অধ্যক্ষ রুহুল আমিন
১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার চুকনগরের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরোচিত গণহত্যার অন্যতম। প্রথমে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে আত্মার শান্তিকামনা করছি সেই সকল শহীদদের যারা সেদিন বর্বর হত্যাকারীর নির্মম বুলেটে আত্মাহুতি দিয়েছিল। গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি সেই সকল মা-বোন ও পরিবারের প্রতি যারা তাদের শরীরে জখমের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন ও একান্ত আপনজনদের কথা স্মরণ করে আজও অশ্রুবিসর্জন করেন। শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করছি তাদের যারা বিগত বিয়াল্লিশ বছর ধরে সেই ভয়াল দিনটা স্মরণ করে কথায় ও কলমে তাদের কথা তুলে ধরেছেন। শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করতে চাই তাদের, যারা আগামী দিনে এই ঘটনার নিরেট ইতিহাস তুলে ধরার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করবেন।
চুকনগরের গণহত্যা স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অবিচ্ছেদ্য শোকগাথা। এর পরতে পরতে রয়েছে জমাট বাঁধা অশ্রু। স্বজন হারানোর করুণ ইতিহাস আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় ঘটনার শিকার যারা, তারা অনেকেই শোকের বরফ বুকে নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের সেই শোকগাথা বোধকরি যথাযথ ভাবে সংরক্ষিত হয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা তাদের স্মৃতির মণিকোঠায় সংরক্ষিত নিরেট ইতিহাস, আগামী অল্প দিনের মধ্যে হারিয়ে ফেলব। যেটা হবে অতীব দুঃখের। স্বাধীনতা যুদ্ধের চার দশকের বেশী সময় অতিক্রান্ত হলেও জাতীয় পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়নি। আজও দেশের সর্বজনগ্রাহ্য মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সংগে সংগে তালিকায় পরিবর্তন আসে। সুযোগ সন্ধানীরা অর্থ ও প্রতিপত্তির প্রভাব খাটিয়ে ঐ তালিকায় তারা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। আবার নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য রণাঙ্গনের সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি। একই ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়েও গবেষণানির্ভর কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। চুকনগরের গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাবলীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এমন একটা ঘটনা গবেষণালব্ধ ও তথ্য সমৃদ্ধ না হওয়ায় এখনও এর কারণ, ঘটনা, এমনকি হতাহতের সংখ্যা নিয়েও চলছে ব্যাপক বিভ্রাট। যেটা কারো কাম্য হতে পারে না।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামীলীগ নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বললেও ভেতরে-ভেতরে সেনা অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বাঙালীরাও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মানসিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতির চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে।
’৭১ এর মার্চ মাসে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আলোচনার দরজা বন্ধ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অপারেশন সার্চলাইট দলিলে স্বাক্ষর করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। ২৫ মার্চ পাক-বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সমগ্র দেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। দেশের ভিতর যে সব বাঙালি সেনা ও ই,পি,আর ছিল তারা তাদের সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাক সেনারা স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালী ও হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে আঘাত হানতে থাকে। দেশের এই দুঃসময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে শ্রেণীশত্রু খতমের নামে ‘নকশালরা’ অবস্থাসম্পন্ন লোকদের হত্যার খেলায় মেতে ওঠে। একদিকে পাকিস্তানীসেনা ও রাজাকার অপর দিকে নকশালদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হিন্দুরা দলে-দলে ভারতে চলে যেতে থাকে। ১৭ মে পাইকগাছার শিশুবর সরদার, বয়ারসিং-এর অনন্ত কুমার সরদার, বিষ্ণুপদ সরদার, পুলিন বিহারী সরদার, দয়াল সরদার, পদ্মরানী সরদারকে (স্বামী-পুলিন বিহারী) নকশালরা নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের সম্পদ লুট করে। এ খবর দ্রুত দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, রূপসা, মংলা, রামপাল, শরণখোলা, বাগেরহাট সহ অন্যান্য হিন্দু এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তারা জীবনের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠিসহ দেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা ভারতে যাওয়ার সহজ ও নিরাপদ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে চুকনগরকে বেছে নেয়। জোয়ারে নিরাপদ নৌপথে চুকনগর পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও খাওয়া-দাওয়া সেরে স্থলপথে দালাল বা পরিচিত লোকদের সংঙ্গে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার যানবাহন বা পায়ে হেঁটে পর্যায়ক্রমে ভারতে যেতে থাকে। কোন কোন পরিবার পাঁচ-ছয় ঘন্টা থেকে এক বা দেড়দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে পিছনে আসা স্বজনদের সাথে মিশে ভারতে পাড়ি জমাতে থাকে।
২০ মে বৃহস্পতিবার সকালের জোয়ারে শরণার্থী বোঝাই অসংখ্য নৌকা ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদী দিয়ে চুকনগর এসে পৌঁছায়। বটিয়াঘাটার নিরঞ্জন রায় জানান, ১৯ মে যে সকল লোক চুকনগর এসেছিল তাদের বৃহত্তম অংশটি ২০ মে সকাল ৯ টার দিকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বাকীরা পশ্চাতে আগতদের সংগে এক সাথে যাওয়ার আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। আগত শরণার্থীরা সকাল সকাল দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা হওয়ার আশায় রান্না খাওয়ায় ব্যস্ত। প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার লোকের উপস্থিতিতে চুকনগর ও এর এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে লোকে লোকারাণ্য হয়ে যায়। যাত্রা পথের বোঝা কমানোর জন্য কোন কোন পরিবার তাদের ভারী মালামাল চাউল, থালা-কাঁসা, নৌকা পানির দরে বিক্রি করে দেয়। ঐ সকল মালামাল সস্তায় ক্রয়ের জন্য চুকনগর বাজারের তিন থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যের কিছু লোকজনও আসে। স্থানীয় কিছু ভাল মানুষও স্বেচ্ছা-সেবকের মত তাদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখছিল।
