশের শেষতম পুরুষ। ইতিমধ্যে তিনিও মারা গেছেন। বর্তমানে তার দুই পুত্র পাঁজিয়া গ্রামে বসবাস করেন। একজন আনন্দ রায় ও অন্যজন গোপাল রায়। আনন্দ রায় পাঁজিয়া রূপালী ব্যাংকে কর্মরত।
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে পূর্ব থেকেই ঝাঁপা অঞ্চলের জনগণের উপর প্রশাসনিক প্রভাব কিছুটা শিথিল। সে জন্য যে বা যারা নিজেদেরকে প্রশাসন থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতেন তারা ঐ অঞ্চলে অবস্থান করতেন। এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষরা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতেন। এ কারণেই রায় বংশের সর্বকনিষ্ঠ বংশধর পঞ্চানন রায় ঝাঁপা ছেড়ে কেশবপুর উপজেলার মাদারডাঙ্গা (পাঁজিয়া) এসে বসবাস করতেন বলে পঞ্চাননের সদ্যবিধবা স্ত্রী আরতি রায় জানান। একই কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপা জনপদের গুরুত্ব ছিল অনেক। ঝাঁপা এলাকার হানুয়ার গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধ আব্দুস সামাদ জানান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলটি প্রায় মুক্ত অঞ্চল ছিল। ওই সময় এই এলাকাটি যুদ্ধকালীন যোগাযোগ ও সরবরাহ লাইনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন রাজগঞ্জ হাই স্কুলে রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এক যুদ্ধে মুক্তিসেনারা ক্যাম্পটি দখল করে নেয় এবং রাজাকারদের হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে বেশকিছু যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধগুলোর ভেতর ডুমুরখালীর যুদ্ধটি ছিল বড় যুদ্ধ। যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং কয়েকজন খান সেনা আহত হলে খান সেনারা পালিয়ে ঝিকরগাছায় চলে যায়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলায় বার ভূঁইয়ারা শাসনকার্য পরিচালনা করত। তারা দিল্লীর মৌখিক আনুগত্য স্বীকার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করত। বার ভূঁইয়াদের অন্যতম যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য। তিনি প্রথমে মুঘলদের আনুগত্য দেখালেও পরবর্তীতে বিদ্রোহের ঝান্ডা তোলেন। মুঘল সেনাপতি এনায়েত খাঁর সংগে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী অবস্থায় আগ্রায় নেওয়ার পথে বারানসিতে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু হয়।
এনায়েত খাঁর সংগে যুদ্ধের পূর্বে প্রতাপাদিত্য তার খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায় এবং তার সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেন। এ সময় বসন্ত রায়ের পুত্র রাঘব রায় কচুবনে আত্মগোপন করে প্রাণ রক্ষা করেন। এ জন্য রাঘব রায় কচু রায় নামে পরিচিত হয়। প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর পর কচু রায় মানসিংহের অনুগ্রহে যশোরের রাজত্ব লাভ করেন। ভূষণার রাজা সীতারাম নিজেকে স্বাধীন রাজা ঘোষণা করলে মুঘল বাহিনী তাকেও পরাজিত করে। এ সময় চাঁচড়ার রাজা ‘মোহন রায়’ যশোর রাজ্যের অধিকাংশ পরগণার জমিদারী প্রাপ্ত হন।
সম্রাট শাহজানের সময় ফৌজদার মীর্জা সফসিকান যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হন। তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে সুন্দরবন অঞ্চল ছেড়ে ত্রিমোহিনীতে বসবাস করেন এবং এখান থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ইংরেজ রাজত্বের সময় ইংরেজরা রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে কলিকাতায় স্থানান্তরিত করে যশোরকে প্রথম জেলা ঘোষণা করেন। জেলার শাসককে ম্যাজিষ্ট্রেট বলা হত। ১৭৮৪ সালে যশোরর ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্ট বা অফিসকে বলা হত মুরলীর কাছারী। যশোরে প্রথম যিনি জজ বা ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হয়ে আসেন তার নাম হেংকল।
১৭৯৫ সালে রূপদিয়ায় কুঠিয়াল বন্ড সাহেব প্রথম নীলকুঠি নির্মাণ করেন। যশোর ও নদীয়ায় উৎপাদিত নীল ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। ইউরোপের বাজারে এই নীলের যথেষ্ট কদর থাকায় দলে-দলে ইংল্যান্ড থেকে যুবকরা এসে নীল চাষে যুক্ত হয়। কুঠিয়ালদের এই বিস্তৃত ব্যবসার নাম ছিল Concern (কনসার্ন)। নীল চাষকে কেন্দ্র করে কুঠিয়ালদের ভিতর পারস্পরিক সৌহার্দতা ছিল না। যশোরের দক্ষিণাঞ্চলে দুইটি কনসার্স ছিল। একটি রূপদিয়া কনসার্ন। এখানকার কুঠিয়াল সাহেবের নাম ‘বন্ড’। দ্বিতীয়টি ঝিকরগাছা কনসার্ন; এখানকার কুঠিয়াল সাহেবের নাম জিংকার। নীল চাষকে কেন্দ্র করে ‘বন্ড’ ও জিংকার সাহেবের ভিতর বিরোধ ছিল। তখন যশোরের কালেক্টর ছিলেন টমাস পোনি। (Tomas Powney) টমাস পোনি কুঠিয়ালদের বিরোধ এড়ানোর জন্য কলিকাতার গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোকে এক কুঠিয়ালদের কুঠি থেকে অন্য কুঠিয়ালদের কুঠির দূরত্ব ১০ মাইলের অধিক করার জন্য আইন পাশের সুপারিশ করেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ঝিকরগাছা কনসার্ন এর অধীনে যে সমস্ত নীল কুঠির পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে ঝিকরগাছা, পায়রাডাঙ্গা, পলুয়া-মামুদপুর, মদনপুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা যায় রাজগঞ্জ কুঠি ঝিকরগাছা কনসার্ন এর অধীন ছিল। ঝিকরগাছা কনসার্ন এর প্রথম কুটিয়াল জিংকার পরে রবার্ট মেকেঞ্জি কনসার্ন এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। নীল বিদ্রোহের সময় যশোরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যশোরে প্রথম নীল বিদ্রোহ শুরু হয় চৌগাছা থেকে।
পরিশেষে বলতে চাই নিজ জ্ঞানের স্বল্পতা, সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদের বেঁধে দেওয়া সময়, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, যোগাযোগের ক্রটিসহ বিভিন্ন কারণে লেখাটি আশানুরূপ সমৃদ্ধ হয়নি। আশা করি আগামী দিনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য যারা কাজ করবেন, আমরা সংগৃহীত তথ্য থেকে তথা লেখা থেকে তারা যদি সামান্যতম সহযোগিতা পান, তবেই আমি আমার শ্রমকে সার্থক মনে করব।
তথ্য সংগ্রহঃ
ক) যশোর খুলনার ইতিহাস- সতীশ চন্দ্র মিত্র
খ) যশোরের ইতিহাস- আসাদুজ্জামান আসাদ
গ) ঐতিহাসিক যশোর- গালিব হরমুজ
ঘ) বাংলার ইতিহাস- কে, আলী
ঙ) তাযকেরাতুল আওলিয়া- শেখ ফরীদ উদ্দীন আক্তার (রঃ) ১ম ও ২য় খন্ডঃ
চ) ইসলামের ইতিহাস- হাসান আলী চৌধুরী
ছ) ভারতের ইতিহাস- অতুল চন্দ্র রায়, ১ম খন্ড
জ) ঝাঁপা এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার