‘বৃন্দাবন’ ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলায় অবস্থিত। এটি বৈষ্ণবদের মহাতীর্থক্ষেত্র ‘বৃন্দা’ শব্দের অর্থ রাধা, রাধিকা, রাধার অন্যতম সখী। ‘বন’ অর্থ ক্রীড়াকানন। তাই সংক্ষেপে বৃন্দাবন হল রাধার ক্রীড়া কানন। রাধা হল কৃষ্ণপ্রেম পরায়না গোপীবালা। এর নামান্তর রাধিকা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে বর্ণিত আছে, রাধা ঈশ্বরের হলাদিনী শক্তি এবং গোলকে শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়া। একদা শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামকে দ্বার রক্ষা করতে বলে চন্দ্রাবলীর সহিত ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হন। এ সময় রাধা এসে শ্রীদামকে দ্বার ছাড়তে বলে শ্রীদাম অস্বীকার করলে রাধা তাকে দৈত্যরূপে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দেয়। শ্রীদামও রাধাকে মানবীরূপে জন্মগ্রহণ ও শতবর্ষ শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা ভাগিনী হতে শাপ দেয়। সে অনুযায়ী রাধা গকুলে কলাবতীর গর্ভে বৃষ্ণভানু গোপের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে। আয়ান ঘোষের সাথে তার লৌকিক বিয়ে হলেও শ্রীকৃষ্ণকে মন-প্রাণ সমার্পণ করে। শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গমন করলে রাধা শতবর্ষ বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সহ্য করে পরে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়। এই প্রেম পাপাসিক্ত নয়, প্রত্যুত ভগদ্ভক্তির আদর্শ।

ছেলেবেলা থেকে বহুভাবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমাপাখ্যান শুনেছি। আমার গ্রামের বাড়ীর মুসলিম পাড়ার শেষ বাড়ী আমাদের বাড়ী। আমার বাড়ীর পাশ্বই হিন্দু পাড়া শুরু। তাই সংগত কারণে প্রতিবেশীরা হিন্দু। এর ভিতর ব্রজলাল গাইন নামে আমার এক দুাদু ছিলেন। তিনি সাধুবেশী জীবন যাপন করতেন। দাদুর আরেক ভাই নিত্যাই গাইন সেও সাধু। দু’ভাই মধ্য বয়সের পর তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দাদুর বাড়ীতে তাদের গুরুদেব প্রফুল্য নামে এক বৈষ্ণব সাধু আসতেন। ভদ্রলোক আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দাদু ও তার গুরুদেবের কাছে বিভিন্ন তীর্থের গল্প শুনেছি। তাদের কাছে শোনা বৃন্দাবনের গল্প শুনে ও পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার সুবাদে বৃন্দাবনের কথা জানতে  পারি। এই সকল জানার মধ্যে আমার মনের ভিতর বৃন্দাবন ও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার স্থান দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল। ভ্রমণের নেশা পূর্ব থেকে ছিল। দাদুর ছোট ছেলে উত্তম গাইন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। সম্পর্কে কাকা হলেও আমরা সমবয়েসী। শিক্ষায় মাত্র এস, এস, সি পাশ হলেও সশিক্ষিত মানুষ। কুসংস্কার মুক্ত এই মানুষটির সঙ্গে ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বৃন্দাবনে পলাশ গাইন নামে এক ভাইপো থাকায় বৃন্দাবন দেখার সুবর্ণ সুযোগ মনে করি। বিপত্তি হিসেবে দেখা দেয় কাকার ভিসা না পাওয়া। সিদ্ধান্তে অটুট থেকে কাকা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালে ০৮ আক্টোবর আমরা বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছাই। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে কাকাকে পৌছানোর ব্যবস্থা করে আমি পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করি। ঐদিন আমরা মসলন্দপুর বিবেকানন্দদের বাড়ীতে উঠি। ধর্মীয় সম্পর্কে সে আমাদের পিসতিতো ভাই। পরদিন ৯ অক্টোবর বিকাল বেলায়  মসলন্দপুর স্টেশনে আমাদের গ্রাম সম্পর্কীয় ভাগ্নে ভগিরথ ও ছোট ভাই তপনের সঙ্গে দেখা হলো একসাথে আমার ১১ তারিখ আগ্রায় যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়ে মসলন্দপুর স্টেশন থেকে সুপার ফার্স্ট আজমীর এক্সপ্রেসে টিকিট ক্রয় করি। ৯ ও ১০  ইং তারিখ যথাক্রমে আমরা ঘোষপুর ও পানপাড়ায় অবস্থান করে ১১ তারিখ আমরা ৪ জন রাত পোনে ১১ টায় শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপি।

১২ অক্টোবর রাত ১০ টায় আমরা আগ্রা স্টেশনে পৌঁছাই ও সেখানেই রাত্রি যাপন করি। পরদিন ভোর বেলায় তাজমহল ও আগ্রাপোর্ট দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। এই বিষয়ে পরে পাঠকদের জানাতে পারব। বেলা ১১:৩০ টায় আগ্রা থেকে মথুরার উদ্দেশ্যে বাসে চড়ি। বেলা ১:০০ টা নাগাত মথুরা বাসস্টান্ডে  নামি। বাস থেকে নেমেই  ভাইপো পলাশ গাইনকে পেলাম। আমাদের প্রণাম করে সানন্দচিত্তে আমাদের গ্রহণ করে। তার পরামর্শ মত আমরা একটি অটোতে চড়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান দেখতে গেলাম। মনে তখন কংসের কারাগারে বসুদেবের ঔরসে দেবকারী অষ্টম গর্ভের সন্তান শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী ভেসে উঠতে লাগল। অটো থেকে নেমে জন্মস্থানের  দ্বারপান্তে পৌছে কংসের কারাগারের দ্বাররক্ষীর ভাষ্কার্য দেখে অবাক হলাম। সুতীক্ষ বল্লমধারী দ্বাররক্ষী যেন জীবান্ত। জুতা খুলে নিরাপত্তা রক্ষীদের বষ্টনী পার হয়ে হাটি-হাটি পায়ে কারাগারের ভিতরের দিকে এগুতে থাকলাম। কাকা ধর্মীয় চিন্তায় বেদানুসারী। ঘুরে-ঘুরে দেখার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে লাগলাম। কংসের কারার লোহার গারদ, বিভিন্ন প্রাসাদ ও ভবন দেখতে লাগলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল কারা ভবনের পেছনের দিকে সুরম্য ঈদগাহ্। কিছুটা অবাক হলাম। শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের এত সন্নিকটে এই ঈদগাহ দেখে ভাবলাম এই অঞ্চলে মুসলমানদের বাস আছে। জন্মস্থান মন্দিরের পাশে একটু খোলা আঙ্গীনা। তার এক পাশে বিশাল অজগরের ভাষ্কার্য। টিকিট কিনে সেই অজগরের মুখগহর দিয়ে তার পেটের ভিতর ঢুকে গেলাম। অজগরের শরীরের বাঁকে-বাঁকে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ভাষ্কার্য। ননী চুরি, কালিকানাগদমন, বকাশুর বধ, গরু চরানো, স্নান ঘাট, রাঁধা কৃষ্ণের ঝুলন, কংসবধ, প্রভৃতি ভাষ্কার্য দেখে অগজরের পিছন দিকদিয়ে বেরিয়ে গেলাম। দর্শনীয় সকল বিষয় কাকার সংগে মত বিনিময় করতে লাগলাম। কল্পনার অবগাহনের ভিতর আছান্ন থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলাম প্রধান ফটক থেকে। বাইরে এসেই পলাশের সংগে কথা বলতেই তার বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। তপন ও ভগিরথ জন্মস্থানে থেকে গেল। রিক্সায় যাওয়ার সময় পলাশ চশমা খুলে রাখতে বলল, কারণ হিসাবে জানাল বানরা রিক্সায় লাফিয়ে পড়ে চশমা খুলে নিয়ে যেতে পারে। বৃন্দাবনে অসংখ্যা বানর। এরা বড় ধরণের ক্ষতি না করলেও ছোট খাট উপদ্রব করতেই থাকে। রিক্সায় যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম রিক্সাওয়ালা বা পথচারীরা সাড়া দেওয়ার জন্য রাধে রাধে বা জয়রাধে উচ্চারণ করছে।

পড়ন্ত বিকালে আমি ও কাকা পলাশের বাসায় হাজির হলাম। ৩ তলা ভবনের ৩য় তলায় পলাশ থাকে। সামনে ছাদের কিছুটা অংশ ফাঁকা। পলাশের নববিবাহিতা স্ত্রী আমাদের পুত্রবধু প্রণাম করে আমাদের সেবার জন্য স্নান ও আহারের তাগিদ দিল। আমরাও ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম। দ্রুত স্নান ও আহারের পর আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।  ঘুম ভাঙ্গল বিকট শব্দে। সন্ধ্যা সমাগত। ঐ রাত ছিল কালীপূজার (দিপাবলীর) রাত। অসংখ্য পটকা ও বাজির শব্দে তিনতলা ভবনটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাতে খোলা ছাঁদে বসে আমরা দিপাবলীর আলো ও বাহারী আতসবাজীর খেলা দেখতে লাগলাম। রাত্রের খাবার খেয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। শব্দের তান্ডবতায় রাতে সুনিদ্রা হলো না। তন্দ্রা ও আধো জাগরণে রাতটা কাঁটালাম। পরদিন ১৪ অক্টোবর সকাল সকাল আমরা বৃন্দাবন ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য পলাশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে পৌঁছলাম রাধা-গোবিন্দের মন্দির। দেওয়ান নন্দ কুমার বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হারাবাড়ী নামক কুঞ্জে এ মন্দির প্রতিষ্ঠিত। অসংখ্য ভক্তদের ভীড়। বহু কষ্টে ভীড় ঠেলে মন্দিরের বিঘ্রহ দেখলাম। এছাড়া দেখালাম মন্দিরের মূল প্রবেশপথের দুধারে বহু শীর্ণ কায়ার মানুষ সামনে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসে আছে। কোন কোন দর্শণার্থী দু’এক পয়সা করে তাদের পাত্রে দিচ্ছে। এরপর গেলাম লালা বাবুর মন্দির। কীর্তন গানে লালাবাবুর রাধা-গোবিন্দের ভক্তির কথা শুনেছি। কোলকাতার পাইকপাড়ার খ্যাতনামা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ ১৮১০ সালে এ মন্দির নির্মাণ করেন। বৃন্দবন অঞ্চলে তিনি লালাবাবু নামে পরিচিত। এ মন্দির দর্শনের পর গেলাম লক্ষৌ’র বিহারী লাল সাহার নির্মিত সাহজীর মন্দির। এ মন্দিরে রাধা রমন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। সামনে এগুতে থাকলাম, হাজির হলাম ব্যহ্মচারী মন্দিরে। গোয়ালিয়ার মহারাজ জিয়াজী রাও সিন্ধিয়া গিরিধারী দাস ব্রহ্মচারী এই মন্দির নির্মাণ করে রাধা গোপাল, হংস গোপাল ও নৃত্যগোপাল প্রতিষ্ঠা করেন। সামনে সু-উচ্চ মন্দিরের দিকে এগুতে থাকলাম। এই মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সুদৃশ্য। শেঠ লছমী চাঁদ জৈন ধর্ম পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পর এ মন্দির নির্মাণ করে রঙ্গজীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মন্দিরের সামনেই ৪০ হাত উঁচু সোনার পাতে মোড়া একটি গরুঢ়স্থম্ভ আছে। লোকে এটাকেই সোনার তালগাছ বলে। অপূর্ব নির্মাণ শৈলী। অগনিত ভক্তের ভীড় এখানে। এই মন্দিরের দক্ষিণ পাশে পুরোপুরি চারপাশ ঘাট বাঁধানো একটা পুকুর দেখলাম। এই পুকুরের সুরম্য বাঁধানো ঘাটের সাথে রাধা কৃষ্ণের বিভিন্ন ভঙ্গিময় ভাষ্কর্য শোভা পাচ্ছে।

সমগ্র বৃন্দাবন জুড়ে অসংখ্য মন্দির। একটার পর একটা মন্দির দেখতে দেখতে সামনে এগুচ্ছি। দু’একটি গরুর খাটাল চোখে পড়ল। বৃন্দাবন শহরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সিন্ধি, শাহিওয়াল জাতের বেশকিছু গাভী ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। এরপর চলে এলাম যমুনার ধারে। যমুনা এখন কিছুটা দূরে সরে গেছে। একটি ৩/৪ ফুট বেড়ের অচেনা গাছে বিভিন্ন রং-এর কাপড় বাঁধা দেখলাম। পাশেই একটা মন্দির। যমুনার তীরে বিভিন্ন রঙের কাপড় বেঁধে রাধা ও সখীদের স্নানঘাট হিসেবে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ঠ করতেই এই ব্যবস্থা।  কেশীঘাট দর্শনের পর আমরা শহরের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন স্থান ও মন্দির দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। শহরের ভিতর বেশকিছু পুরাতন ভবন ও বোডিং দেখলাম। এরপর চলে এলাম নিধুবনের দ্বারে। গুল্মজাতীয় গাছে শোভাহিত সবুজ বনানী এই নিধুবন। আগেই জেনেছিলাম সম্রাট আকবর নিধুবন দেখে খুশি হয়েছিলেন। সবুজ ঝোপ জাতীয় গুল্মবন চিত্তাকার্ষণও বটে। ক্লান্ত ও কিছুটা ঘর্মাক্ত শরীরে হালকা মৃদুমন্দ বাতাসে ভাল লাগতে লাগল। এখানে এসে একটু বিশ্রামের নেওয়ার সময় কাকার সঙ্গে বর্তমান বৃন্দাবন সম্পর্কে আলোচনা করি। পঞ্চপান্ডবের মহাপ্রস্থানের পর শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র ব্রজনাভ মথুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ব্রজনাভের মা রোচনাদেবী তাকে শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি গঠন করতে বলেন। মা’র কথানুযায়ী ব্রজনাভ শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তৈরী করে। রাজমাতা সেই মূর্তি দেখে মুখমন্ডল ব্যতিত অন্যকোন অংশ শ্রীকৃষ্ণের মত নয় বলে দ্বিতীয় বার মূর্তি তৈরী করেন। এবার রোচনা দেবী বক্ষস্থল ব্যতীত অন্য কোন অংশ শ্রীকৃষ্ণের অনুরূপ নেই বল্লে তৃতীয় মূর্তি তৈরী করা হল। এবারও রোচনা দেবী মূর্তির পদদ্বয় ছাড়া অন্যকোন অংশ শ্রীকৃষ্ণের অনুরূপ নয় বলে জানালেন।