বেলা সাড়ে দশটা বা এগারটার দিকে সামরিক সাজে সজ্জিত একটি ট্রাক ও একটি খোলা জিপে পনের-ষোল জন পাকিস্তানী সেনা ঝাউতলায় এসে দাঁড়িয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সংক্ষিপ্ত শলা-পরামর্শের পর তারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে একটি দল খোলা জিপটিতে করে কাঁচা রাস্তা দিয়ে ফকির বাড়ির পাশের কালভার্টের কাছে গাড়ী রাখে। পাঁচ জনের এই দলটি প্রথমে মালতিয়া গ্রামের চিকন মোড়ল ও সুরেন কুণ্ডুকে হত্যা করে। এরপর তারা আবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে একদল পাতাখোলার বিলে ব্রাশ-ফায়ারের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। অন্য দলটি বর্তমান স্মৃতিসৌধ এলাকায় অবস্থান নেওয়া সমর্থবান পুরুষদের হত্যা করতে থাকে। এ সময় অনেক লোককে ঋষি পাড়ায় ঢুকতে দেখে সৈন্যরা ঋষি পাড়ায় ঢোকে এবং তিন জনকে হত্যা করে। এরপর বিলের দিকে অগ্রসর হয় এবং ব্যাপক হত্যা সংগঠিত করে। অপর দলটি ট্রাক নিয়ে আশ-পাশে গুলি করতে করতে আধা ঘন্টার ভিতর বাজারে পৌঁছে যায়। এরাও সমান তালে হত্যা সংঘটিত করতে থাকে। বাজারে পৌঁছে এ দলটিও আবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়। একটি দল যায় পূর্বদিকে, অপর দলটি সরাসরি খেয়াঘাটের দিকে যায়। খেয়াঘাটের দিকে অগ্রসরমান দলটি নৌকায় উঠে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সমর্থবান পুরষরা শিকড়ের মধ্যে, কেয়াবন, ওড়াবন, কেওড়াবন, হরগোজার আড়াল, গর্ত, পুকুর, চাঁদনীর মধ্যে, বটতলায়, গাবগাছে, মন্দিরে যে যেখানে পালাবার চেষ্টা করেছে, সে সেখানেই নিহত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড চলমান অবস্থায় এ পর্যায় গুলি ফুরিয়ে গেলে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করেও ঘাতকরা মানুষ হত্যা চালায়। বেলা আনুমানিক দুইটার দিকে তারা হত্যাযজ্ঞের ইতি টেনে ট্রাক ও জিপে উঠে চুকনগর ছেড়ে সাতক্ষীরার দিকে যায়। প্রায় তিন ঘন্টার হত্যাযজ্ঞে চুকনগর এলাকা পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। এটাই ২০ মে চুকনগর গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
এই গণহত্যা নিয়ে জনমনে কিছু প্রশ্ন আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। যা গবেষণার মাধ্যমে নিরসন হওয়া দরকার। কেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ড! আজও এর সঠিক কারণ উৎঘটিত হয়নি। সে কারণে স্থানীয় ও বাহিরের গবেষকগণ যে যার মত ব্যাখ্যা করছে। ‘ভদ্রা’ ২০১১ সংখ্যায় জনাব হাসেম আলী ফকির ‘চুকনগর গণহত্যাঃ স্থানীয় সম্পৃক্ততা’র কথা সুন্দরভাবে খণ্ডন করেছেন, এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত “১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা” গ্রন্থে ১০২ পৃষ্ঠায় আলাদীপুর গ্রামের শিবপদ রায়ের পুত্র মুকুন্দ বিহারী রায় তার বক্তব্যের শেষাংশে অভিযোগ করেন, “এক জনের নাম আমি জানি তিনি এই জায়গার প্রাক্তন চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। গোলাম হোসেন বাঁইচা আছে কিনা এইডা আমি সঠিক জানিনে। তিনি খান সেনাদের নিকটতম লোক ছিলেন। এই গোলাম হোসেনরাই খান সেনাদের ঐ সাতক্ষীরা লাইনে থেকে যোগাযোগ করে নিয়ে আসে। আমাদের অর্থ সোনা-দানা যা আছে তা লুটতরাজ করে নেয়ার জন্য।” মুকুন্দ বিহারী রায়ের বক্তব্য বিচার ও বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া হাসেম আলী ফকির একই সংখ্যায় (২০১১) চুকনগরের (পুটিমারীর) ভগিরথ দাসের পুত্র সুধীর দাস হত্যাকারীদের সাথে বেহারী দেখেছেন বলে উল্লেখ করছেন। তার বক্তব্যও বিশ্লেষণের দাবী রাখে। কারণ মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ঐ গ্রন্থে সুধীর দাস বলেছেন, ঘটনার সময় পালিয়ে তিনি জীবন রক্ষা করেছেন আধা মাইল দূরে গিয়ে। আধা মাইল দূর থেকে দেখা ও কথা শোনা কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এছাড়া বটিয়াঘাটার নিতাই গাইন একই গ্রন্থের যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তিনি পরিবারের নিহাতদের কথা স্মরণ করে শোকভূত হৃদয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন। তার ঐ আবেগকে শ্রদ্ধাভরে স্মারণ করে শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদন জানাচ্ছি। একই গ্রন্থে দাউনিয়া ফাঁদ গ্রামের সনজিত গাইন হত্যাকারীদের সংখ্যা ২৫/৩০ জন বলেছেন। তিনি হত্যাকারীদের সামনে পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে তাদের অগ্রভাগে সাদা পোশাকধারীরা ছিল বলেছেন। বিষয়টি এমন হতে পারে যে, হত্যাকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্থানীয় কেউ কেউ ঐ কাজটি করে থাকতে পারে। হত্যাকারীর সংখ্যা ১৫/১৬ জনের বেশী কেউ উল্লেখ করেনি। ‘১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা’ গ্রন্থের ভূমিকায় মুনতাসির মামুন বলেছেন, ঘাতকদের সংখ্যা সম্ভবত ১ প্লাটুন এবং হত্যা শেষে ফিরে যাওয়ার সময় কিছু নারীকে তুলে নিয়ে যায় এবং হত্যাকার্য করার সময় তারা নারী ধর্ষণ করে। তার এই বক্তব্য অসত্য বলে মনে হয়। কারণ এলাকাবাসী ও ভিকটিমদের নিকট থেকে এই বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি।
চুকনগর গণহত্যার কারণ হিসাবে অপারেশন সার্চলাইটের কথা কেউ কেউ বলেছেন। আপতঃদৃষ্টিতে এটাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। পাশাপাশি একটা ছোট প্রশ্ন এসে যায়। ২৫ মার্চ এর পর অপারেশন সার্চলাইটের সময় এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন সীমান্ত পথে ভারতে যেতে থাকে। কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড আর কোথাও ঘটেনি। এমনকি হিন্দু এলাকার ভিতর দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যাওয়ার সময়ও কাউকে হত্যা করেনি। পক্ষান্তরে চুকনগরে আক্রান্ত শরণার্থীরা ঝাউডাঙ্গা ও কলারোয়ায় পুনঃপুনঃ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
গণহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে ‘ভদ্রা’ সংখ্যা ২০১১ পত্রিকায় হাসেম আলী ফকির অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে খুলনার মুসলিম লীগ ও জামাতপন্থী নেতাদেরই দায়ী করেছেন। তার এই বক্তব্য কতটা যুক্তি সঙ্গত সেটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। এছাড়া ২০১০ সালে জনাব হাসেম আলী ফকির ‘বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যা’ পত্রিকায় ২০ মে ঘাতক বাহিনীর প্রধান ‘ক্যাপটেন ওয়াহেদ’ নামটি খান আখতার হোসেন রচিত চিত্রনাট্য ‘চুকনগরের লাশ’ থেকে এই কাল্পনিক নামটি ব্যবহার করেছেন। চিত্র নাট্যের ক্ষেত্রে কাল্পনিক নামকরণ দোষের না হলেও গবেষণা পত্রিকার জন্য কাল্পনিক সংযোজন শুধু দোষের নয়, অনৈতিকও বটে।
চুকনগর গণহত্যার বিষয়ে আমি একটি তথ্য সংযোজন করতে চাই। এটাও বিচার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ‘১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা’ গ্রন্থে বটিয়াঘাটা থানায় দাউনিয়া গ্রামের নরেন্দ্রনাথ গাইন (পুলিশ সুপার) বলেন, “সে সময় আমি, মিঃ হারুনুর রশীদ ও অন্যান্যরা মিলে মুক্তিযুদ্ধকে সংহত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করি। ইউনিয়ন পরিষদের কমিউনিটি হল গুলোতে চিড়া, গুড়, ডাব এবং শুকনো খাবার সংগ্রহ করে রাখছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে। কিন্তু আমাদের জলমা চক্রাখালী হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেছে এ খবর পেয়ে পাকিস্তানী সেনারা খুলনা থেকে গানবোট নিয়ে স্কুলের অনতিদূরে নদীতে অবস্থান নেয়। স্কুলকে লক্ষ্য করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এছাড়া বটিয়াঘাটা থানার দাউনিয়া ফাঁদ গ্রামের হরেন্দ্র নাথ গাইন (পেশা চাকুরি) বলেন, “২৫ মার্চ ঢাকায় ক্রাকডাউন হওয়ার এক বা দু’দিন পরই বাগেরহাটের তৎকালীন ই,পি,আর বাহিনী আর্মসসহ একত্রিত হয়। পাকিস্তানী আর্মিরা তখন এখানকার রেডিও সেন্টারটি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ই,পি,আর, দের সংগে যোগ দিয়ে ২৭ তারিখ রাতে পাকিস্তানী আর্মিদের উপর অপারেশন চালাই। মুক্তিযোদ্ধারা বটিয়াঘাটা এলাকায় সংগঠিত হয়েছে এ খবর পেয়ে পাকিস্তানী আর্মিরা ১৪ এপ্রিল দু’টা বা তিনটা গানবোট নিয়ে চক্রাখালী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে শেলিং শুরু করলে গ্রামের লোকজন গুলির শব্দ শুনে নদী পার হয়ে ভারতে চলে যায়।”
উল্লেখিত দু’জনের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, বটিয়াঘাটা এলাকায় ই,পি,আরসহ স্থানীয় শিক্ষিত সচেতন যুবকরা মিলে প্রতিরোধ ক্যাম্প গড়ে তোলে। এটাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানী বাহিনী বটিয়াঘাটা ও দাকোপ এলাকার হিন্দু যুব শ্রেণীকে তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে। সংগত কারণেই ঐ এলাকায় যুব শ্রেণী ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে তাদেরই বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে এটাই ভাবা স্বাভাবিক। তাই ১৯ ও ২০ মে ঐ এলাকার সকল মানুষ ভারতে যাবার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে চুকনগরে সমবেত হয়। খুলনার পাকিস্তানী সেনারা এ খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সাতক্ষীরার সেনা ক্যাম্পে জানিয়ে গণহত্যা চালানোর জন্য প্ররোচিত করে থাকতে পারে। কোন কোন গবেষক বর্ণনা করেছেন যারা চুকনগরে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গিয়েছিল তারা পরবর্তীতে ঝাউডাঙ্গা ও কলারোয়াতে আক্রান্ত হয়েছিল। জনাব ফকির সাহেব ‘বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যা’ পত্রিকায় ১১ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ‘গণহত্যায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হলো বটিয়াঘাটা।’ আর এই বটিয়াঘাটায়ই ঐ এলাকার সর্বপ্রথম প্রতিরোধ ক্যাম্প গঠিত হয়েছিল।
হতাহতের সংখ্যা নিয়েও ব্যাপক বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পর হতে যতদিন যাচ্ছে ততই বাড়িয়ে বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যিনি যত বেশি সংখ্যায় উপস্থাপন করবেন তিনি তত বড় গবেষক। হত্যাকাণ্ডের পরপরই প্রথমে এক দুই হাজার করে গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ হাজারে উন্নীত হয়। প্রায় সকলেই লাশ অপসারণকারীদের উদ্ধতি দিয়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত বলেছিল। এখন সেটা জ্যামিতিক হার বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজারেরও অধিক হয়েছে। ‘ভদ্রা’ ২০১০ সংখ্যায় গবেষক মতিউর রহমান লাশ ফেলার কাজে নিযুক্ত ওয়াজেদ আলী সরদার ও শের আলী সরদারের বক্তব্য তুলে ধরেন। তারা বলেন- “চিত্তনন্দীর বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে পাট দিয়ে দড়ি বানিয়ে ও বাঁশের বাঁক তৈরী করে এলাকার ৩০/৪০ জন লোক লাশ ফেলার কাজ আরম্ভ করি। আমাদের যতদূর মনে আছে, ৪ হাজারের মত লাশ গণনা হয়েছিল। তারপর আর লাশ গোনা হয়নি।” এই বক্তব্য প্রসঙ্গে আমার ধারণা কয়েকটি কারণে তাদের গণনা সঠিক নাও হতে পারে। কারণগুলো হল-
১। মানুষের গলিত ও বিভৎস লাশ দেখতে দেখতে স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে গণনায় ভুল করা।