ব্রজনাভ এবার চতুর্থ মূর্তি তৈরী করতে মনস্থির করলে রাজমাতা তাকে নিবৃত্ত করেন এবং তিনটি মূর্তিই যথাক্রমে গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদন গোপাল তিন নামে ব্রজমন্ডলের তিনটি স্থানে স্থাপিত করার কথা বলেন। অপর স্থানে কৃষ্ণনীলার স্মরণ চিহ্নস্বরূপ প্রকৃত স্থানে গ্রাম ও কূপ প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে ব্রজামন্ডল তীর্থ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ব্রজমন্ডলে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্যে বৃন্দাবন তীর্থ মহাত্ম বিলুপ্ত প্রায় হয়ে পড়ে। খৃষ্টীয় ১১ শ’ শতাব্দীতে গজনীর মাহামুদ মথুরা মহাবন আক্রমণ করে তীর্থ গৌরব ধবংস করে। কৃতুবুদ্দিন আইবেকের সময় মথুরা মন্ডল মুসলিম শাসনাধীনে আসে। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় মথুরা বৃন্দাবনের সুদিন আসে। এ সময় চৈতন্যদেবের আদেশে বৈষ্ণবগন বৃন্দাবনে এসে বসবাস করেন এবং তীর্থ গৌরব পুনরূদ্ধারে যত্নবান হন। দ্বাদশ ঘাটসহ সমগ্র বৃন্দাবনের পরিধি পাঁচ ক্রোশ। ব্রজ চৌরাশি ক্রোশের পরিক্রমাকে বন বলে। এই পরিক্রমা ভ্রাদ্রকৃষ্ণ দশমীতে আরম্ভ হয়ে ভাদ্র শুক্লা দশমীতে শেষ হয়। ব্রজের দ্বাদশ বন হল মধুবন, তালবন, কুমুদবন, বহুলাবন, কাম্যবন, খরিদবন, ভদ্রবন, ভান্ডিরবন, খেলনবন,  লৌহবন, মহাবন ও বৃন্দাবন। গোকুল, গোবধন, নন্দগ্রাম প্রতৃতি ২৪ উপবনের অন্তর্গত। সমগ্র পরিধির মধ্যে ১১টি দেবীমূর্তি ও ৯টি মহাদেব মূর্তি বিদ্যমান, ঝুলন যাত্রাই, বৃন্দাবনের সর্ববৃহৎ উৎসব।

যতটুকু জেনেছি ৫ কিলোমিটার বৃত্তাকারে বৃন্দাবনের অবস্থান। ছোট-বড় মিলে প্রায় ৫ শতাধিক মন্দির আছে এখানে। এখনও অনেক মন্দির নির্মিত হচ্ছে। পলাশ আমাদের জানাল বৃন্দাবনে বসবাসকারীদের প্রায় অর্ধেক বাঙালী। মন্দিরের শহর হওয়ায় বাইরের দর্শনার্থীরা প্রায় সকলেই ভক্ত। তারা বৃন্দাবনের মন্দিরের ধুলা বালি অঙ্গে মেখে তৃপ্ত। প্রায় সারাদিন অলিগলি ঘুরে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পলাশের বাসায় ফিরে এলাম। বৌমা’র পরম যত্নে আহার ও বিশ্রামের পর আমি ও কাকা পলাশকে সঙ্গে নিয়ে যখন মথুরা স্টেশনে পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা সমাগত। স্টেশন থেকে আমরা ভূপালের টিকিট কিনে গাড়ীর জন্য প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মনে মনে ভাবছি, পলাশ যদিও বারবার আবার আসার কথা বলছে কিন্তু এখানে আর আমাদের কখনও আসা কি সম্ভব হবে? গ্রামের সেই হামাগুড়ি দেওয়া পলাশকে বাকী জীবনে হয়তো আর দেখতে পাব না ভেবে মনটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। পলাশ ও কাকাকে চোখ মুছতে দেখে নিজেও বেসামাল হয়ে পড়ছিলাম। এমন সময় পলাশের কথায় বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ি। আমাদের ট্রেন এসেছে। সংক্ষিপ্ত কথায় অশ্রু-সজল চোখে ট্রেনে উঠে পড়ি। আলোক ঝলমল স্টেশনে অশ্রু-সিক্ত পলাশকে রেখে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি আমাদের নিয়ে ভূপালের উদ্দেশ্যে রওনা হল। যতদূর দেখা যায় হাত নেড়ে বিদায় জানালাম পশালকে, বিদায় জানালাম রাধা-কৃষ্ণের স্মৃতি বিজড়িত মথুরা-বৃন্দাবনকে।

লেখক পরিচিতিঃ

মোঃ রুহুল আমিন

অধ্যক্ষ, পাঁজিয়া ডিগ্রী কলেজ, ডাকঘরঃ পাঁজিয়া, উপজেলাঃ কেশবপুর, জেলাঃ যশোর।
সাংবাদিক ও কলামমিস্ট।
মোবাঃ ০১৭১৮-৬১১৫৫০, ই-মেইলঃ  ruhulamin0655@gmail.com