২। একই লাশ ভুল ক্রমে একাধিক বার গণনা করা (একাধিক ব্যক্তি গণনার জন্যে)
৩। লাশ অপসারণের সময় গণনার চেয়ে লাশের শরীরে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা খোঁজা।
৪। লাশ সরানো বাবদ লাশ প্রতি পারিশ্রমিক নির্ধারিত থাকায় পারিশ্রমিক বৃদ্ধির জন্য ইচ্ছাকৃত লাশের সংখ্যা বেশি করে বলা।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, উল্লেখিত ভ্রাতৃদ্বয় লাশ সরানোর জন্য কতজন নিযুক্ত ছিল তাও ঠিক মত বলতে পারেনি (৩০জন নাকি ৪০ জন)।
শরণার্থীরা লাশের পরিসংখ্যান ঠিকমত বলতে পারেনি। এর পিছনে যে কারণটি দেখা যায় সেটা হল- যে সকল শরণার্থীরা পাতাখোলার বিল বা তার আশ-পাশে ছিল তারা বাজার বা বলের মাঠ এবং এর আশ-পাশ এলাকার কথা অনুমান ভিত্তিক বা লোক মুখে শোনা কথাই বলেছে। তেমনি বাজার বা বলের মাঠ এলাকায় যারা ছিল তারাও অন্যান্য এলাকার কথা অনুরূপ বলেছে। মৃতদের সংখ্যা নিরূপণের জন্য যারা স্থানীয় ও ঠাণ্ডা মাথার মানুষ তাদের ধারণাটাই অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তবে সেখানেও লক্ষ্য রাখা দরকার এমন লোকের বক্তব্য গ্রহণ করা ঠিক হবেনা যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে হীনস্বার্থে তথ্য বিকৃতি করতে পারে। নিম্নে কয়েকজনের ধারণা তুলে ধরলাম-
১। মাওলানা মোহাম্মাদ আলী, অধ্যাপক চুকনগর কলেজ, তিনি বলেছেন ‘আমার ধারণা এক থেকে দুই হাজার মানুষকে পাকিস্তানীরা হত্যা করেছে।’
২। সরদার মোহাম্মাদ নূর আলী, শিক্ষক, রুস্তমপুর। তিনি বলেছেন, ‘আমার অনুমান পাঁচ হাজার বা ততোধিক লোক মারা গেছে।’
৩। বলাই কৃষ্ণ কুণ্ডু, গ্রাম- মালতিয়া, ব্যবসায়ী, চুকনগর বাজার, তিনি বলেছেন- ‘গুলিতে দুই থেকে আড়াই হাজার লোক মারা গেছে।’
৪। মনোজ কান্তি রায়, গ্রাম-
আলাদীপুর, ব্যবসায়ী, তিনি বলেন- ‘আমার পরিবারের পাঁচ জনসহ সেদিন প্রায় চার
থেকে পাঁচ হাজার লোক সেখানে মারা যায়।’
৫। সমরেশ মন্ডল, গ্রাম- খড়িবুনিয়া, পেশা- কৃষি, তার মতে- ‘পাঁচ – ছয় হাজার লোক মারা গেছে।’
৬। পুর্ণেন্দু গাইন, গ্রাম-
বটিয়াঘাটা, পেশায়- শিক্ষক (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়), তার অভিমত- ‘দুই-আড়াই বা
তিন হাজার লোক মারা গেছে।’
৭। মণিমোহন রায়, গ্রাম+থানা-বটিয়াঘাটা, তার মতে- ‘দুই থেকে আড়াই হাজার লোক মারা গেছে।’
৮। আলি বাদশা সরদার, গ্রাম- আটলিয়া, পেশা- ব্যবসা, তার বক্তব্য- ‘আমরা প্রায় চার হাজার থেকে বিয়াল্লিশ শ’র মত লাশ ফেললাম।’
এছাড়াও এলাকার বিশিষ্ট জনদের সংগে আলাপ-আলোচনা করলে তারা মৃতের সংখ্যা দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজারের ভিতরে বলে উল্লেখ করে। ঘাতকদের সংখ্যা ও অবস্থান, তাদের Ammunition, হত্যার সময়কাল, শরণার্থীদের অবস্থান, Target Group, সব মিলে বিচার বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে মৃতের সংখ্যা তিন হাজারের কিছু কম-বেশী হতে পারে এবং আহতদের সংখ্যা চার থেকে পাঁচশত। তবে সঠিক তালিকা প্রকাশের পর যদি দেখা যায় মৃতের সংখ্যা দুই হাজারেরও কম, তা হলেও আমি অবাক হবনা। হতাহতের সংখ্যা যাই হোক না কেন সুষ্ঠু তদন্ত করে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবী করছি। বাঙালীদের বাড়িয়ে বলার প্রবণতা খুবই বেশী। জাতীয় পর্যায়েও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেই পুঁথি সাহিত্যের যুগেও বাঙালীদের অতিশয় উক্তি লক্ষ্য করা যায়-
“লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার
শুমার করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার।”
এই গণহত্যায় হতাহতের সংখ্যা যাই হোকনা কেন সেটা তালিকা হওয়া দরকার। নিহত ও আহতের তালিকা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত যে যত বাড়িয়ে বলুক বা লিখুকনা কেন তা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াবে না এবং এতে ধূম্রজাল কাটবেনা। সংখ্যাধিক্য দেখালে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় বলে আমি বিশ্বাস করিনা বরং প্রকৃত নিহত ও আহতদের তালিকা করে চুকনগরে অথবা শহীদদের নিজ গ্রাম, ইউনিয়ন বা থানা ভিত্তিক তাদের নাম ফলক করে ২০ মে তাদের প্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করলে তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হবে।
চুকনগর গণহত্যার হতাহতের তালিকা তৈরী প্রসঙ্গ টেনে কেশবপুর প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক ও দৈনিক ইন্কিলাবের কেশবপুর প্রতিনিধি রুহুল কুদ্দুস জানান মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর অবঃ রফিকুল ইসলাম ১৯৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালে চুকনগর গণহত্যার স্মরণে স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হয়ে আসেন এবং প্রতিবারই রুহুল কুদ্দুস তার সফর সঙ্গী ছিলেন। তিনি আরও জানান প্রতিবারই মেজর রফিকুল ইসলাম প্রধান অতিথির বক্তব্যে শহীদদের শিকড় পর্যায় অনুসন্ধান করে শহীদদের তালিকা তৈরীর পরামর্শ দেন। কিন্তু তালিকা তৈরীর কোন উদ্যোগ তিনি লক্ষ্য করেননি। এরপর তিনি আর কখনও চুকনগরে আসেননি।
‘ভদ্রা’-২০১১ সংখ্যায় অধ্যক্ষ এ,বি,এম, শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (১৫-খণ্ড) পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, আমি নিজেও ইতিহাসের ছাত্র কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস সম্বলিত দলিলে স্থান পায়নি ইতিহাসের নির্মম একক বৃহত্তম হত্যাকাণ্ড খ্যাত।’ তার এই বক্তব্যে প্রশ্ন আসে কেন ঠাঁই পেলনা? তাহলে ঐ দলিলে ঠাঁই পেতে হলে গণহত্যার যে সকল শর্ত পূরণ হতে হয়, তাকি পূর্ণ হয়নি! বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
চুকনগর গণহত্যা ’৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের প্রচেষ্টায় এ গণহত্যার উপর অনেক কাজ হয়েছে। আমি আশা করি আগামী দিনে তাদের উদ্যোগে নিহত ও আহতদের তালিকা প্রকাশিত হবে। গবেষণার জন্য বিয়াল্লিশ বছর খুব একটা বেশী সময় নয়। এখনও ভিকটিমদের বহুলোক বেঁচে আছে। যারা স্বচক্ষে ঘুরে-ঘুরে হতাহতদের দেখেছে এমন লোকও অনেক আছে। শুধু দরকার উদ্যোগ গ্রহণের। ইচ্ছা করলে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজটি করতে পারে। কাজ করার জন্য উপযুক্ত মানুষও আছে। তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই নির্মম ঘটনার সত্যিকার ইতিহাস জানবে। স্মৃতি রক্ষা পরিষদের দাবী অনুযায়ী ঘোষিত হবে ২০ মে গণহত্যা দিবস, হবে রাস্তা, যাদুঘর, লাইব্রেরী ও অডিটরিয়াম। এমন একটি শুভ সময়ের জন্য অপেক্ষার পাশাপাশি কাজ করার আহবান পেলে তা করার প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
তথ্য সংগ্রহঃ
১) ১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যাঃ মুনতাসির মামুন সম্পদিত।
২) বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যাঃ হাসেম আলী ফকির।
৩) ‘ভদ্রা’- ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ঃ ভদ্রা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
* অনুপম ইসলাম – কবি ও সাহিত্যিক।
* আলী আহম্মদ – কবি ও লেখক।
* অধ্যাপক মতিউর রহমান – গবেষক, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।